মিডিয়া ভাবনা-দলীয়করণের কবলে রাষ্ট্রায়ত্ত গণমাধ্যম by মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর

প্রতিবছরের মতো এ বছরও মিডিয়া বিষয়ে এশীয় দেশগুলোর একটা বড় সম্মেলন হয়ে গেল ভারতের হায়দরাবাদে। ‘এশিয়ান মিডিয়া ইনফরমেশন অ্যান্ড কমিউনিকেশন সেন্টার’ (‘অ্যামিক’ নামে বহুল পরিচিত, সিঙ্গাপুরে অফিস) আয়োজিত এ সম্মেলনে এশিয়ার বিভিন্ন দেশের সাংবাদিক, মিডিয়া বিশেষজ্ঞ, শিক্ষক, গবেষক, তথ্যপ্রযুক্তি কর্মকর্তা,

মিডিয়া-সম্পর্কিত নানা পেশার কর্মকর্তাসহ প্রধান নির্বাহীরা অংশ নেন। কয়েক বছর থেকে সীমিতসংখ্যক ছাত্রছাত্রীও অংশ নিচ্ছেন। তরুণদের নিয়ে একটা ‘ইয়াং অ্যামিক’ গড়ে তোলার কর্মসূচিও রয়েছে। মোটকথা, অ্যামিকের এই বার্ষিক সম্মেলন মিডিয়া-জগতের লোকজনের জন্য এক মহা ভোজ। এই ভোজ শুধু খাওয়ার ভোজ নয়, এটা চিন্তা ও জ্ঞানের ভোজ। এশিয়ার নানা দেশে মিডিয়া-জগতে কী কী অগ্রগতি ঘটছে, এখন প্রধান মিডিয়া ইস্যু কী কী, মিডিয়ার সামনে কী চ্যালেঞ্জ, তা নানা অধিবেশনে বক্তারা আলোচনার মাধ্যমে তুলে ধরেন। অ্যামিক সম্মেলন প্রধানত এশিয়া অঞ্চলের হলেও ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া থেকেও অনেকে অংশ নেন। তবে বলা বাহুল্য, এশীয় অঞ্চলেরই ইস্যু বা সমস্যাগুলো এতে আলোচিত হয়।
আমি চেষ্টা করি, অ্যামিক সম্মেলনে অংশ নিতে। আমার সৌভাগ্য, এ বছর আমি একটি সেশনে বক্তা হিসেবে আমন্ত্রিত হয়েছিলাম। আরও কয়েকজন অধ্যাপক ও টিভি কর্মকর্তা বাংলাদেশ থেকে আমন্ত্রিত হয়েছিলেন। একজন যেতে পারেননি। আমরা তিনজন সম্মেলনে বাংলাদেশকে অনানুষ্ঠানিক প্রতিনিধিত্ব করেছি। অন্য দেশের তুলনায় খুবই অনুল্লেখ্য প্রতিনিধিত্ব। বাংলাদেশ যে জ্ঞান-বিজ্ঞানেও দরিদ্র, সেটা অ্যামিক সম্মেলনে গিয়ে আমি ভালোভাবে অনুভব করি। আর মিডিয়ার বিশাল জগতে জ্ঞান ও তথ্যভান্ডারে আমি যে একজন অতি ক্ষুদ্র ব্যক্তি, তাও অ্যামিক সম্মেলনে গেলে বুঝতে পারি।
গত ২৪-২৭ জুন হায়দরাবাদের একটি পাঁচতারা হোটেলে আয়োজিত এ সম্মেলনে মিডিয়ার কত বিচিত্র বিষয় নিয়ে যে আলোচনা হয়েছে, তা স্থানাভাবে এ নিবন্ধে প্রকাশ করা সম্ভব হবে না। তবে আগ্রহী পাঠক, সাংবাদিক, শিক্ষক, গবেষক, গণমাধ্যমের কর্মী ও ছাত্রছাত্রীদের কৌতূহল মেটানোর জন্য আমি শুধু বিভিন্ন অধিবেশনের মূল শিরোনামগুলো এখানে তুলে ধরছি—১) দি ওয়েস্ট অ্যান্ড দ্য রেস্ট: মিডিয়া অ্যান্ড সফট পাওয়ার ইন এ ডিজিটাল