আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি -এম এন লারমা স্মরণ by মঙ্গল কুমার চাকমা ও রোবায়েত ফেরদৌস

সাবেক সাংসদ ও জুম্ম জনগণের জাতীয় জাগরণের অগ্রদূত মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার ২৬তম মৃতুবার্ষিকী আজ। সশস্ত্র সংগ্রাম চলাকালে ১৯৮৩ সালের ১০ নভেম্বর বিশ্বাসঘাতকতামূলক অতর্কিত হামলায় তিনি নৃশংসভাবে শাহদাত্বরণ করেন। এম এন লারমাকে হত্যা করা হলেও তাঁর শাশ্বত দর্শন ও বিপ্লবী চেতনাকে নিঃশেষ করা যায়নি। ইতিহাস প্রমাণ করেছে, শহীদ এম এন লারমা জীবন্ত এম এন লারমার চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী, অনেক বেশি দুর্বার। এম এন লারমার ২৬তম মৃত্যুবার্ষিকী পালনসংক্রান্ত জাতীয় কমিটি এ বছর মৃত্যুবার্ষিকীর মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হিসেবে নির্ধারণ করেছে ‘আদিবাসীদের ভূমি অধিকারসহ সাংবিধানিক স্বীকৃতি।’
এম এন লারমার সংগ্রামের অন্যতম অংশ ছিল পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন, আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর সাংবিধানিক স্বীকৃতি ও দেশের অবহেলিত গণমানুষের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠা। পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জাতিগোষ্ঠীকে জাতীয় চেতনায় জাগরিত করে যেভাবে তিনি জুম্ম জনগণের অস্তিত্ব সংরক্ষণের দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন, তা মুক্তিকামী মানুষের কাছে গভীর আগ্রহ সৃষ্টি করেছে। তিনি শুধু পার্বত্য চট্টগ্রামের ভৌগোলিক সীমানার মধ্যে সংকীর্ণ পরিসরে নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেননি। পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আদায়ের পাশাপাশি দেশের শোষিত-বঞ্চিত কৃষক-শ্রমিক-মাঝিমাল্লা-কামার-কুমার-জেলে-তাঁতিদের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও তিনি সর্বদা সোচ্চার ও প্রতিবাদী ছিলেন।
সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশকে নিয়ে তাঁর ছিল অনেক স্বপ্ন ও গভীর ভাবনা। তিনি ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের সংবিধান রচনার সময় তাঁর সেই স্বপ্ন বারবার উচ্চারণ করেছিলেন। তাঁর স্বপ্ন ছিল, দেশের সংবিধান জাতি-ধর্মনির্বিশেষে বাংলাদেশের আপামর জনগণের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ করবে এবং সব ধরনের জাতিগত-শ্রেণীগত নিপীড়ন, শোষণ-বঞ্চনার অবসান ঘটাবে। তাঁর বুকভরা আশা ছিল, সংবিধানে জাতি-শ্রেণীনির্বিশেষে সবারই অধিকার সংরক্ষিত হবে এবং ঔপনিবেশিক অপশাসনের সব কালাকানুন ও দমন-পীড়নের চির অবসান হবে।
তিনি সাংসদ হিসেবে জাতীয় সংসদের ভেতরে ও বাইরে বরাবরই পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর সাংবিধানিক স্বীকৃতি ও স্বায়ত্তশাসন আদায়ে ছিলেন সদা সোচ্চার। পার্বত্য চট্টগ্রামের পৃথক শাসন কাঠামো এবং জুম্ম জনগণের স্বতন্ত্র জাতীয় সত্তা ও বৈশিষ্ট্যের প্রেক্ষাপটে সংবিধানে সংবিধিব্যবস্থা প্রণয়নের জন্য তিনি সংবিধান প্রণয়ন কমিটির কাছে স্বায়ত্তশাসনের দাবি তুলে ধরেন। তিনি ১৬ সদস্যের এক জুম্ম প্রতিনিধিদল নিয়ে তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গেও দেখা করেন। এ ছাড়া তিনি ১৯৭২ সালের ২ নভেম্বর সংবিধান বিলে ‘৪৭ক’ নামের নতুন অনুচ্ছেদের সংযোজনী প্রস্তাব এনে স্বায়ত্তশাসনের দাবি উত্থাপন করেন। ওই সংযোজনী অনুচ্ছেদে তিনি প্রস্তাব করেন: ‘৪৭ক। পার্বত্য চট্টগ্রাম একটি উপজাতীয় অঞ্চল বিধায় উক্ত অঞ্চলের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় অধিকারের নিরাপত্তার জন্য উক্ত অঞ্চল একটি উপজাতীয় স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল হইবে।’ এর পক্ষে ভাষণ দিতে গিয়ে তিনি সেদিন গণপরিষদে ঐতিহাসিক যুক্তি তুলে ধরেন। সে সময় গণপরিষদে তিনি অ-আওয়ামী লীগ ও নির্দলীয় সদস্য হিসেবে কোনোরূপ ভয়ভীতিকে তোয়াক্কা না করে অকুতোভয়চিত্তে পার্বত্য চট্টগ্রামের স্বতন্ত্র শাসনপদ্ধতির পক্ষে তিনি তাঁর ঐতিহাসিক দাবি তুলে ধরেন।কিন্তু সেদিন তত্কালীন শাসকগোষ্ঠীর উগ্র জাতীয়তাবাদী দাম্ভিকতায় জুম্ম জনগণের সব ন্যায্য দাবি প্রত্যাখ্যান করা হয়।
