নির্বাচনে বাধা ও একটি অকপট স্বীকারোক্তি -রসঙ্গ ডাকসু by মাহমুদুর রহমান মান্না

গত ২৩ অক্টোবর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছিলাম একটি গোলটেবিলে যোগ দিতে। যোগাযোগ স্কুল নামের বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সংগঠন এর আয়োজক। গোলটেবিল বৈঠকের শিরোনাম ছিল: ডাকসু নির্বাচনে বাধা ও করণীয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য গোলটেবিলে সভাপতিত্ব করেছিলেন। বৈঠকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতারা উপস্থিত ছিলেন আর ডাকসুর প্রাক্তন ভিপি-জিএসরা আমন্ত্রিত ছিলেন। মোটামুটি ভালোই জমেছিল আলোচনা।
১৮ বছর বা দেড় যুগ ধরে ডাকসুর নির্বাচন হয় না। কী অদ্ভুত ব্যাপার, না! ১৮ বছর ‘কী দুঃসহ সময়’! ১৮ বছর ধরে পদ্মা-মেঘনা-যমুনা দিয়ে কত পানি গড়িয়ে গেছে, ১৮ বার পৃথিবী তার কক্ষপথ প্রদক্ষিণ করেছে, ১৮ বছরে চারবার দেশের সরকার পরিবর্তন হয়েছে, কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের নেতৃত্বের পরিবর্তন হয়নি। অথচ এই ১৮ বছরে ১৮ দুগুণে ৩৬ জন ডাকসুর ভিপি-জিএস হতে পারতেন, সারা দেশে কত ছাত্রনেতার জন্ম হতো। আমাদের তো অসংখ্য নেতার প্রয়োজন। সেই নেতৃত্ব আমরা পাব কোথায়? সে জন্যই তো আমরা ডাকসুকে সেকেন্ড পার্লামেন্ট বলি। ডাকসুর পরে যে চাকসু, রাকসু, জাকসু ইত্যাদি—এসবগুলোও তো একেকটা নেতা তৈরির কারখানাই বটে।
দেড় যুগ ধরে ডাকসুর নির্বাচন হলো না কেন? এরশাদের আমলে নির্বাচন হয়নি, তার একটা কারণ বোঝা যায়। কিন্তু তারপর তো নির্বাচিত সরকার এসেছে পরপর দুটি। তারা নির্বাচন দেয়নি কেন? তাদেরও কি পছন্দের ভিত্তিতে তৃণমূল থেকে উঠে আসা নেতৃত্ব পছন্দ নয়? কেন? তারাই না নবীন নেতৃত্বের স্লোগান দেয়। ভবিষ্যত্ রাজনীতি, সংগঠন ও নেতৃত্বের জন্য ছাত্রদের চেয়ে ভালো শক্তি আর কোথায় আছে? অনেক বিতর্কের পর এ কথা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে ছাত্ররাজনীতির নেতির চেয়ে ইতির দিক বেশি। তাহলে এতগুলো বছর পর্যন্ত ডাকসু নির্বাচন হলো না কেন? তার চেয়ে বড় কথা, নির্বাচিত দুটি সরকারের আমলেও এ অবস্থা চলল না কেন।
উপস্থিত ছাত্রনেতারা বক্তৃতা করলেন। তাঁরা সবাই বললেন, ডাকসু নির্বাচন চান। উপাচার্য যে ডাকসু নির্বাচন চান সে কথাও খুব স্পষ্টভাবেই বললেন। দুটি বড় ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগ ও ছাত্রদল একে অপরকে দোষারোপ করার চেষ্টা করল। কিন্তু তারা ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে দ্বিমত করল না। প্রশ্ন খুব স্বাভাবিকভাবেই আসে তা হলো, ডাকসু নির্বাচনটা হচ্ছে না কেন।
স্বাধীনতার পরের প্রথম ডাকসুর ভিপি এবং তত্কালীন ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বললেন মূল্যবান কথা। তিনি বললেন এবং প্রশ্ন করলেন, ‘আপনারা সবাই ডাকসু নির্বাচন চান। ভালো। কিন্তু আপনারা কি হারতে রাজি আছেন? হার মেনে নিতে রাজি আছেন?’ ১৯৭২-এ ডাকসুর ভিপি ছিলেন তিনি (সেই সময় আমি চাকসুর জিএস)। পরের বছর অর্থাত্ ১৯৭৩ সালে ডাকসু নির্বাচনে ছাত্র ইউনিয়ন-মুজিববাদী ছাত্রলীগ যৌথ প্যানেল দিয়েছিল। তাদের প্রতিপক্ষ ছিল জাসদ ছাত্রলীগের মাহবুব-জহুর পরিষদ।
