সামাজিক শক্তি-দলাদলির ঘানি বনাম মানুষের নড়াচড়া by ফারুক ওয়াসিফ

নিজেকে ভুল প্রমাণিত হতে দেখতে ভালো লাগার কথা নয়। তার পরও লাগল ভালো। ৭ জুলাইয়ের প্রথম আলোয় ‘জয়-জিন্দাবাদ ঝগড়াপুরী রাজনীতি’ শিরোনামে গোষ্ঠীস্বার্থে দলাদলির বিপদ নিয়ে লিখেছিলাম। লেখার হেতু ছিল কুষ্টিয়ার মৃত্তিকাপুর গ্রামে দলাদলির পাল্লায় পড়ে ‘মহাজোটের সাঁকো’ বনাম ‘ঐক্যজোটের সাঁকো’ তৈরির ঝগড়া।
দুই দলের দুই নেতার রেষারেষিতে গ্রামের নদীর ওপর দুটি ‘রাজনৈতিক সাঁকো’ তৈরি হয়েছিল এবং তা প্রতিদ্বন্দ্বী দলের সমর্থকদের জন্য নিষিদ্ধ হয়েছিল। সমাজকে বিভক্ত করার ওই রাজনৈতিক ঝগড়াকে মনে হয়েছিল চলতি রাজনীতির প্রতীক। ফল হিসেবে দেশটা ‘ঝগড়াপুর’ হয়ে উঠছে বলে দুশ্চিন্তাও প্রকাশ করেছিলাম।
দুশ্চিন্তা কিছুটা লাঘব করল পাবনা জেলার গদাই রূপসী গ্রাম ও কুড়িগ্রামের গোড়াই পাঁচপীর ও কালীরপাঠের মানুষ। তাঁরা জানালেন, দেশটা ‘ঝগড়াপুর’ হয়ে ওঠেনি এখনো। মৃত্তিকাপাড়ার নামের অপমান ঘটিয়েছিল ওই গ্রামের লীগ-বিএনপির নেতারা। অন্যদিকে দলীয় বিভক্তির ধার না ধেরে, এলাকার নেতা-চেয়ারম্যানদের ছাড়াই ওই তিন গ্রামের মানুষ নিজেদের চাঁদায় নিজেদের শ্রমে গ্রামের পাশে সাঁকো বানিয়ে বহুদিনের যোগাযোগ সমস্যার সমাধান করেছেন। যখন ক্ষমতা ও দখলকেন্দ্রিক দ্বিদলীয় রাজনীতির দোনলা বন্দুকের সামনে সামাজিক উদ্যম-উৎসাহের দম হাঁসফাঁস দশা, তখন এ ধরনের গঠনমূলক কাজ করা কঠিন। সেই কঠিন কাজের জন্যই অভিনন্দন রূপসী ও পাঁচপীর-কালীরপাঠের গ্রামবাসীকে।
যে গ্রামটিকে বিভক্তির প্রতীক ‘ঝগড়াপুর’ বলেছিলাম, তার আসল নাম মৃত্তিকাপাড়া, মাটির নামে নাম। আর ঐক্যের প্রতীক রূপসী, গোড়াই পাঁচপীর ও কালীরপাঠের মাটির মানুষেরা। রূপসী নামটি মনে করিয়ে দেয় জীবননান্দ দাশের রূপসী বাংলার কথা। পাঁচপীর আর কালীরপাঠ প্রমাণ করে হিন্দু ও মুসলিম কৃষি মানব-মানবীদের সনাতন রাখিবন্ধনের স্মৃতি। নামগুলোই জানায়, গ্রামীণ মানুষের সৌন্দর্যবোধ ও সম্প্রীতির ইতিহাস এখনো বিলুপ্ত হয়নি।
এই মানুষদের অভিনন্দন তাঁদের স্বেচ্ছাশ্রমের জন্য। ব্যতিক্রম বলেই এটা খবর। অথচ একদা এটাই ছিল নিয়ম। রাজনীতিও আগে একধরনের স্বেচ্ছাশ্রমই ছিল। কিন্তু এখন প্রতিদান ছাড়া কেউ কিছু করেন না। কিছু করার প্রতিদানে নেতা ও সেবকেরা খ্যাতি-বিত্ত-ক্ষমতা প্রত্যাশা করেন এবং সেটা পাওয়ার বন্দোবস্তও তাঁদের জানা। সবাই সে রকম নন, তবু ঠগ বাছতে রাজনীতির গাঁ উজাড় হওয়ার জোগাড়। ইংরেজ আমল, পাকিস্তান আমল হয়ে বাংলাদেশ আমলে যত দিন গেছে, তত রাষ্ট্র ও রাজনীতি সমাজকে নির্জীব করাতেই বেশি অবদান রেখেছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সমাজের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে রাষ্ট্র। সামাজিক উদ্যম ও উদ্যোগকে আত্মসাৎ করতে চেয়েছে রাজনীতি। তার পরও সেই সামাজিক পুঁজি যে এখনো নিঃশেষ হয়নি, স্বেচ্ছাশ্রমের সাঁকো তার প্রমাণ। আবার দলাদলি যে ওই পুঁজির অপচয় ঘটায়, রাজধানীতে দুই দলের কোন্দল কীভাবে দেশটাকে ভাগ করে ফেলে, মৃত্তিকাপাড়ার ‘রাজনৈতিক সাঁকো’ তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখাল। ওই ঘটনার পেছনে ছিল ইউপি নির্বাচন, সেই নির্বাচনে এ পর্যন্ত নিহত ৬৫ জন। দলাদলির ঘানি আমরা জানমাল সব দিয়েই টানি।

দুই.
