ধলেশ্বরীর দুই লাশের পরিচয় মিলেছে-জামাই-শ্বশুরের একই পরিণতি? by সাহাদাত হোসেন পরশ ও আতাউর রহমান

রাজধানীর ৪১ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ সভাপতি হাজি নূর মোহাম্মদ ওরফে নুরু হাজির মেয়ে জামাই আবদুুল মান্নান ও তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ইকবাল হোসেন গত ৩ ডিসেম্বর থেকে 'রহস্যজনক নিখোঁজ'। পরিবারের সদস্যদের আশঙ্কা, তারা গুপ্তহত্যার শিকার। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর একটি সূত্র বলছে, মান্নান ও ইকবাল গুম হওয়ার নেপথ্যে রাজনৈতিক ও পশুরহাটের টাকার ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে বিরোধ থাকতে পারে। এর আগে ১৯ অক্টোবর রাতে সাভার পৌর


এলাকার কাতলাপুরের বাসা থেকে কালো পোশাকধারী লোকজন তুলে নিয়ে যায় নুরু হাজিকে। শ্বশুর নিখোঁজ হওয়ার ৪৫ দিন পর ঘনিষ্ঠ বন্ধুসহ মেয়ে জামাই নিখোঁজ হওয়ায় পরিবারের সদস্যদের মধ্যে আতঙ্ক ও উৎকণ্ঠা ভর করেছে। নিখোঁজদের স্বজন ও এলাকার বাসিন্দাদের ধারণা, জামাই-শ্বশুর একই পরিণতির শিকার হয়েছেন।
এদিকে মুন্সীগঞ্জ শহরের কাছে ধলেশ্বরী নদী থেকে উদ্ধার অজ্ঞাত তিন লাশের মধ্যে গতকাল বুধবার রাতে দু'জনের পরিচয় পাওয়া গেছে। তারা হচ্ছেন_ সিদ্ধিরগঞ্জের শানারপাড় বাজারের কাঁচামাল ব্যবসায়ী মোহাম্মদ মঞ্জু ও আকতার হোসেন। রাত ৮টার দিকে মুন্সীগঞ্জ জেনারেল হাসপাতাল মর্গে স্বজনরা লাশ দুটি শনাক্ত করেন। এর মধ্য দিয়ে ৫ দিনের ব্যবধানে ধলেশ্বরীতে পাওয়া ৫ লাশের মধ্যে ৩ জনের পরিচয় পাওয়া গেল। এর আগে ঢাকার হাতিরপুলে মোতালেব প্লাজার সামনে থেকে ধরে আনা ঢাকার ৫০ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রদল সভাপতি ইসমাইল হোসেন ওরফে আল-আমিনের লাশ শনাক্ত করা হয়। সবাইকেই র‌্যাব পরিচয়ে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল বলে স্বজনরা দাবি করেছেন।
অন্যদিকে মান্নান ও ইকবালের নিখোঁজ হওয়ার ঘটনায় রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানায় দুটি পৃথক সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হয়। নিখোঁজ হওয়ার পর থেকে দু'জনের মোবাইল ফোন নম্বর বন্ধ রয়েছে। মান্নান ও ইকবালকে আটকের বিষয়টি অস্বীকার করেছে পুলিশ ও র‌্যাব। সম্প্রতি রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে রহস্যজনক নিখোঁজ হচ্ছেন বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার লোক। তাদের কারও কারও লাশ পরবর্তী সময়ে পাওয়া গেলেও দীর্ঘদিন পর অনেকের খোঁজও মিলছে না।
র‌্যাবের মিডিয়া উইংয়ের প্রধান কমান্ডার এম সোহায়েল সমকালকে বলেন, অপহরণ, গুম ও হত্যার সঙ্গে র‌্যাব জড়িত নয়। যারা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে এ ধরনের ঘটনা ঘটাচ্ছে তাদের শনাক্তকরণে আমাদের টিম কাজ করছে। গুম-অপহরণ নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। মাঠ পর্যায়ে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের মনোবলকে ক্ষুণ্নম্ন করতে একটি মহল উদ্দেশ্যমূলক এ ঘটনা ঘটাচ্ছে। হাজি নূর ও তার পরিবারের কোনো সদস্যকে আটকের সঙ্গে র‌্যাব জড়িত নয়।
