স্বাধীনতা-আমাদের মুক্তির লড়াই by বাঙালি শামসুর রহমান

দুর্নীতির রাহুগ্রাস, মৌলবাদের আগ্রাসন, শিক্ষা ব্যবস্থা যুগোপযোগী না হওয়া, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অবক্ষয়, বিশেষ শ্রেণী কর্তৃক সম্পদ কুক্ষিগত করার সর্বনাশী প্রবণতা আমাদের বারবার ব্যর্থতার আঁস্তাকুড়ে নিক্ষেপ করেছেস্বপ্নের স্বাধীনতা অর্জনের ৪০ বছর পরও কিছু প্রশ্ন মনের জানালায় খেলা করে_ কেন এই যুদ্ধ? কাদের জন্য এই অর্জন? কী ছিল আমাদের প্রত্যাশা? প্রত্যাশা আর প্রাপ্তির সমন্বয় বা বন্ধন আদৌ ঘটেছে কি? মুক্তিযুদ্ধ বা বিজয়কে
ঘিরে আমাদের প্রত্যাশা অনেক। যুদ্ধের ময়দানে জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেছিলাম শোষণ-বঞ্চনা আর অপ্রাপ্তির হিসাবগুলো মেলাতে। ৫৪'র যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন, ৬৬'র ছয় দফা ও ১১ দফা, ৬৯'র গণঅভ্যুত্থান, ৭০-এর নির্বাচন এবং সবকিছু ছাপিয়ে একটি জাতির মুক্তি ও স্বপ্নদ্রষ্টা হিসেবে অসাধারণ সাহসিকতা আর বলিষ্ঠতা নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আত্মপ্রকাশ। ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে এক উত্তাল জনসমুদ্রের সম্মুখে তার কঠিন দৃপ্ত উচ্চারণ_
'এবারের সংগ্রাম_ আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।'
একটি স্বাধীন জাতিসত্তা, শোষণমুক্ত একটি সামাজিক ব্যবস্থা, অসাম্প্রদায়িক চেতনা, অর্থনৈতিক মুক্তি, বৈষম্যহীন শিক্ষা ব্যবস্থা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষায় উন্নত একটি জাতির অস্তিত্ব নিশ্চিত করাই ছিল আমাদের লক্ষ্য ও প্রত্যাশা। দেশের প্রতিটি মানুষের অভিন্ন স্বপ্ন ও প্রত্যাশা যখন কেন্দ্রীভূত হয় একই বিন্দুতে, তখনই ইতিহাসের অমোঘ নিয়মে বিজয় হয়ে ওঠে অবশ্যম্ভাবী। এর ব্যত্যয় ঘটেনি আমাদের ক্ষেত্রেও।
আবেগীয় দৃষ্টিতে আমাদের প্রাপ্তি নেহাত সামান্য নয়_ একটি স্বাধীন ভূখণ্ড, স্বাধীন জাতিসত্তা, নিজস্ব মানচিত্র, ভাষা ও সংস্কৃতি। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আমাদের প্রত্যাশাগুলো হোঁটচ খেয়েছে বারবার। শুরুতেই কিছু সুবিধাভোগী, পথভ্রষ্ট সামরিক বাহিনীর সদস্য কর্তৃক স্বাধীনতার স্থপতি, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নির্মমভাবে সপরিবারে নিহত হয়েছেন। তার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে খসে পড়েছিল সংবিধানের দুটি স্তম্ভ সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। এর মাধ্যমেই নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল আমাদের পশ্চাৎপদতা। এরপর শুরু হয় খুন, হত্যা, ষড়যন্ত্র আর সামরিক হস্তক্ষেপ, ইতিহাসবিকৃতির চরম ধৃষ্টতা এবং জাতির নিজস্বতাকে ভূলুণ্ঠিত করে সামাজিক বৈষম্য আর ধনতান্ত্রিকতাকে উসকে দেওয়ার ইতিহাস। যার ফলে আমাদের অসাম্প্রদায়িক চেতনা, নিজস্ব সংস্কৃতির ধারা, অর্থনৈতিক মুক্তি কিংবা বৈষম্যহীন শিক্ষা ব্যবস্থা আজও আমাদের কাছে
শুধুই স্বপ্ন।
১৯৯১ সালে গণতন্ত্রের যাত্রা শুরু হলেও নানা কারণেই আমরা অভীষ্ট লক্ষ্যে পেঁৗছতে পারিনি। দুর্নীতির রাহুগ্রাস, মৌলবাদের আগ্রাসন, শিক্ষা ব্যবস্থা যুগোপযোগী না হওয়া, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অবক্ষয়, বিশেষ শ্রেণী কর্তৃক সম্পদ কুক্ষিগত করার সর্বনাশী প্রবণতা আমাদের বারবার ব্যর্থতার আঁস্তাকুড়ে নিক্ষেপ করেছে। রাজনৈতিক সদিচ্ছাও এ ক্ষেত্রে প্রশ্নবিদ্ধ। স্বাধীনতার ৪০ বছরের ক্লান্তিকর ব্যর্থ পথ পেরিয়ে জাতির প্রত্যাশা এক স্বনির্ভর প্রত্যয়ী বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার। যে প্রত্যাশা ও স্বপ্ন নিয়ে এ দেশ স্বাধীন করার জন্য ৩০ লাখ শহীদ জীবন দান করেছিল, দুই লাখ মা-বোন সম্ভ্রম হারিয়েছিল, লাখো মা তাদের বুকের ধন দেশমাতৃকার সংকটে বলিদান করেছিল; সেই আত্মত্যাগের ঋণ এ দেশ আজও শোধ করতে পারেনি। বুক খালি হওয়া মায়ের হাহাকার আজও থামেনি। সুজলা-সুফলা সোনার বাংলা এখনও লুটেরা, হানাদারদের পোড়া ও ক্ষতচিহ্ন বয়ে বেড়াচ্ছে।
বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার একটি পদক্ষেপ হাতে নিয়েছে, যা ইতিহাসবিকৃতির চলমান ধারাকে হ্রাস করবে। শিক্ষানীতি-২০১০ প্রণয়ন শিক্ষার চলমান বৈষম্য দূরীকরণে একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে। কৃষি, চিকিৎসা ও শিল্পক্ষেত্রেও বর্তমান সরকারের সাফল্য প্রশংসনীয়। তবে আমাদের জনসংখ্যাকে মানবসম্পদে পরিণত করার মাধ্যমে অর্থনৈতিক মুক্তির পথ এখনও অর্জিত হয়নি। তাই সব হানাহানি ভুলে মুক্তিযুদ্ধের যে চেতনা, যে অঙ্গীকার, যে দৃপ্ত শপথ; সে অনুযায়ী দেশ গড়ার অঙ্গীকার হওয়াই বাঙালির প্রত্যাশা। তবেই আমরা জাতি হিসেবে বিশ্বের দরবারে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারব।

প্রফেসর বাঙালি শামসুর রহমান : মহাপরিচালক
জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমী (নায়েম)

No comments

Powered by Blogger.