এইজ, ২) আন্ডারস্ট্যান্ডিং দ্য ‘ডিজিলোগ’ মিডিয়া ল্যান্ডস্কেপ, ৩) ক্রিটিক্যাল ইস্যুজ ইন কমিউনিকেশন: লুকিং ইনওয়ার্ড ফর আনসারস, ৪) বিয়ন্ড মডার্নাইজেশন: চায়নিজ মিডিয়া অ্যান্ড দ্য সোসাইটি ইন দ্য ডিজিটাল এইজ, ৫) দ্য রোলস অব মিডিয়া অ্যান্ড কমিউনিকেশন সেক্টরস ইন রেইজিং অ্যাওয়ারনেস অব ডেভেলপমেন্ট ইস্যুজ, ৬) জেন্ডার অ্যান্ড দি এনভায়রনমেন্ট ফ্রেমড ইন মুম্বাইস প্রিন্ট মিডিয়া, ৭) ইন্টারনেট কমিউনিকেশন, ৮) দ্য ফিউচার অব ম্যাস মিডিয়া এডুকেশন ইন এশিয়া প্যাসিফিক, ৯) দ্য ডিসিপ্লিন অ্যান্ড কমিউনিকেশন, ১০) অনলাইন জার্নালিজম, ১১) মিডিয়া অ্যান্ড সোশ্যাল রেসপনসিবিলিটি, ১২) নিউ মিডিয়া, ১৩) জার্নালিজম অ্যান্ড দ্য প্রফেশন, ১৩) মিডিয়া অ্যান্ড জেন্ডার, ১৪) মিডিয়া অ্যান্ড রিলিজিয়ন, ১৫) মাল্টিমিডিয়া স্টোরি টেলিং ওয়ার্কশপ, ১৬) মিডিয়া অ্যান্ড স্পোর্টস, ১৭) কমিউনিটি রেডিও, ১৮) ইন্ডিয়ান সিনেমা, ১৯) জার্নালিজম এডুকেশন, ২০) মিডিয়া অ্যান্ড স্টুডেন্টস, ২১) মিডিয়া এইজ টুলস ফর চেইঞ্জ, ২২) মিডিয়া থিওরি, পলিসি অ্যান্ড রিসার্চ মেথডোলজি, ২৩) অ্যাডভারটাইজিং, ২৪) ফিল্ম অ্যানালাইসিস, ২৪) জেন্ডার স্টাডিজ, ২৫) আইডেন্টিটি, ২৬) সোশ্যাল মিডিয়া, ক্রিটিক্যাল অ্যানালাইসিস, ২৭) হেলথ কমিউনিকেশন, ২৮) মোবাইল কমিউনিকেশন, ২৯) চিলড্রেন অ্যান্ড ইয়ুথ, ৩০) মিডিয়া অ্যান্ড সোসাইটি, ৩১) টেলিভিশন, ৩২) সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং অ্যান্ড ইয়ুথ, ৩৩) গ্লোবালাইজেশন, ৩৪) ক্যাম্পেইন কমিউনিকেশন, ৩৫) ব্লগিং অ্যান্ড আইসিটি, ৩৬) ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড কমিউনিকেশন, ৩৭) হেলথ কমিউনিকেশন, ৩৮) ট্র্যাডিশনাল মিডিয়া ভার্সাস নিউ মিডিয়া, ৩৯) জার্নালিজম অ্যান্ড প্রিন্ট মিডিয়া, ৪০) টেলিভিশন ম্যানেজমেন্ট, পলিসি অ্যান্ড রেগুলেশন।
হোটেলের বিভিন্ন কক্ষে একই সঙ্গে পাঁচ-ছয়টি অধিবেশন চলেছে। যার যে বিষয়ে আগ্রহ, তিনি সেই অধিবেশনে যোগ দিয়েছেন। এসব অধিবেশন ছাড়াও এবারের অ্যামিক সম্মেলনে ‘পাবলিক সার্ভিস ব্রডকাস্টিং’ বিষয়ে অ্যামিক ও ইউনেসকো যৌথভাবে দিনব্যাপী তিনটি অধিবেশনে একটি কলোকিয়ামের আয়োজন করেছিল। এই কলোকিয়ামে আলোচনায় অংশ নেওয়ার সুযোগ হয়েছিল আমার।
