ডিভাইড অ্যান্ড রুল ও দ্বিখণ্ডিত ডিসিসি by আবু এন এম ওয়াহিদ

ম্প্রতি মহাজোট সরকার ঢাকা সিটি করপোরেশনকে (ডিসিসি) দুই ভাগ করে 'ঢাকা দক্ষিণ' ও 'ঢাকা উত্তর' নামে দুটি পৃথক সিটি করপোরেশনের জন্ম দিয়েছে। বিভক্তির পেছনে সরকার এ পর্যন্ত কোনো জোরালো যুক্তি দেখাতে পারেনি। তাই আমরা ধরে নিতে পারি, এটা হয়েছে নিছক আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক সুবিধা-অসুবিধার বিবেচনায়। এ ব্যাপারে মন্ত্রিসভায় সরকারি সিদ্ধান্তের পর প্রয়োজনীয় আইনের জন্য জাতীয় সংসদে বিল উঠেছে। সরকারের এ


সিদ্ধান্তকে সমালোচনা করে বেশ কিছু রাজনৈতিক নেতা ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধি বক্তব্য দিয়ে চলেছেন। অনেক কলামিস্টও সংবাদপত্রে কলাম লিখছেন। যত বক্তব্য এবং কলাম আমার নজরে এসেছে, তার সবই সরকারি সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে। কেউ কেউ সরকারের এ সিদ্ধান্তকে একটি তুঘলকি কাণ্ড বলে অভিহিত করতেও দ্বিধাবোধ করেননি।
দ্বিখণ্ডিত 'ডিসিসি'র ওপর এ পর্যন্ত যত কলাম লেখা হয়েছে তার মধ্যে আমার কাছে সবচেয়ে বেশি ভালো লেগেছে নাট্যব্যক্তিত্ব আবুল হায়াতের লেখাটি, যেটা ২৫ নভেম্বর দৈনিক প্রথম আলোতে ছাপা হয়েছে। লেখক মাত্র কয় দিন আগে সস্ত্রীক দুবাই সফরে গিয়ে একটি সুড়ঙ্গপথে যাতায়াত করেছেন। অনেকেই জানেন, লেখাপড়া ও প্রশিক্ষণে আবুল হায়াত একজন প্রকৌশলী। তাই পাঠকদের সুড়ঙ্গ বানানোর কৌশল বোঝাতে গিয়ে তিনি ইংরেজ এবং ফরাসিদের নিয়ে একটি সুন্দর গল্পের অবতারণা করেছেন। আবুল হায়াতের কলামটি যাঁরা পড়েননি তাঁদের অবগতির জন্য বলছি, 'ইংরেজরা সুড়ঙ্গপথ বানানোর সময় দুই প্রান্ত থেকে মাটি খুঁড়তে শুরু করে এবং মাঝখানে এসে যখন এক জায়গায় মেশে, তখন সুড়ঙ্গপথের কাজ সম্পন্ন হয়। একই কাজ একইভাবে ফরাসিরাও শুরু করে, কিন্তু তাদের দুই প্রান্ত থেকে শুরু করা সুড়ঙ্গপথ দুদিকে বেঁকে যাওয়ার কারণে মাঝখানে এসে মিলিত হয় না। বরং দুই মাথা উল্টোদিকে ওপর প্রান্তে গিয়ে শেষ হয়। এতে তারা একটি সুড়ঙ্গ তৈরি করতে গিয়ে দুটির জন্ম দেয়। অর্থাৎ তারা এক সুড়ঙ্গ গর্ভধারণ করে এবং দুটি প্রসব করে।' অবশেষে বাংলাদেশের প্রসঙ্গ টেনে আবুল হায়াত বলেছেন, 'একইভাবে বাংলাদেশও এক 'ডিসিসি' গর্ভধারণ করে প্রসব করল দুটি।'
