পালিয়েছে ভয়ংকর সেই আসামি by আশরাফ-উল-আলম

র্ষণ শেষে হত্যার পর তরুনির লাশ টুকরো টুকরো করে রাস্তায় ফেলে দেওয়া মামলার ভয়ংকর সেই আসামি পালিয়েছে। হাইকোর্টে ভুল ও মিথ্যা তথ্য দিয়ে জামিন নেওয়ার পর কালের কণ্ঠে প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে বিষয়টি তদন্ত শেষে হাইকোর্ট জামিন বাতিল করে ওই আসামিকে বিচারিক আদালতে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেন। কিন্তু সে আর আত্মসমর্পণ করেনি। আদালত সূত্রে জানা গেছে, তার অনুপস্থিতিতে বাকি বিচারকাজ চলেছে।


এখন মামলার রায় ঘোষণার পালা। এই ভয়ংকর আসামি তার আইনজীবীর মাধ্যমে আপিল করে ভুল ও মিথ্যা তথ্য দিয়ে গত ২ মার্চ বিচারপতি এম এ হাই ও বিচারপতি মো. আবদুর রাজ্জাকের হাইকোর্ট বেঞ্চ থেকে জামিন নেয়। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন-২০০৩-এর ৯ (৩) ধারায় দায়ের করা এ মামলার প্রধান আসামি গার্মেন্ট মালিক নজরুল ইসলাম এই জামিন নেয়।
ফৌজদারি আপিল নম্বর ৪৭১৪/১০-এর জামিন আদেশে হাইকোর্ট বলেন, 'আসামি পক্ষের আইনজীবী আদালতকে জানান, ২০০৬ সালের ২১ অক্টোবর আসামি গ্রেপ্তার হয়ে বিনা বিচারে কারাগারে রয়েছে। এর আগে হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ ছয় মাসের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তি করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। ওই সময়ের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তি না হলে আসামির জামিন আবেদন বিবেচনা করতে বিচারিক ট্রাইব্যুনালকে নির্দেশ দেন আদালত।'
জামিন আদেশে হাইকোর্ট আরো বলেন, 'আবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায়, হাইকোর্টের একটি নির্দেশানুযায়ী ছয় মাসের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তি হয়নি। আবার বিচারিক আদালত জামিনের আবেদন নামঞ্জুর করেছেন। সার্বিক বিবেচনায় জামিনের আবেদন বিবেচনা করা হলো।' এই আদেশের পর আসামি নজরুলের পক্ষে এ বছর ১৩ মার্চ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে জামিননামা দাখিল করা হয়। পরের দিন সে মুক্তি পায়।
কালের কণ্ঠের অনুসন্ধানে জানা যায়, 'ছয় মাসের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তির নির্দেশ দিয়ে হাইকোর্টের অন্য একটি বেঞ্চ বলেছিলেন, ওই সময়ের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তি করা সম্ভব না হলে আসামির জামিনের আবেদন বিবেচনা করতে। কিন্তু ছয় মাস পার হওয়ার আগেই আসামিপক্ষ হাইকোর্টকে ভুল বুঝিয়ে এমন একটি নৃশংস হত্যাকাণ্ড মামলার প্রধান আসামির জামিন নেয়।'
