নির্মম নির্যাতন-পড়াশোনাও কি অপরাধ?

বরোধবাসিনীদের মুক্তির স্বপ্ন ও সংগ্রামের কথা রচনাবলিতে লিখে গিয়েছিলেন বেগম রোকেয়া। রোকেয়ার মৃত্যুর ৭৯ বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর অবরোধবাসিনী অনেকেই মুক্তি পেয়েছেন বটে, কিন্তু এখনও অনেকেই গৃহকোণের তীব্র অন্ধকার থেকে আলোর পৃথিবীতে আত্মপ্রকাশ করতে পারেনি। এ সত্য মেনে নিয়েও কিছু অগ্রগতি ও অর্জনের কথা এ দেশের মানুষ গর্বভরে উচ্চারণ করে। সে অর্জনগুলোর অন্যতম নারী শিক্ষা। অনুন্নত অর্থনীতির সীমিত সামর্থ্য,


পশ্চাৎপদ সামাজিক কাঠামো, পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির আধিপত্য সত্ত্বেও বাংলাদেশের নারীরা শিক্ষাক্ষেত্রে যতটা এগিয়ে আসতে পেরেছে তা অবিস্মরণীয়। এই অগ্রগতির পেছনে নারী শিক্ষার জন্য সরকারি পদক্ষেপের ভূমিকা আছে যেমন, তেমনি সমাজের বৃহত্তর অংশে এ উপলব্ধি এসেছে যে, সমাজ-রাষ্ট্রের সকল ক্ষেত্রে নারীর সমান অংশগ্রহণ ছাড়া উন্নয়ন ও উৎপাদনে আমাদের পশ্চাৎপদতা কাটবে না। সবচেয়ে বড় কথা, ছোট-বড় বাধা অতিক্রম করে নারীরা শিক্ষার প্রতি আগ্রহী হয়েছেন। অনেককেই রীতিমতো সংগ্রাম করে আত্মপ্রতিষ্ঠা করতে হয়েছে। এ সংগ্রামের ফল অভূতপূর্ব। আজ যখন বিপুলসংখ্যক নারী শিক্ষাঙ্গনগুলোতে যায় তখন তা গর্বের বিষয় হয়ে ওঠে সকলের জন্য। পাবলিক পরীক্ষায় যখন মেয়েরা ভালো ফল করে, মেয়েদের স্কুলগুলো এগিয়ে থাকে তখন এ কথাও প্রমাণিত হয়, মেধা, প্রতিভা ও পরিশ্রমে আমাদের মেয়েরা কম তো নয়ই, কোথাও কোথাও বেশি যোগ্য। শুধু শিক্ষাক্ষেত্রেই নয়, দেশের প্রধান রফতানি খাত পোশাক শিল্পে অংশ নিয়ে নারীরা যে সামাজিক রূপান্তর ঘটিয়ে চলেছে তার তুলনাও কি এ দেশে আর আছে? কিন্তু এ অর্জনগুলোর সঙ্গে মাখামাখি হয়ে আছে অনেক লজ্জা ও বেদনাদায়ক ঘটনাও। সমাজের পশ্চাৎপদ পুরুষতান্ত্রিক মনোভাবের পাশাপাশি নারীকে যুদ্ধ করতে হচ্ছে স্কুলের গেটে দাঁড়ানো বখাটের সঙ্গে, পাড়ার নির্যাতক-নিপীড়কদের সঙ্গে। এমনকি পরম নিরাপদ গৃহকোণেও নির্যাতনের অন্ত নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, উচ্চ আয়ের চাকরিজীবী নারীরাও রেহাই পাচ্ছে না। ফলে ঘরে-বাইরে নারীর সংগ্রাম অন্তহীন_ এর যেন শেষ নেই। এ সংগ্রামের তালিকায় যুক্ত হলো নরসিংদীর মেয়ে জুঁইয়ের নাম। স্বামীর দ্বিমত সত্ত্বেও লেখাপড়া চালিয়ে যাচ্ছিলেন জুঁই। কলেজে উঠেছিলেন অনেক কষ্ট করে। কিন্তু অল্পশিক্ষিত স্বামী স্ত্রীর এই উত্থান মেনে নিতে পারছিল না। বিদেশে থাকলেও সেখান থেকে নানাভাবে তাকে চাপ দিয়ে যাচ্ছিল পড়াশোনা ছেড়ে দেওয়ার নির্দেশ জারি করে। জুঁই সে কথায় কর্ণপাত করেননি। শেষ পর্যন্ত লেখাপড়া চালানোই তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়াল। বিদেশ-ফেরত স্বামী তাকে ঘরে আটকে, চোখ বেঁধে কেটে নিল ডান হাতের পাঁচটি আঙুল। ভয়াবহ ও নৃশংস এ ঘটনা। পড়াশোনার অপরাধে একজন নারীকে এমন অত্যাচার ভোগ করতে হবে এ যেন অভাবনীয়। কিন্তু অভাবনীয় হলেও এমন ঘটনাই ঘটল। লেখাপড়ার জন্য সবচেয়ে প্রয়োজনীয় যে আঙুল সেগুলো হারাতে হলো জুঁইকে। আর হয়তো কখনও হাতে কলম তুলে লিখতে পারবেন না তিনি, পাতা উল্টিয়ে পড়তে পারবেন না বই। হয়তো এই ভয়াবহ ঘটনায় মনোবল হারিয়ে ফেলবেন। কিন্তু আমরা আশা করি, শত নির্যাতনেও অদম্য থাকুক জুঁইরা। অগ্রগতির পথ কণ্টকাকীর্ণ হলেও তারা এগিয়ে যাক। তারও চেয়ে বড় কথা, শুধু লেখাপড়া করার অপরাধে যে ঠাণ্ডা মাথায় অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে জঘন্য এ অত্যাচারের ঘটনা ঘটাল তাকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হোক।

No comments

Powered by Blogger.