স্মরণ-আলোর মশাল জ্বেলেছিলেন যিনি by সেলিনা খালেক

হেনা দাশ। তাঁকে আমরা জানতাম সব ধরনের আন্দোলন-সংগ্রামের প্রতীক হিসেবে। তিনি বহু গুণে গুণান্বিত ছিলেন। ছিলেন শিক্ষক ও নারীনেত্রী। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, চা-শ্রমিকদের আন্দোলন, কমিউনিস্ট আন্দোলন, শিক্ষক আন্দোলন, সর্বোপরি নারীমুক্তির আন্দোলনে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন।

কিন্তু আমার কাছে যেটা সবচেয়ে বড় গুণ বলে মনে হতো, সেটা তাঁর ধৈর্য ও পরমতসহিষ্ণুতা। বয়সের কারণে শেষের দিকে শারীরিকভাবে দুর্বল হলেও তিনি যখন বক্তব্য উপস্থাপন করতেন, তখন তাঁর গলার স্বরে গাম্ভীর্য ও তেজস্বিতা ফুটে উঠত। তাঁর সেই কণ্ঠ এখনো আমার কানে বাজে। মহিলা পরিষদের দীর্ঘ সভাগুলোয় তিনি বসে থাকতেন ধৈর্যসহকারে। সবার কথা শুনতেন, কারও কথার মাঝে কথা বলতেন না, কথা বললে পাশেরজনকেও বিরত করতেন। আমাদের বেশির ভাগ লোকের মধ্যেই পরমত ধৈর্যসহকারে শোনার প্রবণতার খুবই অভাব। যেকোনো বিষয়ে তাঁর ধারণা ছিল স্পষ্ট এবং তা তিনি জোরালোভাবে স্পষ্ট ভাষায় প্রকাশ করতে পারতেন। তিনি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ছাত্রী ছিলেন। শেষ বয়সে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বই লিখেছেন, যেখানে তাঁর জীবনের কথা এবং সেই সঙ্গে তখনকার সমাজ ও আন্দোলনের কথা ফুটে উঠেছে। তাঁর এসব বইয়ে প্রাসঙ্গিকভাবে মাহিলা পরিষদে যাঁরা কাজ করেছেন, করছেন, তাঁদের কথাও উঠে এসেছে।
এখন কিছু ব্যক্তিগত প্রসঙ্গে আসি। তাঁর সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় বা দেখা ১৯৬৪ সালে ময়মনসিংহে। সে সময় আমি নিখিল পাকিস্তান মহিলা সমিতি (এপিডব্লিউএ) ময়মনসিংহ শাখার সভানেত্রী ছিলাম। ‘এপিডব্লিউএ স্কুল’ নামে একটি ছোটদের স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলাম। সৌভাগ্যক্রমে স্কুলটি আজও শিক্ষার আলো জ্বেলে যাচ্ছে। তৎকালীন ডিসি পি এ নাজির স্কুল প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে আমাকে অনেক সহায়তা করেছিলেন। নদীর পারে পরিত্যক্ত এক রাজার বাড়িতে স্কুলটি ছিল। ওই স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা পদের জন্য খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছিল। স্কুল প্রাঙ্গণে প্রধান শিক্ষিকার বাসস্থানেরও ব্যবস্থা ছিল। সেই সূত্রে হেনা দাশ দরখাস্ত করে ইন্টারভিউর জন্য এসেছিলেন। সেই বোর্ডে ডিসি, আমি এবং বোধ হয় আরও দু-একজন ছিলাম। প্রথম দর্শনেই হেনা দাশকে আমার উপযুক্ত মনে হয়েছিল এবং পছন্দ হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁকে নিতে পারিনি। স্পষ্ট করে না বললেও বুঝতে পেরেছিলাম, তাঁকে না নেওয়ার পেছনে হয়তো দুটি কারণ ছিল। প্রথমত, তিনি কমিউনিস্ট ছিলেন এবং দ্বিতীয়ত, তাঁর ধর্ম। পাকিস্তান আমলে এই দুটি কারণ যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আমার মন খারাপ হয়েছিল, কিন্তু আমি একা কিছু করতে পারিনি।