মামলার নথি থেকে জানা যায়, ২০০৯ সালে আরেকবার আসামি নজরুল ইসলামের জামিন চেয়ে হাইকোর্টে আপিল করা হয় (ফৌজদারি আপিল নম্বর ৮০১৩/২০০৯)। গত বছর ওই আপিলটির নিষ্পত্তি হয়। নিষ্পত্তির আদেশে হাইকোর্ট বলেন, হাইকোর্টের আদেশ পাওয়ার ছয় মাসের মধ্যে মামলাটি নিষ্পত্তি করতে হবে। যদি সম্ভব না হয়, তাহলে জামিনের বিষয়টি বিবেচনা করা যাবে।
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলার নথি থেকে আরো দেখা যায়, হাইকোর্টের দেওয়া মামলা নিষ্পত্তিসংক্রান্ত আদেশ বিচারিক আদালতে পেঁৗছায় এ বছরের ২০ জানুয়ারি। হাইকোর্টের সেই আদেশেও বলা আছে, এ আদেশ পেঁৗছানোর পর ছয় মাসের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তি করতে হবে। তা সম্ভব না হলে আসামির জামিন আবেদন বিবেচনা করা যেতে পারে। ওই হিসাবে যে দিন আসামিকে জামিন দেওয়া হয়, সেদিন পর্যন্ত মামলা নিষ্পত্তিসংক্রান্ত হাইকোর্টের আদেশের এক মাস ১০ দিন পূর্ণ হয়। কিন্তু হাইকোর্টকে ভুল তথ্য দেন আসামির আইনজীবী।
এ আসামি জামিনে মুক্তি পাওয়ার পর এ বছর ২৮ মার্চ দৈনিক কালের কণ্ঠে 'জামিন পেল ভয়ংকর আসামি' শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনটি হাইকোর্টের নজরে এলে বিষয়টি খতিয়ে দেখতে রাষ্ট্রপক্ষকে নির্দেশ দেন হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট বেঞ্চ। সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল মনোয়ার হোসেন কালের কণ্ঠে প্রকাশিত প্রতিবেদনের সত্যতা পেয়ে গত ১১ মে জামিন আদেশ প্রত্যাহার করতে হাইকোর্টে আবেদন জানান। হাইকোর্ট ওই দিন আগের দেওয়া জামিন আদেশ প্রত্যাহার করে আসামিকে ২৬ মে তারিখের মধ্যে বিচারিক আদালতে হাজির হতে নির্দেশ দেন।
চাঞ্চল্যকর এ মামলাটি ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৫-এ বিচারাধীন। ওই ট্রাইব্যুনালের নথি থেকে দেখা যায়, আসামি হাইকোর্টের দেওয়া নির্দেশ অনুযায়ী আর ট্রাইব্যুনালে হাজির হয়নি। পরে ১ জুন ট্রাইব্যুনাল জামিন বাতিল করে আসামির বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন।
ওই ট্রাইব্যুনালের বিশেষ সরকারি কেঁৗসুলি (স্পেশাল পিপি) আলী আসগর স্বপন কালের কণ্ঠকে জানান, ভুল তথ্য দিয়ে জামিন নেওয়ার কারণে হাইকোর্ট আসামির জামিন বাতিল করেন। একই সঙ্গে বিচারিক আদালতে আত্মসমর্পণের জন্য আসামিকে সময় বেঁধে দেন। ওই সময়ের মধ্যে আসামি নজরুল ইসলাম আদালতে না আসায় তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়। পিপি আরো বলেন, আসামির অনুপস্থিতিতেও কয়েকজন সাক্ষীর সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে রাষ্ট্রপক্ষে তিনি গত ১৫ নভেম্বর যুক্তিতর্ক শুনানি শেষ করেছেন। আদালতের বাৎসরিক ছুটি শেষ হওয়ার পর মামলার রায় ঘোষণা করা হবে। তিনি বলেন, আসামি পক্ষ বারবার সময় নিয়ে সাক্ষ্যগ্রহণ বাধাগ্রস্ত করেছে, অন্যথায় আরো আগেই মামলার বিচারকাজ শেষ হয়ে যেত।
