সংবাদ সম্মেলনের অধিনায়কেরা

ফাইনালের টস দেখতে দেখতে এই লেখা শুরু করার সময় ভাবছি, ঘণ্টা চারেক পর সংবাদ সম্মেলনে হাসিমুখে আসবেন কে? মাইকেল ক্লার্ক, না পল কলিংউড?
পল কলিংউডের মধ্যে অদ্ভুত একটা বিষণ্নতা আছে। চোখেমুখে তো তা খেলা করেই, কণ্ঠস্বরেও মিশে থাকে কেমন যেন এক বিষণ্নতা। হাসিতেও!
ফাইনাল জিতে ইংল্যান্ডের বিশ্বকাপ-আক্ষেপ ঘোচাতে পারলেও সেটিতে পরিবর্তন হওয়ার সম্ভাবনা নেই। ওটা যে কলিংউডের ট্রেডমার্ক।
কলিংউড কী বলবেন, সেটি অবশ্য অনুমান করতে পারছি না। মাইকেল ক্লার্কের ক্ষেত্রে একেবারেই যে সমস্যা হচ্ছে না। যা-ই বলুন না কেন, অসংখ্যবার তাতে ‘ফ্যা-ন্টা-স্টি-ক’ শব্দটা থাকবেই। হাইফেনগুলো অকারণে দিইনি। ফ্যান্টাস্টিক কথাটা ক্লার্ক অমন টেনে টেনেই বলেন।
ক্লার্কের একটা সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত থাকলেই আপনি বুঝে ফেলবেন, তাঁর সবচেয়ে প্রিয় শব্দও বোধহয় ওটাই। ফাইনাল-পূর্ব সংবাদ সম্মেলনে কতবার যে তা বললেন! পাকিস্তানের বিপক্ষে সেমিফাইনালে জয় ‘ফ্যা-ন্টা-স্টি-ক’, মাইক হাসির ইনিংসটা ‘ফ্যা-ন্টা-স্টি-ক’, ফাইনালে খেলার অনুভূতি ‘ফ্যা-ন্টা-স্টি-ক’, ৫০ ওভারের বিশ্বকাপ ও চ্যাম্পিয়নস ট্রফির শিরোপার সঙ্গে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপটাও যোগ করতে পারাটাও হবে ‘ফ্যা-ন্টা-স্টি-ক’!
নির্দিষ্ট কিছু শব্দের প্রতি এমন দুর্বলতা থাকে অনেকেরই। সংবাদ সম্মেলনে ওয়াসিম আকরামের যেমন বেশির ভাগ প্রশ্নের উত্তরই শুরু হতো ‘ডেফিনিটলি’ দিয়ে। একবার এই বাঁহাতি পেস জাদুকরের মিনিট দশেকের একটা সংবাদ সম্মেলন শেষে হিসাব করে দেখেছিলাম, নয় বার ‘ডেফিনিটলি’ বলেছেন!
একসময় শচীন টেন্ডুলকারের খুব প্রিয় শব্দ ছিল ‘অফ কোর্স’। কোর্স-এর ও-কার প্রায় উহ্যই থাকত বলে শোনাত অফ কর্স-এর মতো। গত কিছুদিন এই মুদ্রাদোষটা একটু কম দেখছি।
আবার এই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপেই ফিরে আসা যাক। গত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের পর এই প্রথম গ্রায়েম স্মিথের সংবাদ সম্মেলন। কিন্তু প্রায় সব প্রশ্নের উত্তরই ‘লুক’ দিয়ে শুরু করার অভ্যাসটা দেখলাম এখনো আছে। তাঁর ব্যাটিংয়ে যেমন গায়ের জোরটা খুব প্রকাশিত, কথাও খুব জোর দিয়ে বলেন গ্রায়েম স্মিথ। ‘আপফ্রন্ট’ তাঁর আরেকটি প্রিয় শব্দ। আপফ্রন্টে বোলিং ভালো হয়নি মানে শুরুতে বোলিং ভালো হয়নি। ব্যাটিংয়ের কথা হলে বুঝতে হবে টপ অর্ডার।
মাহেলা জয়াবর্ধনেরও আপফ্রন্ট-প্রীতি আছে। কুমারা সাঙ্গাকারার একটু কম। বর্তমান আন্তর্জাতিক ক্রিকেটারদের মধ্যে ইন্টেলেকচুয়াল হিসেবে বেশ নাম হয়ে গেছে সাঙ্গাকারার। খেলার এই ব্যস্ততার মধ্যেই আইনশাস্ত্রে ডিগ্রি নিয়েছেন। ক্রিকইনফোতে নিয়মিত কলাম লেখেন। ২০০৮ সালে পাকিস্তানে এশিয়া কাপের সময় এশিয়ান ক্রিকেট কাউন্সিল আয়োজিত ‘এশিয়ান ক্রিকেট: বর্তমান ও ভবিষ্যৎ’ শীর্ষক এক সেমিনারে কি-নোট স্পিকার ছিলেন। ঘটনাচক্রে সেই সেমিনারে পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ডের সে সময়ের পরিচালক শাফকাত নাগমি ও সাবেক পাকিস্তান-অধিনায়ক আসিফ ইকবালের সঙ্গে আমিও আলোচকের ভূমিকায়। তিনজনই একটা ব্যাপারে একমত হয়েছিলাম, রাহুল দ্রাবিড় পারলেও পারতে পারেন, এর বাইরে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আর কোনো ক্রিকেটারের এমন একটা পেপার লেখার সাধ্য নেই।
