শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান-কেন আন্দোলন ভিকারুননিসায়?

দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ভিকারুননিসা নূন স্কুলের প্রাক্তন ও বর্তমান ছাত্রী এবং অভিভাবকেরা আজ এক বড় আন্দোলনে রয়েছেন। তাঁদের দাবি ১. যৌন নিপীড়নকারী শিক্ষক পরিমল জয়ধরের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি, ২. তদন্ত সাপেক্ষে দোষী অন্য আসামি ও অপরাধীদেরও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি, ৩. অধ্যক্ষের অপসারণ, ৪. নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নির্বাচনের
মাধ্যমে পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন, ৫. জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শিক্ষকদের মধ্য থেকে অধ্যক্ষ নিয়োগ, ৬. বিভিন্ন শাখায় যেসব শিক্ষকের বিরুদ্ধে আচরণগত সমস্যার অভিযোগ উঠেছে তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ ও ৭. রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ও দুর্নীতিমুক্ত শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিত করা।
প্রশ্ন উঠতে পারে, পরিমল জয়ধরকে গ্রেপ্তার করার পরও কেন আন্দোলন? আন্দোলনের দাবি হিসেবে অধ্যক্ষ হোসনে আরার পদত্যাগের প্রশ্নটি কেন চলে এল? আমরা এই স্কুলের প্রাক্তন শিক্ষার্থী হিসেবে ব্যাপারটি সম্পর্কে কিছু কথা বলতে চাই, যাতে এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে।
সত্য বটে, পরিমল জয়ধরকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গ্রেপ্তারের পর পরিমল আদালতে নিজের দোষ স্বীকার করেছেন। অপরাধী দোষ স্বীকার করলে তাঁর শাস্তি একরকম নিশ্চিত হয়ে যায়। তার পরও ভিকারুননিসার ছাত্রীরা তাঁর উপযুক্ত বিচার নিশ্চিত করার দাবিতে টানা কয়েক দিন আন্দোলন করেছে, প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা রাজধানীতে বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে জনসচেতনতা বাড়ানোর কাজ করেছেন। এতে ছাত্রীদের আন্দোলনও বেগবান হয়েছে।
দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে, অপরাধ স্বীকার না করেও উপায় নেই। ধূর্ত পরিমল তাই শেষবারের মতো নিপীড়নের শিকার মেয়েটিকে একহাত দেখে নিলেন। আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে পরিমল জয়ধর মেয়েটির পোশাক-আশাকের বর্ণনা দিয়েছেন। তা থেকেই তাঁর হীন মানসিকতাই প্রমাণিত হয়। আর প্রথম আলোর মতো দায়িত্বশীল পত্রিকা পরিমলের জবানবন্দির ওই অংশটুকু, মেয়েটির পোশাকের উল্লেখ, কেন প্রকাশ করতে গেল, তা আমাদের বোধগম্য নয়! প্রথম আলোর কাছ থেকে এ আমরা আশা করি না।
অভিযোগ উঠেছে, ঘটনার পর ভিকারুননিসার অধ্যক্ষ হোসনে আরা বেগম এবং বসুন্ধরা দিবা শাখার প্রধান লুৎফর রহমান কোনো ব্যবস্থাই নেননি পরিমলের বিরুদ্ধে। উল্টো নিপীড়নের শিকার মেয়েটির পরিবারকে সামাজিক মান-মর্যাদাহানির ভয় দেখিয়ে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে পুরো বিষয়টি চেপে যেতে। আমাদের প্রশ্ন, এক পরিমলের কাছে নত হয়ে গেলেন ১৬ হাজার ছাত্রীর প্রধান অভিভাবক—অধ্যক্ষ হোসনে আরা বেগম? প্রয়োজন মনে করলেন না শিক্ষকদের পরামর্শ শোনারও? পরিমলের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার মৌখিক আশ্বাস দিয়েই হয়তো পরিস্থিতি শান্ত করা যেত, কিন্তু তিনি সেটাও করলেন না। কিসের ভয় ছিল অধ্যক্ষ হোসনে আরার? পরিমলের রাজনৈতিক যোগাযোগ তাঁর চেয়ে বেশি, এই ভয়? নাকি, এ ঘটনা জানাজানি হলে ভিকারুননিসার সুনাম নষ্ট হবে? তিনি যদি পরিমলকে অপসারণ করে তৎক্ষণাৎ আইনি ব্যবস্থা নিতেন, তাহলে তাঁর পেছনে থাকতেন স্কুল-কলেজ মিলিয়ে ১৬ হাজার ছাত্রী, কয়েক শ শিক্ষক এবং বর্তমানে নিজ নিজ ক্ষেত্রে সুপ্রতিষ্ঠিত প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা। তাহলে কিসের ভয়ে পিছিয়ে গেলেন তিনি?