সম্মেলনের দুটি অধিবেশনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক ফাহমিদুল হক এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ অংশ নেন। ‘বাংলাদেশ টেলিভিশন’ চট্টগ্রাম কেন্দ্রের একজন প্রযোজকও আমন্ত্রিত হয়েছিলেন, কিন্তু তিনি যেতে পারেননি।
সম্মেলনের বিভিন্ন অধিবেশনের মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনের পাশাপাশি প্যানেল আলোচনা ও প্রশ্নোত্তর ছিল। প্রশ্নোত্তর পর্যায়ে বিভিন্ন অধিবেশনে জোর বিতর্কও অনুষ্ঠিত হয়।
পাবলিক সার্ভিস ব্রডকাস্টিং: পাবলিক সার্ভিস ব্রডকাস্টিং বিষয়ে দিনব্যাপী আলোচনায় এশিয়ার বিভিন্ন দেশে পাবলিক সার্ভিস ব্রডকাস্টিংয়ে যে দুরবস্থা বিরাজ করছে, তা আলোচিত হয়। প্রাইভেট সেক্টরের নানা বর্ণাঢ্য বিনোদন চ্যানেলের পাশে জনহিতকর বার্তা বা অনুষ্ঠান যে দর্শক টানতে পারছে না, তা সবাই স্বীকার করেন। নেপালের এক বক্তা বলেছেন, বিনোদন ও পাবলিক সার্ভিসের মিশেল দিয়ে এক ধরনের পাবলিক সার্ভিস অনুষ্ঠান এখন নানা দেশে তৈরি হচ্ছে। থাইল্যান্ডের এক বক্তা বলেছেন, দর্শকদের সচেতন ও সংঘবদ্ধ হতে হবে। তিনি থাইল্যান্ডে ‘পাবলিক সিটিজেন গ্রুপ’ ও ‘অডিয়েন্স কাউন্সিল’ গড়ে তোলার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে পাবলিক সার্ভিস ব্রডকাস্টিংয়ের (বিটিভি) আদর্শ যে সংকীর্ণ দলীয় রাজনীতি ও সরকারি প্রপাগান্ডার চাপে হারিয়ে যাচ্ছে, সেই অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছিলাম আমি।
প্রায় সব বক্তাই একমত হয়েছেন, সরকারের কমিটমেন্ট না থাকলে কোনো দেশেই পাবলিক সার্ভিস ব্রডকাস্টিং বিকশিত হতে পারবে না। ‘বিবিসি’ পাবলিক সার্ভিস ব্রডকাস্টিংয়ের বড় উদাহরণ হলেও এখন বিবিসির ফান্ডেও টান পড়েছে। তা ছাড়া কোনো এশীয় দেশের সরকার বিবিসির নীতি ও আদর্শ দ্বারা টিভি বা রেডিও চ্যানেল চালাতে রাজি হবে না। একতরফাভাবে টাকা বিনিয়োগ করতে কোনো সরকারই আগ্রহী নয়। আর বিজ্ঞাপন বা স্পন্সরের ওপর নির্ভরশীল হলে কোনো পাবলিক সার্ভিস চ্যানেল জনগণের হিতার্থে অনুষ্ঠান প্রচার করতে পারবে না।
‘মাই বাপ সিনড্রোম’: কলোকিয়ামের এক অধিবেশনে ভারতের একজন মিডিয়া বিশেষজ্ঞ বলেছেন, এশিয়ার পাবলিক সার্ভিস ব্রডকাস্টিং প্রতিষ্ঠানগুলোর বড় দুর্বলতা হলো, তারা সব সময় সরকারের দিকে তাকিয়ে থাকে। সরকারই তাদের মা-বাপ। এটাকে তিনি ‘মাই বাপ সিনড্রোম’ বলেছেন। তিনি বলেন, মাই বাপ সিনড্রোম থেকে বের হতে না পারলে ‘পাবলিক সার্ভিস ব্রডকাস্টিং’ কার্যকর কিছু করতে পারবে না।