ইংরেজ নদীবিশেষজ্ঞ স্যার উইলিয়াম ১৯২৮ সালের এক বক্তৃতায় বলেছিলেন, বাংলাদেশের নদ-নদী, খাল-বিলজুড়ে ছড়ানো প্রাচীন সেচব্যবস্থা এ দেশের মানুষের সামাজিক উদ্যোগের ফসল। বন্যা মোকাবিলায় বাঁধ নির্মাণ ও কাটা, সেচের খাল-নালা দেখভাল করা, সড়ক-বিদ্যালয় নির্মাণের মতো বহু সামাজিক অবকাঠামো নির্মাণে মানুষ একযোগে কাজ করত এবং এসবের ওপর তাদের হক প্রতিষ্ঠিত ছিল। এই সামাজিক পুঁজির বরাতে অনেক অসুবিধার মধ্যেও বাংলাদেশ এগিয়ে গিয়েছে, টিকে থেকেছে।
যশোরে ভবদহ এলাকায় জলাবদ্ধতা হয়েছিল ওয়াপদার ভুলে। কিন্তু এর সমাধান হয় স্থানীয় মানুষদের আন্দোলন ও উদ্ভাবনার ফলে। জলবায়ু পরিবর্তনের দরুন যখন সমুদ্রের তলে জমি ডুবে যাওয়ার কথা, তখন দক্ষিণাঞ্চলে চাষিদের বুদ্ধিতে সমুদ্রের তল থেকে ভূমি জাগানো সম্ভব হচ্ছে।
এই সামাজিক শক্তির খবর না জানার জন্যই হয়তো ২০০৫ সালে নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকা তো ‘দ্য পাজল অব বাংলাদেশ’ নামে একটা প্রতিবেদন ছাপে। এর সারমর্ম হলো, বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদ তেমন নেই, নেই সুশাসন, নেই সৎ ও যোগ্য নেতৃত্ব, নেই দূরদর্শী ও জনমুখী প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো। রাজনৈতিক ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাংলাদেশের ছায়াসঙ্গী। তার পরও গত দেড় দশকে বাংলাদেশের গড় প্রবৃদ্ধি ৫ শতাংশের ওপর ধরে রেখেছে। ২০০৬-০৭ সালে জিডিপি সাড়ে ৬-এর ঘরেও উঠেছিল। মানে না হলেও পরিমাণে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা ভারতকে ছাপিয়ে গেছে। প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষায় নারী-পুরুষ বৈষম্য কমানোয় ভারত থেকে এগিয়ে। পাঁচ রকম কারণে শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হার ভারত বা চীনসহ অনেক উন্নয়নশীল দেশের থেকে কম। দারিদ্র্য প্রতিবছর ১ শতাংশ করে হলেও কমছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আত্মবিশ্বাসী করার মতো। জিডিপিতে বিদেশি সাহায্যের ভাগ ৬ শতাংশ থেকে কমে হয়েছে ১ দশমিক ৮ শতাংশ। দুর্নীতি আর লুটপাট কিছুখানি কমলে এটুকুও দরকার হতো না।
কীভাবে এই গতিশীলতা সম্ভব হচ্ছে, তা সমাজবিজ্ঞানীদের কাছে একটা ধাঁধা। তাঁরা এর নাম দিয়েছেন ‘দি বাংলাদেশ প্যারাডক্স’। তাঁদের বিস্ময়ের কারণ এ দেশের সাধারণ মানুষ—আসলে কৃষির মানুষ, মাটির মানুষ যাঁরা। তাঁরা গরিব কিন্তু সৎ, অনাহারী, লুঙি-শাড়ি পরা এবং আধুনিকতাবাদীরা এঁদের কুসংস্কারাচ্ছন্ন বলতে ভালোবাসেন। এই মানুষেরাই দুই হাত আর মাটির ওপর বিশ্বাস রেখে প্রতিবছর খাদ্য উৎপাদন ৩ শতাংশ করে