ঘটনার বিবরণে জানা যায়, ২০০৬ সালের ১৯ অক্টোবর সকাল সাড়ে ১০টার দিকে ঢাকার মিরপুর ১৬ নম্বর রোডের মাথায় একটি ব্যাগের ভেতর অজ্ঞাতনামা এক মহিলার দুটি হাত, দুটি পা ও মাথা উদ্ধার করে পুলিশ। ওই দিনই মিরপুর থানায় এসআই হামিদুল হক একটি হত্যা মামলা করেন। তিনি নিজেই মামলাটির তদন্ত করেন। তদন্ত করতে গিয়ে পরের দিন ২০ অক্টোবর মিরপুরের দক্ষিণ বিশিল এলাকার রাস্তা থেকে এসআই আসলাম আরেকটি ব্যাগের মধ্য থেকে এক মহিলার খণ্ডিত লাশ উদ্ধার করেন।
এরপর তদন্ত কর্মকর্তা গাইবান্ধা জেলার সুন্দরগঞ্জ থানার রামদেব গ্রামের মো. আজিজুর রহমানের ছেলে নজরুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করেন। নজরুল ইসলাম পুলিশের কাছে বলে, 'যার খণ্ডিত লাশ উদ্ধার করা হয়েছে, তাঁর নাম বিউটি। তিনি একজন গার্মেন্টকর্মী। ৩২৮/বি আহম্মদ নগর, মিরপুরের বাসায় বিউটিকে ধর্ষণের পর খুন করে তাঁর লাশ খণ্ড-বিখণ্ড করে রাস্তায় ফেলে দিই।' নজরুল পুলিশের কাছে আরো স্বীকার করে, বিউটির সঙ্গে আরেক গার্মেন্টকর্মী ছিলেন। তিনি জীবিত।
তদন্ত কর্মকর্তা পরে ওই গার্মেন্টকর্মীকে রাজধানীর সূত্রাপুর এলাকা থেকে উদ্ধার করেন। তাঁকে আদালতে পাঠিয়ে জবানবন্দি গ্রহণ করা হয়। বিউটির সঙ্গী ওই গার্মেন্টকর্মী আদালতকে জানান, ফরিদপুর জেলার আলফাডাঙ্গা থানার পাচুরিয়া গ্রামের আবদুর রউফের ছেলে মোস্তফা তাঁর এলাকার লোক। আশুলিয়ায় একটি গার্মেন্টে বিউটি ও তিনি চাকরি করতেন। নজরুল ইসলাম একটি গার্মেন্টের মালিক। মোস্তফা ও নজরুল তাঁদের দুজনকে ঈদের বাজার করে দেওয়ার কথা বলে ২০০৬ সালের ১৮ অক্টোবর ঢাকায় নজরুলের বাসায় নিয়ে যায়। ওই দিন রাত ১১টা থেকে ভোররাত পর্যন্ত তাঁদের দুজনকে নজরুল ও মোস্তফা পালাক্রমে ধর্ষণ করে। বিউটি ঘটনাটি সবাইকে বলে দেওয়ার হুমকি দেন। তাঁর সঙ্গে নজরুল ও মোস্তফার কথা কাটাকাটি হয়। একপর্যায়ে বিউটিকে নজরুল ও মোস্তফা হত্যা করে। পরে লাশ টুকরো টুকরো করে দুটি ব্যাগে ভরে রাস্তায় ফেলে দেয়।
ওই গার্মেন্টকর্মী আরো জানান, তাঁকেও তারা হত্যা করতে চেয়েছিল। তবে ঘটনা কাউকে জানাবে না ওয়াদা করে প্রাণভিক্ষা চাইলে তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
এই জবানবন্দির পর লাশের ময়নাতদন্তের ওপর ভিত্তি করে তদন্ত শেষে আগে দায়ের করা হত্যা মামলাটিতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়। পরে নজরুল ও মোস্তফাকে আসামি করে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে ২০০৬ সালের ডিসেম্বর মাসে আরেকটি মামলা করে পুলিশ। অভিযোগ প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হওয়ায় ২০০৭ সালের ১৯ মে নজরুল ও মোস্তফার বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। মামলায় সাক্ষী করা হয় ২৬ জনকে। মোস্তফাকে এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ।

No comments

Powered by Blogger.