জাতীয় নিরাপত্তা ও বহির্বিশ্বে ভাবমূর্তি যেন ক্ষুণ্ন না হয় -বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক জঙ্গি

বাংলাদেশে তত্পর বিভিন্ন ইসলামি জঙ্গিবাদী সংগঠনের সঙ্গে আন্তর্জাতিক জঙ্গিবাদের নিবিড় সম্পর্ক ও যোগাযোগ রয়েছে, এমন খবর দেশি-বিদেশি সংবাদমাধ্যমে মাঝেমধ্যেই প্রকাশিত হয়। প্রথম আলোর নিজস্ব অনুসন্ধানেও এমন তথ্য বেরিয়ে এসেছে: বাংলাদেশের জঙ্গিদের অনেকেই আফগানিস্তানে গিয়ে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন, অনেক জঙ্গি সংগঠনের অর্থের জোগান আসে বিদেশ থেকে। আরেকটি উল্লেখযোগ্য ও বিপজ্জনক তথ্য হচ্ছে, বিদেশি জঙ্গিরাও এ দেশে অবস্থান করে স্থানীয় জঙ্গিদের জিহাদি শিক্ষা ও অস্ত্রচালনা এবং শারীরিক প্রশিক্ষণ দেয়, নাশকতামূলক তত্পরতার ষড়যন্ত্র করে। সম্প্রতি ঢাকার মার্কিন দূতাবাসে জঙ্গি হামলার পরিকল্পনা ফাঁস হওয়া এবং সন্দেহভাজন তিন জঙ্গি আটকের পর গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্য থেকে এ দেশে বিদেশি জঙ্গিদের অবস্থান ও তত্পরতার আরও একটি প্রমাণ মিলল।
এর আগে গত মে মাসে ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত মাফিয়া নেতা দাউদ ইব্রাহিমের দুবাইভিত্তিক অপরাধচক্রের দুই সদস্য দাউদ মার্চেন্ট ও জাহিদ শেখ, যাঁদের সঙ্গে ধর্মীয় জঙ্গিবাদের যোগাযোগ ধরা পড়ে। তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদের ভিত্তিতে পুলিশ প্রায় দেড় মাস অনুসন্ধান চালিয়ে জুলাই মাসে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয় দুর্ধর্ষ ভারতীয় জঙ্গি ওবায়দুল্লাহকে। তিনি ভারতীয় নাগরিক। আফগানিস্তানে গিয়ে ভারী মেশিনগান, বিমানবিধ্বংসী কামান, রকেট লঞ্চার, মর্টারশেল নিক্ষেপসহ নানা ধরনের সমরাস্ত্র পরিচালনায় প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন এবং বাংলাদেশের মাদারীপুরের শিবচরে একটি মাদ্রাসায় ‘জিহাদি ভাই’ গড়ে তোলার কাজে লিপ্ত ছিলেন কয়েক বছর ধরে। পাকিস্তানভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন লস্কর-ই-তাইয়েবা ও ভারতীয় জঙ্গি সংগঠন আসিফ রেজা কমান্ডো ফোর্সের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ। একই সংগঠনের আরেক জঙ্গি মনসুর আলী ওরফে হাবিবুল্লাহও জুলাই মাসেই ঢাকায় গ্রেপ্তার হন। এমদাদুল্লাহ নামে আরেক ভারতীয় জঙ্গি ঢাকায় গ্রেপ্তার হন সেপ্টেম্বরের শেষে।
বাংলাদেশে বিদেশি জঙ্গিদের তত্পরতার বিষয়টির দুটি তাত্পর্য আছে, যা অনুধাবন করা আমাদের জন্য খুব জরুরি। প্রথমত, আন্তর্জাতিক জঙ্গিবাদের সঙ্গে জড়িত উপাদানগুলো বাংলাদেশের ভূখণ্ডের ভেতর অবস্থান নিয়ে তত্পর হলে আমাদের জাতীয় নিরাপত্তা হুমকির মুখোমুখি হতে পারে, জনজীবনের স্বাভাবিক শান্তি-শৃঙ্খলা নষ্ট হতে পারে, জনমনে সৃষ্টি হতে পারে নিরাপত্তার অভাববোধ; মুক্তভাবে চলাফেরা ও জীবন-জীবিকা আহরণের জন্য যে স্বাভাবিক শান্তিপূর্ণ নিরুদ্বেগ পরিবেশ অপরিহার্য, তা ক্ষুণ্ন হতে পারে। এসব বিবেচনায় এটি কেবল আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির বিষয় নয়, জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়।
দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশে ইসলামের নামে জঙ্গিবাদী তত্পরতা চলছে—এমন নেতিবাচক ভাবমূর্তি কিছুটা ইতিমধ্যে ছড়িয়েছে বহির্বিশ্বে। এর সঙ্গে যদি এটা যুক্ত হয় যে শুধু স্থানীয় জঙ্গিরাই এখানে তত্পর নয়, বিভিন্ন দেশের জঙ্গিরাও এ দেশে আশ্রয় নিতে এবং তত্পরতা চালাতে পারছে—তাহলে আমাদের ভাবমূর্তি আরও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বহির্বিশ্বে আমাদের ভাবমূর্তির বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ: ব্যবসা-বাণিজ্য, জনশক্তি রপ্তানি, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশি নাগরিকদের ভ্রমণ, প্রবাসী বাংলাদেশিদের সংশ্লিষ্ট দেশে মর্যাদা—সবকিছুর ওপরই দেশের ভাবমূর্তির প্রভাব পড়ে। আফগানিস্তান বা পাকিস্তানের মতো ভাবমূর্তি বাংলাদেশের প্রাপ্য নয়, প্রত্যাশিতও নয়।
যদিও জঙ্গিবাদ দমনের ব্যাপারে সরকারের তত্পরতা লক্ষণীয়, তবু পুরোপুরি শঙ্কামুক্ত হওয়া যায় না। কারণ, জঙ্গিবাদী তত্পরতায় লিপ্ত সংগঠন ও তাদের সদস্যদের ব্যাপকতার যে আভাস গোয়েন্দা সূত্রেই পাওয়া যায়, গ্রেপ্তারের সংখ্যা সে তুলনায় বেশ কম। এ ছাড়া, গোয়েন্দা-পুলিশের জানার বাইরেও তো গোপন জঙ্গি আস্তানা থেকে থাকতে পারে। জঙ্গি দমন তত্পরতা তাই আরও ব্যাপক ও কঠোর উদ্যোগ দাবি করে।

No comments

Powered by Blogger.