অথচ সাঙ্গাকারা আগের দিন ডে-নাইট ম্যাচ খেলার পর হোটেলে ফিরে ওই পেপারটা লিখেছেন। খসড়াটা চূড়ান্ত করারও সুযোগ পাননি। মঞ্চেও তো উঠলেন প্র্যাকটিসের পোশাকেই।
সংবাদ সম্মেলনে সেই সাঙ্গাকারার কথায় গভীর চিন্তাভাবনার ছাপ থাকবে, সেটিই স্বাভাবিক। যদিও ডেডলাইনের তাড়া থাকলে সেটির মজা পাওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। সাঙ্গাকারা যে সব প্রশ্নেরই এক মাইল লম্বা উত্তর দেন!
কথাবার্তায় মাঝেমধ্যে দার্শনিকতার ছাপ পাওয়া গেলেও সাঙ্গাকারার চেহারায় তা নেই। যা যথেষ্টই আছে ড্যানিয়েল ভেট্টোরির মধ্যে। চাপদাড়ি আর চশমায় এমনিতেই তাঁকে প্রফেসর-প্রফেসর দেখায়। কথাবার্তাও সেটির সঙ্গে মানানসই। ‘সিরিয়াস’ শব্দটা ভেট্টোরির সঙ্গে খুবই যায়।
ঠিক উল্টো হলেন শহীদ আফ্রিদি। মাঠে ব্যাটিং-বোলিং-ফিল্ডিংয়ে যেমন তাড়াহুড়ো, সংবাদ সম্মেলনেও তা-ই। ছটফটে স্বভাবটা এখানেও ফুটে ওঠে। কথা বলেন দ্রুত। উত্তরগুলোও বেশি বড় হয় না। যেন সব সময়ই তাঁর ট্রেন ধরার তাড়া!
মহেন্দ্র সিং ধোনি টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের ইতিহাসে দীর্ঘতম সংবাদ সম্মেলন করার রেকর্ডটির অধিকারী। গত বছর ইংল্যান্ড বিশ্বকাপে ভারতের বিদায় নিশ্চিত হয়ে যাওয়ার পর লর্ডসে ধোনির সংবাদ সম্মেলন ২৭ মিনিট ধরে চলেছিল! ভারতের প্রচুর সাংবাদিক, প্রায় সবারই কোনো না কোনো প্রশ্ন আছে। এটা যদি একটা কারণ হয়, আরেকটা কারণ অবশ্যই সাঙ্গাকারার মতো ধোনিরও বড় উত্তর দেওয়ার অভ্যাস।
মাইক আথারটন যা শুনলে খুবই অবাক হবেন। খেলা ছাড়ার পর ক্রিকেট সাংবাদিকতায় খুব নাম করা আথারটন ইংল্যান্ডের অধিনায়ক থাকার সময় মিডিয়াকে অপছন্দ করার ব্যাপারে খুব ধারাবাহিক ছিলেন। আত্মজীবনীতে তা স্বীকার করে আথারটন লিখেছেন, ‘আমার নীতি ছিল সংবাদ সম্মেলনে যত কম কথা বলে পারা যায়। কারণ বেশি বলা মানে পত্রপত্রিকায় সেটিকে বিকৃত করে লেখার সুযোগ বাড়িয়ে দেওয়া।’
ধোনির কথা বলতে গিয়ে আথারটনের কথা মনে পড়ার কারণ, এই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে এই অভিজ্ঞতা তাঁর ভালোই হয়েছে। শ্রীলঙ্কার কাছে হেরে বিশ্বকাপ থেকে আনুষ্ঠানিক বিদায় নেওয়ার পর ধোনির সংবাদ সম্মেলনে আমিও উপস্থিত ছিলাম। ভারতের ব্যর্থতার কারণ আইপিএল কি না, ঘুরেফিরে এই প্রশ্ন উঠল। প্রতিবারই কিন্তু ধোনি সেটি উড়িয়ে দিয়েছেন। ‘আইপিএলের কোনো দোষ নেই’ সরাসরিও বলেছেন এ কথা। শুনতে শুনতে মনে মনে এ কথাও বলেছি, ‘তুমি তো বলবেই। কোটি কোটি পাও। তুমি তো চাইবে আইপিএল বছরে দুটি হোক।’
অথচ গত কয়েক দিন ভারতীয় মিডিয়ায় ঝড় উঠেছে, ধোনি নাকি এই ব্যর্থতার জন্য আইপিএলের পার্টিকে দায়ী করেছেন। মিডিয়া চাইলে কোনো কিছুকে কীভাবে ঘুরিয়ে দিতে পারে, তার একটা আদর্শ উদাহরণ হতে পারে এটি। ধোনি আসলে বলেছিলেন, আইপিএলে খেলার সময় ক্রিকেটারদের স্মার্ট হতে হবে। এক ভেন্যু থেকে আরেক ভেন্যুতে যাওয়া-আসা আছে, তার ওপর রাতে ম্যাচ খেলে পার্টি-টার্টি করলে শরীরে তো তার প্রভাব পড়বেই।
এখানে আইপিএলকে দায়ী করলেন কোথায়? ধোনি এ কথাটাও বলেছিলেন বেশ বড় একটা উত্তরের অংশ হিসেবে। ইচ্ছেমতো কেটে নিলে অনেক উত্তরকেই এমন বিতর্কিত বানিয়ে দেওয়া যায়।
ধোনি না এখন থেকে সংবাদ সম্মেলনে মাইক আথারটনের অনুসারী হয়ে পড়েন!

No comments

Powered by Blogger.