নির্বাচনে ভরাডুবি হয়েছিল লেনিন-গামা যৌথ পরিষদের। তখন পরাজয়ের বেদনা ও গ্লানি মুছতে ডাকসু নির্বাচনের ব্যালটবাক্স হাইজ্যাক করা হয়েছিল। স্বাধীন বাংলাদেশে সেই প্রথম নির্বাচন ছিনতাই, সেই শুরু। মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বললেন সেই ঘটনার কথা। আমি মনোযোগ দিয়ে শুনতে লাগলাম তাঁর কথা।
এই সেই মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, ঢাকা কলেজের মেধাবী ছাত্র, তখন থেকেই ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। ইন্টারমিডিয়েট সেকেন্ড ইয়ারে থাকতেই এক আন্দোলনে যুক্ত থাকার কারণে কলেজের অধ্যক্ষ তাঁকেসহ চারজনকে টিসি দেন। তখন থেকেই সেলিম ভদ্র-মেধাবী ছাত্রনেতা হিসেবে ছাত্রপ্রিয় ছিলেন। আমি তখন ঢাকা কলেজে প্রথম বর্ষে ভর্তি হয়েছি।
’৭৩-এ যখন ডাকসু নির্বাচন হয়, তখন আমি জাসদ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক। তখনো সেলিমকে আমি তাঁর অতীত ভূমিকার জন্য শ্রদ্ধা করি। অথচ সেই সেলিম সাহেব ডাকসু নির্বাচনের পরদিন পত্রিকায় বিবৃতি দিয়েছিলেন, ‘ডাকসুর ব্যালট বাক্স হাইজ্যাক করেছে জাসদ ছাত্রলীগ।’
সেলিম ভাই বললেন, “ডাকসু নির্বাচন হবে যদি আমরা পরাজয় মানতে রাজি থাকি। ’৭৩-এ আমরা পরাজয় মেনে নিতে রাজি ছিলাম না, তাই আমরাই ব্যালটবাক্স ছিনতাই করেছিলাম। আজ আমি আপনাদের সামনে স্বীকার করছি, সে দিন আমরা অন্যায় করেছিলাম। আমি ঘটনা জানতাম না, তাই ঘটনার জন্য জাসদকে দায়ী করে পত্রিকায় বিবৃতি দিয়েছিলাম। আজ আমি এও স্বীকার করছি, আমি ভুল বলেছিলাম। ছিনতাই জাসদ করেনি, করেছিল ছাত্রলীগ।”
তাঁর বাঁয়ে বসেছিল ছাত্রদল আর ডাইনে ছিল ছাত্রলীগ। সেলিম ডানে তাকিয়ে বললেন, ‘আপনারা কিছু মনে করবেন না। আমি আপনাদের কেবল বলছি না। এই যে আপনারা বললেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন সহাবস্থান আছে, সেটা কী? হলে হলে সিট ভাগাভাগি তো। এটাকে সহাবস্থান বলে না, এটা হলো সুবিধা ভাগাভাগি করা, স্বার্থ ভাগাভাগি করা। এটাকে বড়জোর সমঝোতা বলা যায়।’
সেলিম এখন সিপিবির সাধারণ সম্পাদক। সিপিবি দীর্ঘদিন বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বিশ্বস্ত মিত্র ছিল। আওয়ামী লীগের বি-ডিম হিসেবে একটা কুখ্যাতি অর্জন করেছিল দলটি। কিন্তু এখন সিপিবি আওয়ামী লীগের ক্ষমতার ভাগীদার নয়। চিন্তাভাবনা করেই দলটি মহাজোটে যোগদান থেকে বিরত থেকেছে। এখন সিপিবি আওয়ামী লীগ-বিএনপিকে আপদ আর বিপদ মনে করে। তারা মনে করে, বিএনপি জামায়াতের সঙ্গে আঁতাত করেছে। আওয়ামী লীগ খেলাফত আন্দোলনের সঙ্গে জোট গড়েছিল। সেটা এখন আর নেই, কিন্তু ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সঙ্গে মহাজোট এখনো টিকে আছে। সেই এরশাদ এখন প্রস্তাবিত শিক্ষানীতির বিরোধিতা করছেন শিক্ষানীতিতে ধর্ম নেই এই অভিযোগে। সিপিবি এখন বাম জোট নিয়ে কাজ করছে, মহাজোট সরকার গভীর সমুদ্রে গ্যাসক্ষেত্র বিদেশিদের কাছে লিজ দিতে যাচ্ছে—এ অভিযোগে তেল-গ্যাস রক্ষা কমিটির সঙ্গে আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করছে।