এর কিছুদিন পর তাঁর সঙ্গে দেখা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে। আমরা দুজনই কয়েক বছর বিরতির পর বাংলা পড়তে গিয়েছিলাম প্রাইভেট ছাত্রী হিসেবে। তৎকালীন বাংলা বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল হাই। তিনি আমাদের ক্লাস করার অনুমতি দিয়েছিলেন। সেই সময় থেকেই হেনা দাশের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা। তখন মালেকা বেগম নিয়মিত ছাত্রী হিসেবে বাংলায় এমএ পড়ছিলেন। ওই সময় থেকেই মালেকার সঙ্গে আমার পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা হয়। যদিও আমরা তিনজন বলতে গেলে তিন প্রজন্মের। প্রত্যেকের সঙ্গে প্রত্যেকের বয়সের পার্থক্য ছিল প্রায় এক যুগের। কিন্তু বয়স বন্ধুত্বের পথে কোনো বাধা সৃষ্টি করতে পারেনি। আমি তাঁকে সব সময় হেনাদি এবং তিনি আমাকে সেলিনা আপা বলেই সম্বোধন করেছেন।
আমরা যখন পড়ছিলাম, তখন হেনা দাশ থাকতেন মহাখালীর একটি বাসায়। দুজনই প্রাইভেট ছাত্রী ছিলাম। কাজেই অনেক কিছু আলাপ-আলোচনা করতে হতো। আমি বহুবার তাঁর বাসায় গেছি এবং তিনিও আসতেন সিদ্ধেশ্বরীতে আমাদের বাসায়। নানা রকম অসুবিধা সত্ত্বেও আমাদের পরীক্ষার ফল ভালোই হয়েছিল। সেই সময় থেকেই যোগাযোগ ছিল।
আবার ১৯৭২ থেকে মহিলা পরিষদে যোগাযোগ। প্রথম দিকে তিনি নারায়ণগঞ্জ মহিলা পরিষদ ও কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভানেত্রী ছিলেন। পরবর্তী সময়ে তিনি পার্টি ও শিক্ষক সমিতির কাজে এত বেশি ব্যস্ত ছিলেন যে নিজেই মহিলা পরিষদ থেকে একটু দূরে সরে গিয়েছিলেন। আগে মহিলা পরিষদে বিষয় নির্বাচনী কমিটি ছিল। সেখানে কমিটির সদস্যদের নাম ঠিক করে কাউন্সিল ও সম্মেলনে পেশ করা হতো। বেশ কয়েকবার এই বিষয় নির্বাচনী কমিটির আমি আহ্বায়ক ছিলাম। আমার যত দূর মনে পড়ে, নব্বইয়ের দশকে সেখানে সহসভানেত্রী পদে আমি তাঁর নাম প্রস্তাব করি এবং তা গৃহীত হয়। বেগম সুফিয়া কামালের মৃত্যুর পর তিনি সভানেত্রী নির্বাচিত হন, এক মেয়াদের জন্য। কিন্তু দেশের নানা পরিস্থিতির কারণে সম্মেলন করতে দেরি হওয়ায় তিনি প্রায় সাত বছর সভানেত্রী ছিলেন। তিনি দক্ষতার সঙ্গে মহিলা পরিষদকে পরিচালনা করেছেন। হেনা দাশ আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু তাঁর কর্মসাধনা ও শিক্ষা আমাদের প্রেরণা হয়ে থাকবে।
আজ ২০ জুলাই হেনা দাশের মৃত্যু দিবস। তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করছি।
সেলিনা খালেক
উপদেষ্টা, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ।

No comments

Powered by Blogger.