আমি বিষয়টাকে একেবারে অন্যভাবে দেখতে চাই। যেমন_ভারতবর্ষে ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানির আগমন মোগল আমলে ১৬১০-এর দিকে। তখন দিলি্লতে মুসলমানরা ছিল ক্ষমতায়। বাংলা-বিহার-উড়িষ্যাও ছিল মুসলমানদের হাতে। শক্তি আর কূটকৌশলের সংমিশ্রণে অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানির মাধ্যমে ব্রিটিশরা মুসলমানদের হাত থেকে মোটামুটি গোটা ভারতবর্ষের শাসনভার কব্জা করে নেয়। এ কারণে প্রথমদিক থেকেই মুসলমানদের সঙ্গে ইংরেজদের সম্পর্ক ছিল অবিশ্বাস, অনাস্থা এবং টানাপড়েনের। সে তুলনায় হিন্দুদের সঙ্গে তাদের মোয়ামেলাত ছিল অনেকটা স্বাভাবিক এবং উষ্ণ। এ জন্য ব্রিটিশ রাজ লেখাপড়া, চাকরি-বাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য, জমিদারি-জায়গিরদারি ইত্যাদিতে মুসলমানদের চেয়ে হিন্দুদের প্রাধান্য দিত বেশি। এ সুযোগের সদ্ব্যবহার করে হিন্দু সমাজ বৈষয়িক সব ব্যাপারে মুসলমানদের পেছনে ফেলে দ্রুত এগিয়ে যায়।
পরে হিন্দু-মুসলমান এক হয়ে ভারতবর্ষ থেকে ইংরেজদের তাড়ানোর আলামত দেখা দিলে বেনিয়া শাসকদের টনক নড়ে। সুচতুর ইংরেজরা 'ডিভাইড অ্যান্ড রুল' অর্থাৎ 'ভাগ করো ও শাসন করো' নীতি নিয়ে নতুনভাবে এগিয়ে আসে। কৌশলে মুসলমানদের বিরুদ্ধে হিন্দুদের এবং হিন্দুদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের উসকে দেওয়ার চেষ্টা করে। এতে তারা কতকটা সফলও হয়। হিন্দু-মুসলমানদের এক হতে না দিয়ে, এ দেশে তাদের শাসনকে তারা আরো অনেক দিনের জন্য দীর্ঘায়িত করতে সক্ষম হয়। ইতিহাসে ইংরেজদের এ নিয়ম 'ডিভাইড অ্যান্ড রুল' নামে অভিহিত। 'ডিভাইড অ্যান্ড রুল' ব্রিটিশ-ভারতে দীর্ঘদিন কাজে লাগলেও শেষ পর্যন্ত ধোপে টেকেনি। ১৯৪৭ সালে ইংরেজদের ভারতবর্ষ ছাড়তেই হলো।
এবার আসি ডিসিসির কথায়। প্রতিষ্ঠানটি একত্রে থাকলে আওয়ামী লীগ মেয়র নির্বাচনে জিততে পারবে কি না এ সন্দেহ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মন থেকে কোনোভাবেই দূর করতে পারেননি। তাই ব্রিটিশদের মতো ডিভাইড অ্যান্ড রুলের মাধ্যমে ডিসিসিকে তিনি দুই ভাগ করলেন শাসনভার নিজের এবং দলের হাতে রাখার আশায়। এখন পাঠকরা প্রশ্ন করতে পারেন, ডিভাইড অ্যান্ড রুলের সঙ্গে দ্বিখণ্ডিত ডিসিসির সম্পর্কটা কী? আমি বলব, আছে বৈকি। ভারত শাসনের বেলায় ব্রিটিশদের 'ডিভাইড অ্যান্ড রুল'-নীতি চিরস্থায়ী হয়নি। শেখ হাসিনার 'ডিভাইড অ্যান্ড রুল' ও 'ডিসিসি'র বিভক্তি যে দীর্ঘস্থায়ী হবে তার নিশ্চয়তা কে দিল? তা ছাড়া বিরোধী দল ক্ষমতায় এলে দ্বিখণ্ডিত ডিসিসিকে একত্র করার ঘোষণা তো অলরেডি দিয়েই রেখেছে। সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে শেখ হাসিনা ব্যাপারগুলো কি একবারও ভেবে দেখেছেন?
লেখক : অধ্যাপক, টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটি; এডিটর, জার্নাল অব ডেভেলপিং এরিয়াজ awahid2569@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.