মান্নান ও ইকবালকে যেভাবে ধরে নেওয়া হয় : মান্নানের স্ত্রী স্বপ্না বেগমের সঙ্গে গতকাল দুপুরে রাজধানীর পশ্চিম আগারগাঁওয়ের শাপলা হাউজিংয়ের ২১৩/১৬ নম্বর বাসায় কথা হয়। তিনি বলেন, ৪ ডিসেম্বর তার ছোট ভাই মামুনের মৃত্যুবার্ষিকী ছিল। এ জন্য আবদুল মান্নান ওই দিন সন্ধ্যায় স্থানীয় বিএনপি বাজার থেকে কেনাকাটা করে ম্যানেজার নজরুলের মাধ্যমে বাসায় পাঠিয়ে দেন। পরে সন্ধ্যা ৭টার দিকে ঘনিষ্ঠ বন্ধু ইকবাল হোসেনকে নিয়ে মোটরসাইকেলযোগে বাসায় ফিরছিলেন। পথে মাইক্রোবাস আরোহী সাদা পোশাকধারী কয়েক লোক তাদের গতিরোধ করে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে গাড়িতে তুলে নেয়। আমাদের এক আত্মীয় ঘটনাটি দেখে প্রথমে আমার বড় মেয়েকে জানায়। এরপরই আমরা মান্নান ও ইকবালের মোবাইল নম্বরে ফোন করি। তাদের দু'জনের ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। এ ঘটনার পর আমরা র‌্যাবের একাধিক ব্যাটালিয়ন, সদর দফতর ও থানায় গিয়ে তাদের খোঁজ নিই। কেউ তাদের খোঁজ দিতে পারেননি। এমনকি ওই নামে কাউকে তারা আটক করেননি বলে জানান। ঘটনার একদিন পর আগারগাঁও এলাকা থেকে আমার স্বামীর মোটরসাইকেলটি উদ্ধার করে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী।
এক প্রশ্নের জবাবে স্বপ্না বলেন, পারিবারিকভাবে কারও সঙ্গে আমাদের কোনো বিরোধ নেই। কেউ ফোনে কোনো হুমকিও দিয়েছে বলে জানা নেই। তবে বাবা গুম হওয়ার পর থেকে নানা জায়গায় তার খোঁজে চেষ্টা-তদবির চালিয়ে আসছিল আমার স্বামী। এ ঘটনায় কোনো পক্ষ ক্ষুব্ধ হতে পারে। বাবা ও স্বামী গুম হওয়ার পর আমিই বাদী হয়ে জিডি করেছি। এরপর পরিবারের কোন সদস্য গুম হবে, আবার কার জন্য জিডি করতে হবে!
স্বামীর কথা বলতে বলতে এক পর্যায়ে চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি স্বপ্না। তিনি বলেন, 'তিন ভাই গেল, বাপ গেল। এবার স্বামীকে হারালাম! আল্লাহর কাছেই এর বিচারের ভার দিলাম।'
ইকবালের মা ফরিদা বেগম জানান, তার ছেলে রাজনীতি, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজিসহ কোনো অপকর্মের সঙ্গে জড়িত ছিল না। তার শত্রুও ছিল না। একটি রিকশা গ্যারেজ চালিয়ে পরিবারকে নিয়ে সুখে-শান্তিতেই ছিল সে। মান্নানের সঙ্গে থাকাটাই তার অপরাধ।