বাড়িয়ে যাচ্ছেন। এই বৃদ্ধি জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছাপিয়ে যাওয়ায় খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা এসেছে। অথচ একদিকে সার-বিদ্যুৎ-পানি-বীজ-ঋণের জন্য মনুষ্যশক্তির সঙ্গে, অন্যদিকে বন্যা-খরা-মড়কের বিরুদ্ধে প্রাকৃতিক শক্তির সঙ্গে কী হাড্ডাহাড্ডি লড়াই-ই না কৃষক নামের এই প্রজাতিকে লড়তে হয়! যাঁকে চিরকাল মাটির ওপর উবু হয়ে কাজ করে যেতে দেখি, যিনি প্রায়শই ফসলের ন্যায্য দাম পান না, ঋণের সুদ যাঁর পিছু ছাড়ে না, সেই মানুষটির মতো জীবনীশক্তি কার আছে? তাঁদের কল্যাণেই হাজার বছর বয়সী অন্নাভাব কাটাবার সামর্থ্য বাংলাদেশের দোরগোড়ায়।
২০০৫-এর বন্যার পরে আইএমএফের ভবিষ্যদ্বাণী ব্যর্থ করে প্রবৃদ্ধি ৫-এর ঘরেই থেকেছে। ওই বছরই কোটার মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়া আর চীনা প্রতিযোগিতার মুখে তৈরি পোশাকশিল্প যায় যায় রব উঠেছিল। কিন্তু যায়নি, বরং আরও বেড়েছে। চলতি বৈশ্বিক মন্দার তোড়ে কত হাতি-ঘোড়া তলিয়ে গেল, কিন্তু বাংলাদেশ এখনো জল মেপে পথ পাড়ি দিচ্ছে। আইলা-সিডর দক্ষিণাঞ্চলের মাজা ভেঙে দিলেও মনের জোর ভাঙেনি। সরকার দায়সারা। বিদেশিরা ভুলে গেছে। প্রকৃতি বিরূপ, তবু খোলা সমুদ্রের সামনে লাশ আর ধ্বংসস্তূপ থেকে মানুষ ঠিকই উঠে দাঁড়িয়েছে, অমানুষিক কষ্টের মধ্যেও আবার চালাচ্ছে জীবন চালিয়ে যাওয়ার লড়াই। তরুণদের অসংখ্য স্বাধীন উদ্যোগ অর্থনৈতিক সামর্থ্যও বাড়াচ্ছে। অর্থমন্ত্রী জানাচ্ছেন ২০০৮-০৯ সালে প্রবৃদ্ধি ছিল ৫ দশমিক ৯ শতাংশ, এ বছরে তা উঠেছে ৬-এর ওপরে।
রাজনীতিতেও দেখা যাবে যে সাধারণ মানুষ ক্ষমতার কামড়াকামড়ি চায় না, দুর্নীতির বিরুদ্ধে তারাই সবচেয়ে বেশি সোচ্চার। কানসাট, ফুলবাড়ী, শনির আখড়া ও আড়িয়ল বিলে জনমানুষের প্রতিবাদ অন্যায় ও দুর্নীতি ঠেকিয়েছে। সন্ত্রাস ও নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে বাড়তে থাকা সামাজিক আন্দোলনও নাগরিক শক্তির নড়াচড়ার প্রমাণ। প্রশ্ন হচ্ছে, বৃহৎ রাজনৈতিক শক্তি কত কাল এই সামাজিক শক্তিকে উপেক্ষা করে চলতে পারবে? যদি পারেও, তাতে কি দেশের ভালো হবে?
আমাদের সাফল্যগুলো সেসব সামাজিক ক্ষেত্রের, যেখানে রাজনীতিবিদেরা খুব বেশি বাধা হননি। যতই ধাঁধা লাগুক, যতই স্ববিরোধী মনে হোক, দেশটা চলছে সাধারণ মানুষের উদ্যোগ আর জীবনীশক্তির কল্যাণে। এই সামাজিক জীবনীশক্তিই বাংলাদেশের আশাবাদী হওয়ার প্রধান রসদ। বাংলাদেশ নামক ধাঁধার সত্যিকার উত্তর।
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক।
farukwasif@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.