কিন্তু দেশে গণতন্ত্রের বিকাশ, সব জাতিগোষ্ঠীর সাংবিধানিক অধিকার সুনিশ্চিত করা ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনসহ আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর সাংবিধানিক স্বীকৃতি সময়ের দাবিতে বর্তমানে আরও বেশি জরুরি হয়ে পড়েছে। বিগত নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার ‘দিনবদলের সনদ’-এ অঙ্গীকার করা হয়েছে:
‘১৮.১ ধর্মীয় সংখ্যালঘু, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, আদিবাসী ও চা-বাগানে কর্মরত শ্রমজীবী জনগোষ্ঠীর ওপর সন্ত্রাস, বৈষম্যমূলক আচরণ এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের চির অবসান, তাদের জীবন, সম্পদ, সম্ভ্রম, মানমর্যাদার সুরক্ষা এবং রাষ্ট্র ও সমাজ-জীবনের সর্বক্ষেত্রে সমান অধিকারের বাস্তব প্রয়োগ নিশ্চিত করা হবে। আদিবাসীদের জমি, জলাধার এবং বন এলাকায় সনাতনী অধিকার সংরক্ষণের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণসহ ভূমি কমিশন গঠন করা হবে। সংখ্যালঘু, আদিবাসী ও ক্ষুদ্র নৃজাতিগোষ্ঠীর প্রতি বৈষম্যমূলক সকল প্রকার আইন ও অন্যান্য ব্যবস্থার অবসান করা হবে। ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু এবং আদিবাসীদের জন্য চাকরি ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিশেষ সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা হবে। ১৮.২ পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি সম্পূর্ণভাবে বাস্তবায়ন করা হবে। অনগ্রসর অঞ্চলসমূহের উন্নয়নে বর্ধিত উদ্যোগ, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী, আদিবাসী ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের অধিকারের স্বীকৃতি এবং তাদের ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও জীবনধারার স্বাতন্ত্র্য সংরক্ষণ ও তাদের সুষম উন্নয়নের জন্য অগ্রাধিকারভিত্তিক কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা হবে।’
সরকারের ওই নির্বাচনী অঙ্গীকারের প্রেক্ষাপটে আদিবাসীদের ভূমি অধিকারসহ সাংবিধানিক স্বীকৃতির বিষয়টি সময়ের দাবিতে আলোচ্য বিষয়ে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশ একটি বহু জাতির, বহু ভাষার, বহু সংস্কৃতির বৈচিত্র্যপূর্ণ দেশ। এ দেশে বৃহত্তর বাঙালি জনগোষ্ঠী ছাড়াও প্রায় ৪৫টি আদিবাসী ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী স্মরণাতীতকাল থেকে বসবাস করে আসছে। বাংলাদেশের সংবিধানে সরাসরি এসব জনগোষ্ঠীর স্বীকৃতি নেই। কিন্তু বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সংহতি, উন্নয়ন, গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের নিরিখে এসব জাতির সাংবিধানিক স্বীকৃতির বিষয়টি যারপরনাই জরুরি। আমাদের দাবি তাই স্পষ্ট: ক. সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে ৪৫টি আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জাতিসত্তা, ভাষা ও সংস্কৃতিসহ সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেওয়া হোক। খ. সংবিধানের ২৮ অনুচ্ছেদের ৪ উপ-অনুচ্ছেদের প্রারম্ভে ‘দেশের আদিবাসী জাতিগোষ্ঠী বা’ শব্দগুলো সন্নিবেশ করা হোক এবং এই অনুচ্ছেদের আওতায় সংবিধানে নতুন তফসিল সংযোজন করে আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর নামের তালিকা সন্নিবেশ করা হোক। গ. সংবিধানের ৪৭(১)(চ) অনুচ্ছেদের পর নিম্নলিখিত দফা (ছ) সংযোজন করা হোক—‘পার্বত্য চট্টগ্রাম একটি আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চল বিধায় উক্ত অঞ্চলের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় অধিকারের নিরাপত্তার জন্য উক্ত অঞ্চল একটি আদিবাসী বিশেষ শাসিত অঞ্চল হইবে।’ ঘ. পার্বত্যাঞ্চলের তিনটি সংসদীয় আসনসহ দেশের আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোতে আদিবাসীদের জন্য জাতীয় সংসদ ও স্থানীয় সরকার পরিষদে আসন সংরক্ষণ করা হোক। ঙ. আদিবাসী অধিকারসংক্রান্ত আন্তর্জাতিক চুক্তি মোতাবেক আদিবাসীদের ঐতিহ্যগত ভূমি অধিকারের সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেওয়া হোক।
মঙ্গল কুমার চাকমা: তথ্য ও প্রচার সম্পাদক, পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি।
রোবায়েত ফেরদৌস: শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.