যে কারণে সন্দেহের তীর আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর দিকে :সূত্র জানায়, সাদা যে মাইক্রোবাসে মান্নান ও ইকবালকে তুলে নেওয়া হয় তা মিতসুবিশি ব্রান্ডের। ওই গাড়িটির নম্বরপ্লেট ছিল সাদা কাগজে ঢাকা। এমনকি যারা মাইক্রোবাসে ছিলেন, তাদের কোমরে ছিল পিস্তল ও ওয়্যারলেস। মাইক্রোবাস থেকে নামার পর শার্ট কিছুটা উপরে উঠে গেলে অনেকের কোমরে পিস্তল দেখেন। নিখোঁজদের স্বজন ও নাম প্রকাশে ভীত অনেক প্রত্যক্ষদর্শী বলছেন, মান্নান ও ইকবালকে যারা গ্রেফতার করেছেন, তারা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য। এমনকি মোটরসাইকেল থেকে দু'জনকে মাইক্রোবাসে তোলার সময় আইন-শৃঙ্খলা সদস্যের পরিচয় দেওয়া হয়েছিল।
কিছু নেপথ্য কথা : সূত্র জানায়, দীর্ঘদিন ধরে রাজধানীর আগারগাঁও এলাকায় আধিপত্য বিস্তার করে আসছিল নুরু হাজি ও ৪১ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ফজলুল হক গ্রুপ। সম্প্রতি ফজলু খুন হওয়ার পর এলাকায় একক আধিপত্য বিস্তার করেন নুরু হাজি। শেষ পর্যন্ত তার আধিপত্য বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। ফজলুল হক হত্যা মামলায় ফেঁসে যান নুরু হাজি। গত ১৯ অক্টোবর সাভারের বাসা থেকে র‌্যাব পরিচয়ে তাকে তুলে নেওয়া হয়। গত ঈদুল আজহায় আগারগাঁওয়ের পশুরহাটের ইজারা পান নুরু হাজির লোকজন। তবে নুরু হাজির অনুপস্থিতিতে হাটের ইজারা ও তার ব্যবসা দেখভাল করতেন মেয়ে জামাই মান্নান। এমনকি পশুহাটের প্রায় দেড় কোটি টাকা লাভের ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে স্থানীয় কয়েক আওয়ামী লীগ নেতার সঙ্গে মান্নানের তীব্র বিরোধ সৃষ্টি হয়। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে ব্যবহার করে কেউ মান্নানের ওপর প্রতিশোধ নিতে পারে বলে একটি সূত্র বলছে।
আরও কিছু রহস্যজনক নিখোঁজ : গত ২৮ নভেম্বর খুলনায় বিএনপির লংমার্চ থেকে ঢাকায় ফেরার পর হাতিরপুল এলাকা থেকে অজ্ঞাতপরিচয় বন্দুকধারীরা তুলে নিয়ে যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সূর্য সেন হল ছাত্রদলের সাহিত্য ও গবেষণা সম্পাদক শামীম হাসান সোহেল, ৫০ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রদলের সভাপতি ইসমাইল হোসেন ওরফে আল আমিন ও মাসুম হোসেনকে। ঘটনার ১০ দিন পর ধলেশ্বরী নদী থেকে পুলিশ দুুটি গলিত লাশ উদ্ধার করে। ওই লাশের একটি ইসমাইল হোসেনের। এর আগে ২ ডিসেম্ব্বর সাভার মহাসড়কের পাশ থেকে উদ্ধার করা হয় গুলিবিদ্ধ দুটি লাশ। এদের একজন ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থানা জাতীয় পার্টির সাধারণ সম্পাদক মাহামুদুল হক খান। আরেক জনের পরিচয় মেলেনি। গত ২৬ অক্টোবর ঢাকার ফকিরাপুল থেকে তুলে নেওয়া হয় ফেনীর সোনাগাজীর বাসিন্দা সারোয়ার জাহান বাবুলকে। তিনি সোনাগাজী উপজেলা যুবলীগ নেতা। ঘটনার দিন হাইকোর্ট থেকে একটি মামলার জামিন নেওয়ার জন্য ঢাকায় এলে রাত ৮টার দিকে হোটেল আসরের সামনে থেকে পুলিশ পরিচয়ে কয়েক যুবক তাকে মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যায়। ১৭ নভেম্বর বিকেলে মালিবাগ থেকে অপহরণ করা হয় ভোলার বোরহানউদ্দিনের ৭ যুবককে। তারা হলেন_ আরিফ, জসিম, জুয়েল, শেখ সাদী, দিদার, মিরাজ ও আকাশ। ২৮ নভেম্বর জসিমের লাশ আশুলিয়া থেকে উদ্ধার হয়। এ ছাড়া গত বছরের ২৫ জুন ঢাকা সিটি করপোরেশনের ৫৬ নম্বর ওয়ার্ড কমিশনার ও বিএনপি নেতা চৌধুরী আলম রাজধানীর ইন্দিরা রোডের এক আত্মীয়র বাসা থেকে প্রাইভেটকারে ধানমণ্ডি যাওয়ার সময় সাদা পোশাকধারী ব্যক্তিদের হাতে আটক হওয়ার পর থেকেই নিখোঁজ রয়েছেন। