কুড়িয়ে পাওয়া সংলাপ-দগ্ধজনার স্বপ্নকথা by রণজিৎ বিশ্বাস

: পনার কিছু স্বপ্নের কথা বলুন। : আমার স্বপ্ন খুব বেশি নেই। আমি, তার পরও, আমার স্বপ্নের সব কথা বলব না।
যদি বলতেই হয়, আমি আমার সবচেয়ে বড় স্বপ্নটির কথা বলব। আপনার এই স্বপ্নটি যদি পূরণ হয়, ছোট ছোট অনেক স্বপ্ন পূরণের পথে তাকে অনুসরণ করবে। : সেই স্বপ্নটি কোন স্বপ্ন? : আমার দেশের সব মানুষের ওজন এক পাল্লায় হবে এবং সে পাল্লার কাঁটায় কোনো জারিজুরি ও চালাকি থাকবে না। আমার দেশের কোনো মানুষের মধ্যে দ্বিতীয়


শ্রেণীর নাগরিকের হীনম্মন্যতাবোধ থাকবে না এবং কেউ তাদের দিকে দৃশ্যমান অথবা অদৃশ্য অঙ্গুলি নির্দেশ করে বলবে না_ও ব্যাটা অত ফটরফটর করে কী হবে, আসলে তো সে সেকেন্ড ক্লাস সিটিজেন! আমার সবচেয়ে বড় স্বপ্নের গুরুত্বপূর্ণ কিছু অংশ হচ্ছে_আমার দেশে সব মানুষ স্বতঃস্ফূর্ততা ও আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে ভাবতে পারবে_ধূলিপরে ও আকাশতলে বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দর এ দেশের ১৫ কোটি ভাগের (যখন যত কোটি প্রযোজ্য) এক ভাগের নিষ্কণ্টক মালিকানা আমার।
আমার দেশে সব জায়গায় সব সোপানের অভিভাবকদের দুই চোখের দৃষ্টি সমান থাকবে এবং সব পরিচালক, অভিভাবক, শিক্ষক, পোষক-পৃষ্ঠপোষক ও মত্যপ্রতিপালকরা বিশ্বাস করবে_মানুষের প্রথম, শেষ ও সর্বসেরা পরিচয় সে মানুষ। তারা নিজেরা দেশের মানুষের জন্য কোনো দুর্যোগ সৃষ্টি করবে না এবং মানবসৃষ্ট কোনো দুর্যোগকে প্রশ্রয় দেবে না।
মানুষকে প্রাপ্যবঞ্চিত ও অনুগ্রহসিক্ত করার সময় তারা কারো পিঠে কিংবা বুকে 'তাহাদের লোক' ও 'আমাদের লোক' এর লেবেল লাগাবে না। আমার স্বপ্নভুক্ত বিষয় হবে_অভিভাবক ও পরিচালকরা কখনো ভেদবুদ্ধিসম্পন্ন, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শবিরোধী ও সাম্প্রদায়িক মানুষ হবে না, তেমন মানুষের পৃষ্ঠপোষকতা করবে না ও তাদের পক্ষপুটে আশ্রয় নেবে না।
আমি স্বপ্ন দেখি, আমার ছাত্র, আমার পুত্র, আমার কন্যা, আমার ভ্রাতা, আমার শিক্ষক, আমার সহকর্মী, আমার প্রতিবেশী এবং আমার সন্তানের বন্ধুজনরা কখনো ধর্মান্ধ হবে না, মৌলবাদী কীটদের দ্বারা কখনো ধৌতমস্তিষ্ক হবে না। আমার স্বপ্ন, আমার দেশের মানুষ দেশের অর্থ বিদেশে পাচার করবে না, পাচার করার পর 'আমি কিছুই করিনি' বলে প্রচার করবে না এবং কোনো ব্যবহারজীবী কোনো কিছুর বিনিময়ে এমন প্রাণীকে বাঁচানোর কাজে ব্যবহৃত হবে না।
আমার স্বপ্ন, আমার দেশে শিক্ষা, সততা, সুরুচি, সাধুতা, উদারতা, নিরপেক্ষতা ও অসাম্প্রদায়িকতার কদর হবে। আমার স্বপ্ন, আমার দেশের বর্ষবরণ, বর্ষবিদায়, বর্ষাবরণ, নবান্ন, বসন্তবরণ, বসন্তবিদায়, পৌষমেলা ইত্যাদি ধর্মনিরপেক্ষ ও বিশ্বাসনিরপেক্ষ আয়োজন বেশি বেশি হবে; আমার দেশের ঈদুল ফিতর, ঈদুল আজহা, শবেবরাত, মিলাদুন্নবী, দুর্গাপূজা, বিজয়া দশমী, জন্মাষ্টমী, বৈশাখী পূর্ণিমা, প্রবারণা পূর্ণিমা, বড়দিন ও ইস্টারের আনন্দ আমাদের সবার হবে এবং যতই ক্ষুদ্র হোক আমার এই পবিত্র দেশের কোনো অংশ স্বাধীনতা দিবসে, শহীদ দিবসে, শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে, জাতীয় শোক দিবসে ও বিজয় দিবসে শহীদদের শ্রদ্ধা জানানো ও আনন্দ প্রকাশের পরিবর্তে কুনোব্যাঙ কিংবা কালোতেই ভালো থাকা, প্রাণী পেঁচকের মতো মড়কলাগা নরকবাড়ির আঁধার ঘরে পড়ে থাকবে না।
: আর মাত্র চারটি বাক্যে আপনি শেষ করুন।
: আমি তার অর্ধেকে আমার কথা শেষ করব।
ভাবছি আমার দেশে সেদিন কবে আসবে যেদিন শিক্ষকরা নিজে বুঝবেন এবং তাঁদের সন্তান ও শিক্ষার্থীদের সবার আগে বোঝাবেন কেন 'পশুপক্ষী সহজেই পশুপক্ষী, তরুলতা সহজেই তরুলতা, মানুষ_অনেক চেষ্টার পরে সে মানুষ'; কেন মানুষকে বারবার জন্মগ্রহণ করতে হয় অথবা নিজের জন্য জন্মগ্রহণ ও মানুষের জন্য জন্মগ্রহণের তফাত কী। ঘরে ঘরে সব পিতামাতা তাঁদের সন্তান, পাল্য ও পোষ্যদের লাইন ধরে ধরে বোঝাবেন আর মুখস্থ করাবেন_'গাহি সাম্যের গান/মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই নহে কিছু মহীয়ান।/নাই দেশকালপাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্মজাতি।/সব দেশে সবকালে ঘরে ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি।... হায়রে ভজনালয়/ তোমার মিনারে চড়িয়া ভণ্ড গাহে স্বার্থের জয়।/মানুষেরে ঘৃণা করি/ও কারা কোরান বেদ বাইবেল চুম্বিছে মরিমরি!/ ও মুখ হইতে গ্রন্থ কেতাব নাও জোর করে কেড়ে।/যাহারা আনিল গ্রন্থকেতাব সেই মানুষেরে মেরে।/পূজিছে গ্রন্থ ভণ্ডের দল, ধর্মান্ধরা শোনো।/মানুষ এনেছে গ্রন্থ, গ্রন্থ আনেনি মানুষ কোনো।' 'মানুষ' : কাজী নজরুল ইসলাম।

লেখক : কথাসাহিত্যিক, বেইজিং, গণচীন।

No comments

Powered by Blogger.