আলোচনা শেষে সেলিম ভাইয়ের সঙ্গে সৌজন্য হাসিবিনিময়। ডান হাতের বুড়ো আঙুল উঁচু করে দেখালাম তাঁকে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ঠিক আছে? আমি মাথা নাড়লাম।
আমি মনে করেছিলাম, বড় একটা নিউজ হবে তাঁর বক্তৃতা। কিন্তু পরদিন পত্রিকাগুলোতে তাঁর বক্তব্য পেলাম না।
আমার এক পরিচিত বন্ধু বললেন সিপিবিওয়ালদের কথা। পত্রিকাওয়ালারা মনে হয় বিশ্বাস করতে পারেনি। মনে নেই ’৭২-এ এই মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বঙ্গবন্ধুর ডাকসুর সদস্যপদ বাতিল বলে ঘোষণা করেছিলেন। মতিউল, কাদের গুলিতে মারা গিয়েছিলেন। তারপরও সেলিম সাহেবরা বঙ্গবন্ধুর কাছে গিয়ে মাফ-টাফ চেয়ে নিয়েছিলেন।
কিন্তু ৩১ অক্টোবর জাসদের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত আলোচনা সভায় মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম সেই একই কথা বললেন। তার মানে ’৭৩-এর সেলিম এবং ২০০৯ সালের সেলিম সাহেবকে একইভাবে নেওয়ার উপায় নেই। কিন্তু এবারও কোনো পত্রিকা এটা নিউজ করল না। কেন?
আমি এই বিষয়টা নিয়ে এ জন্য লিখছি যে এটা আমার কাছে মস্ত বড় একটা নিউজ। আমাদের রাজনীতিতে এখন সত্য প্রায় নির্বাসিত। সাহস করে আমরা প্রায় কেউ-ই সত্য কথা বলতে চাই না, মিথ্যাকে অনর্গল চিবাতে থাকি। আমরা অতীতের মধ্যে বসবাস করতে পছন্দ করি, কিন্তু তা থেকে সত্য খুঁজতে যাই না। কারণ আমরা যতই অতীতের ওপর রং লাগাই না কেন, অতীত তার দাঁত বের করে আমাদের ব্যঙ্গ করে। নইলে ১৮ বছরে একবার ডাকসু নির্বাচন হবে না কেন।
আমি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমকে তাঁর ওই বক্তব্যের জন্য ধন্যবাদ জানাই। এ ধরনের অকপট সত্যের স্বীকার মানুষকে বড় করে, রাজনীতিকে বিশ্বাসযোগ্য করে। রাজনীতিকে একটি নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত করে।
প্রাসঙ্গিকভাবে আমি আরেকটি বিষয় এখানে উল্লেখ করতে চাই। তেল-গ্যাস কমিটির আন্দোলনের প্রতি বিএনপি সমর্থন জানিয়েছিল। কিন্তু আন্দোলনকারীরা সে সমর্থন গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানান। তাঁদের বক্তব্য ছিল, বিএনপির এই নৈতিক সমর্থন মানে নীতিগত সমর্থন কি না। তাঁদের মতে, বিএনপিও বর্তমান সরকারের মতোই গ্যাসক্ষেত্র লিজ দেওয়ার পক্ষে। তাঁরা যে এখন তাদের সমর্থন দিচ্ছেন, তা একটি কুটকৌশল মাত্র।
আমাদের রাজনীতিতে এ রকম স্পষ্ট অবস্থান নেওয়ার রেওয়াজ প্রায় উঠে গেছে। আমরা কেবল ক্ষমতা বিবেচনা করি, রাজনীতি বিবর্জিত জোট, মহাজোট গড়ি। রাজনীতিতে নীতিহীনতার চাষ করি। এখানে তেল-গ্যাস কমিটি একটি উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। তাদেরও আন্তরিক অভিনন্দন।
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে একটি অনুরোধ জানিয়ে আমি আমার এ লেখার ইতি টানতে চাই। এই ১৮ বছরে ছয় হাজার ৫৭০ বার সূর্য উঠেছে আর ডুবেছে। কিন্তু ডাকসুর নির্বাচন হয়নি। আমি শুনেছি ইতিমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় পরিবেশ পরিষদ কয়েকবার বসেছে। এখন তো আর ডাকসু নির্বাচন না হওয়ার কোনো কারণ নেই।
মাহমুদুর রহমান মান্না: ডাকসুর সাবেক সভাপতি। রাজনীতিবিদ।

No comments

Powered by Blogger.