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় পুরস্কার ঘোষিত ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীর অন্যতম, যুবলীগের সাবেক কেন্দ্রীয় নেতা লিয়াকত হোসেন নিখোঁজের আড়াই বছর পরও তাকে পাওয়া যায়নি। লিয়াকত হোসেন প্রায় ৫ বছর কারাবন্দি থাকার পর ২০০৮ সালের ৪ সেপ্টেম্বর জামিনে মুক্তি পান।
মঞ্জু ও আখতারের স্বজনরা যা বলছেন
মুন্সীগঞ্জ প্রতিনিধি মামুনুর রশীদ খোকা জানান, গত ৮ ডিসেম্বর ধলেশ্বরীতে দু'জনের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। গতকাল তাদের পরিচয় মিলেছে। বুধবার রাতে মর্গে এসে মঞ্জুর ২ ছেলে মিজান, মোশারফ ও স্ত্রী রানী বেগম লাশ শনাক্ত করেন। আখতারের লাশ শনাক্ত করেছেন তার স্ত্রী রিতা বেগম। মঞ্জুর বাড়ি ফরিদপুর জেলার সালথা উপজেলার লক্ষ্মণদিয়া গ্রামে। আক্তারের বাড়ি চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে। ১০ মাস আগে আখতার বিয়ে করেন বলে তার স্ত্রী জানিয়েছেন। নিহতের স্বজনদের দাবি, র‌্যাব পরিচয়ে গত ২৮ নভেম্বর তাদের মাইক্রোবাসযোগে কালো কাপড়ে চোখ বেঁধে ধরে আনার পর হত্যা করা হয়েছে। এ হত্যাযজ্ঞের জন্য স্বজনদের সন্দেহের তীর র‌্যাবের দিকেই। উভয়েই র‌্যাবের হাতে গুপ্তহত্যার শিকার হয়েছেন বলে স্বজনরা অভিযোগ করেছেন।
মঞ্জু ও আখতারের স্ত্রী জানান, আশুরার পরদিন সকালে কুমিল্লার দাউদকান্দি এলাকার মেঘনা-গোমতী সেতু থেকে দু'জনকে র‌্যাব পরিচয়ে ধরা হয়। এ সময় র‌্যাব পরিচয় দিয়ে স্বজনদের কাছে সেলফোনে গ্রেফতারের খবর নিশ্চিত করা হয়েছে। র‌্যাবের বিভিন্ন দফতরে খোঁজ নিলেও সন্ধান পাওয়া যায়নি। মঞ্জুর বড় ছেলে মোশারফ জানান, তার বাবার ঢাকার যাত্রাবাড়ী এলাকায় কাঁচামালের আড়ত রয়েছে। আখতারের সঙ্গে তার বাবা সিদ্ধিরগঞ্জের শানারপাড় বাজারেও কাঁচামালের ব্যবসা করতেন।
এদিকে বুধবার বিকেল ৪টার দিকে মুন্সীগঞ্জ জেনারেল হাসপাতাল মর্গে তিন লাশের ময়নাতদন্ত হয়েছে। এসব লাশের শরীরে আগ্নেয়াস্ত্রের গুলির আলামত পাওয়া যায়নি। ময়নাতদন্তকারী ডা. এহসানুল করিম জানান, মাথায় উপর্যুপরি আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। হাতুড়ি কিংবা শক্ত বস্তুর আঘাতে মাথার হাড় ভেঙে গেছে। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে তাদের মৃত্যু হয় বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে। লাশগুলোর মাথায় একাধিক আঘাতের ক্ষত চিহ্ন রয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.