মিডিয়া ও বাংলাদেশ: বাংলাদেশে মিডিয়া এখন বেশ বড় একটা জগ ৎ । অনেক পেশাদার শিক্ষিত ব্যক্তি এ পেশায় যোগ দিয়েছেন। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ হয়েছে। অথচ বাংলাদেশের মিডিয়া-জগ ৎ নিয়ে গবেষণা, আলোচনা, বিতর্ক হয় না বললেই চলে। একাডেমিক প্রবন্ধ রচনাও হয় খুব কম। দর্শক-পাঠক-শ্রোতা মতামত জরিপও কম দেখা যায়। এ ব্যাপারে মিডিয়া-জগতে কতটা চাহিদা রয়েছে, তাও খুব স্পষ্ট নয়। অবশ্য এসব কাজ নিয়মিত হতে থাকলে চাহিদা সৃষ্টি হয়। মাঝেমধ্যে কিছু ভালো উদ্যোগ দেখা গেছে। যেমন, ‘বাংলাদেশ জার্নালিজম রিভিউ’ নামে একটি জার্নাল প্রকাশ করেছিল বিসিডিজিসি। এখন বন্ধ হয়ে গেছে। মিডিয়া ওয়াচও অনিয়মিত। যোগাযোগ নামে একটি অনিয়মিত জার্নাল, মাধ্যম নামে একটি ত্রৈমাসিক এবং পিআইবির ত্রৈমাসিক নিরীক্ষা কিছুটা চাহিদা পূরণ করছে। বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট উন্নত মানের জার্নাল প্রকাশ, মিডিয়ার নানা ইস্যু নিয়ে নিয়মিত আলোচনা, বার্ষিক বা দ্বিবার্ষিক মিডিয়া সম্মেলনের আয়োজন করতে পারত। পিআইবির সেই সামর্থ্য ছিল। এখন দলীয়করণের চাপে প্রতিষ্ঠানটি এসব কাজে আর মনোযোগ দিতে পারছে না। তা ছাড়া দলনিরপেক্ষভাবে মিডিয়ার কর্মত ৎ পরতা মূল্যায়ন করাও পিআইবির পক্ষে এখন আর সম্ভব নয়। তথ্য মন্ত্রণালয় ও দলীয় মুরব্বিদের সন্তুষ্ট রাখাই এখন পিআইবি কর্তৃপক্ষের প্রধান দায়িত্ব হয়ে পড়েছে।
অন্যান্য মিডিয়া এনজিও বা ফোরামও নানা কাজ করতে পারত। কিন্তু ফান্ড ও ক্রেডিবিলিটির অভাব তাদের কাজের পথে বড় বাধা। বিভিন্ন মিডিয়া প্রতিষ্ঠানে উপযুক্ত নেতৃত্বেরও অভাব রয়েছে। দক্ষ নেতৃত্ব ছাড়া বড় বড় কর্মসূচির আয়োজন করা সম্ভব হয় না। আমাদের দেশে একাডেমিক কাজকেও দলীয়করণ বা সরকারীকরণের একটা প্রবণতা দেখা যায়, যা অনেক সময় বড় ও ভালো কাজের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। হায়দরাবাদে অ্যামিক সম্মেলনে সরকারি কোনো মন্ত্রী বা সচিব আমন্ত্রিত হননি। জমকালো কোনো উদ্বোধনী অনুষ্ঠানও ছিল না। আমাদের দেশে কিছু করতে হলে মন্ত্রী, সচিব, এমপি ছাড়া আমরা ভাবতে পারি না। দূষিত এ সংস্কৃতি থেকে আমরা কবে মুক্তি পাব, জানি না।
শিক্ষাবিদ ও মিডিয়া গবেষক গোলাম রহমান বাংলাদেশের ‘অ্যামিক প্রতিনিধি’ মনোনীত হয়েছেন। তাঁকে অভিনন্দন জানাই।
মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর: মিডিয়া ও উন্নয়নকর্মী।

No comments

Powered by Blogger.