অধ্যক্ষের এ অস্বচ্ছতা এবং দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতাই বিক্ষুব্ধ ও প্রতিবাদী করে তুলেছে ভিকারুননিসার কয়েক হাজার ছাত্রীকে।
পরিমল গ্রেপ্তার হওয়ার পর থেকে সবাই বলছেন, তিনি এখন পুলিশের হেফাজতে, বিচার তো হবেই। কঠিন শাস্তিও হয়ে যাবে। দুঃখিত, আমরা নিশ্চিত হতে পারছি না। বিচার শুরু হলেই নিপীড়নের শিকার মেয়েটির পরিবারের জন্য শুরু হবে কঠিন এক বাস্তবতা। সেই পরিস্থিতি মোকাবিলা করার মতো সাহস তাদের থাকবে, আমরা এটি স্রেফ আশাই করতে পারি। হয়তো পরিমলের খুঁটির জোর মেয়েটিকে আদালত পর্যন্ত আসতেই দেবে না। ঘটনাটি যেহেতু পুরোনো, একটু কলকাঠি নাড়া হলেই সাক্ষ্য-প্রমাণ ও আলামত দুর্বল হয়ে যাবে। ফলে শেষ পর্যন্ত তাঁর কী শাস্তি হবে, আদৌ কিছু হবে কি না, এ বিষয়ে আমাদের শঙ্কা যায় না। পরিমলের উপযুক্ত শাস্তি খুবই জরুরি। এ বিচার একটি দৃষ্টান্ত তৈরি করবে। আর যদি পরিমল আইনের ফাঁক গলে বেরিয়ে আসতে পারেন, তাহলে শুধু ভিকারুননিসা নয়, দেশের অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যেসব পরিমল সময় ও সুযোগের অপেক্ষায় ঘুমিয়ে আছেন, তাঁরা জেগে উঠতে শুরু করবেন। নৈরাজ্যের পথে তাহলে আর বাধা কোথায়?
অস্তিত্বের সংকট বা আত্মরক্ষার তাগিদ যা-ই হোক না কেন, পরিমলের ঘটনার পর প্রাক্তন ও বর্তমান ছাত্রীদের বড় দাবি ছিল অধ্যক্ষ হোসনে আরা বেগমের প্রস্থান। শেষ পর্যন্ত পুরো বিষয়টিই রূপ নিল রাজনৈতিক চেহারায়। ছাত্রীদের দাবির মুখে ভিকারুননিসার সঙ্গে যাঁর ৩৪ বছরের সম্পর্ক, সেই আম্বিয়া খাতুনকে নিয়োগ দেওয়া হলো ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে। তার ফল হলো এ রকম: পরের দিন ভিকারুননিসার বাইরের দেয়াল এবং বেইলি রোডজুড়ে পোস্টার লাগানো হলো, তাতে লেখা—‘আম্বিয়া খাতুন একজন মৌলবাদী’।
আম্বিয়া খাতুনের চাকরি আর বেশি দিন নেই, মাত্র কয়েক মাস পরই তাঁর অবসর নেওয়ার কথা। চাকরির মেয়াদ বাড়ানোর জন্য কোনো আবেদনও করেননি কখনো। এর আগে বিভিন্ন জটিল পরিস্থিতিতে তাঁকে অধ্যক্ষ হওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হলেও তিনি রাজি হননি। শেষ পর্যন্ত ছাত্রীদের চাপে যখন রাজি হলেন, টিকতে পারলেন না ২৪ ঘণ্টাও। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ পর্যন্ত এমন কিছু বক্তব্য দিলেন, যা থেকে বোঝা গেল তিনি হয় অনেক কিছু জানেন না, নয়তো রাজনৈতিক কারণে তাঁকে এসব বক্তব্য দিতে হচ্ছে। শিক্ষামন্ত্রীর সাম্প্রতিক নানা উদ্যোগ ও কর্মকাণ্ড এরই মধ্যে প্রশংসিত হয়েছে। ভিকারুননিসা ইস্যুতে তিনি যদি একটু কষ্ট করে ছাত্রী-অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলতেন কিংবা ফেসবুক বা ব্লগসাইটে চোখ বোলাতেন, তাহলে হয়তো অনেক কিছুই তাঁর কাছে স্পষ্ট হতো।
শেষ পর্যন্ত শিক্ষা মন্ত্রণালয় হোক আর শিক্ষা বোর্ডের হোক, হস্তক্ষেপ কিছুটা হয়েছে, যদিও সে হস্তক্ষেপও প্রশ্নবিদ্ধ। ছাত্রীদের আন্দোলন, হোসনে আরার অপসারণ, আম্বিয়া খাতুনের নিয়োগ, পরিচালনা পর্ষদের বিলুপ্তি—সব সিদ্ধান্তেই বড় বেশি সমন্বয় আর দূরদর্শিতার অভাব। একটু খুঁজলে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যও যেন খুঁজে পাওয়া যায়।
আমরা যারা ভিকারুননিসা থেকে অনেক আগেই পাস করে বের হয়ে গেছি, আমরা চাই, ভিকারুননিসার স্কুল ও কলেজের ভালো হোক। এই প্রতিষ্ঠানে স্থিতি ফিরে আসুক। এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঘিরে ছাত্রী ও অভিভাবকদের যে চাপ, তা হয়তো আরও বাড়বে ভবিষ্যতে। কিন্তু রাজনৈতিকীকরণ বা বাণিজ্যিকীকরণ চলতে থাকলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটিই ভেঙে পড়বে। অভিভাবকেরা তাঁদের মেয়েকে এখানে পড়াশোনা করতে পাঠান, কড়া রোদের মধ্যে রাস্তার ওপর অবস্থান নিয়ে আন্দোলন করার জন্য নয়।
লেখকেরা ভিকারুননিসা নূন স্কুল ও কলেজের প্রাক্তন শিক্ষার্থী।

No comments

Powered by Blogger.