বার্লিন দেয়ালের পতন -স্নায়ুযুদ্ধের অবসান -মিখাইল গর্বাচেভ

সোভিয়েত ইউনিয়নে পিরিস্ত্রোইকার ফলে বার্লিন দেয়ালের পতন ও ইউরোপের বিভক্তির অবসান ঘটে। ১৯৮৯ সালের মার্চ মাসে সোভিয়েত ইউনিয়নে গণতান্ত্রিক পরিবর্তন এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে রাশিয়ার ইতিহাসে প্রথমবারের মতো গণতান্ত্রিক, প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নতুন সোভিয়েত কংগ্রেস গড়ার জন্য নির্বাচনে জনগণ বিপুল উদ্দীপনাসহকারে অংশ নেয়। কমিউনিস্ট পার্টির ৩৫ জন আঞ্চলিক সম্পাদক পরাজিত হন। অবশ্য সহযোগী হিসেবে নির্বাচিত ব্যক্তিদের ৮৪ শতাংশ ছিল কমিউনিস্ট। কারণ দলে তখন ছিল অনেক সাধারণ মানুষ।
নির্বাচনের পরদিন আমি পলিটব্যুরোর সঙ্গে বৈঠকে বসি। তাঁদের অভিনন্দন জানাই। তাঁরা খুব বিপর্যস্ত ছিলেন। কয়েকজন বললেন, ‘কিসের জন্য অভিনন্দন?’ আমি বলি, ‘এ নির্বাচনে পিরিস্ত্রোইকার জয় হয়েছে। আমরা জনগণের জীবনকে ছুঁতে পারছি। এখন তারা কঠিন সময় অতিক্রম করছে, তবুও তারা কমিউনিস্টদের ভোট দিয়েছে।’ এ নির্বাচনগুলো খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। বোঝা যাচ্ছিল গণতন্ত্র, গ্লাসনস্ত, বহুত্ববাদের দিকে আমাদের আন্দোলন জারি আছে।
পূর্ব ও মধ্য ইউরোপে সেই সময় একই ধরনের প্রক্রিয়া ছিল। ১৯৮৫ সালের মার্চ মাসের যেদিন আমি সোভিয়েতের নেতৃত্ব গ্রহণ করি, সেদিন ওয়ারশ জোটভুক্ত দেশের নেতাদের সঙ্গে আমার বিশেষ বৈঠক ছিল। আমি তাঁদের উদ্দেশে বললাম, ‘আপনারা স্বাধীন, আমরাও স্বাধীন। আপনাদের নীতিমালার দায় আপনাদের, আমাদের নীতিমালার দায় আমাদের। আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, আপনাদের কাজে আমরা হস্তক্ষেপ করব না।’ আমরা প্রতিশ্রুতি রেখেছিলাম। আমরা হস্তক্ষেপ করিনি, একবারের জন্যও নয়; এমনকি একসময় তাঁরা আমাদের হস্তক্ষেপ করার আহ্বান জানানোর পরও না। তাঁদের সমাজ পিরিস্ত্রোইকার প্রভাবে নিজে থেকেই ক্রিয়া করতে শুরু করে। সোভিয়েতের যে গণতান্ত্রিক রূপান্তর প্রয়োজনীয় ছিল, সেটি এই পিরিস্ত্রোইকা। মধ্য ও পূর্ব ইউরোপে আমার হস্তক্ষেপ না করার নীতি খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। একবার ভেবে দেখুন, শুধু পূর্ব জার্মানিতে ছিল তিন লাখ সোভিয়েত সেনা। তারা বিশেষভাবে বাছাই করা ও অস্ত্রসজ্জিত। তবুও সেখানে পরিবর্তনের প্রক্রিয়া শুরু হলো। অন্য দেশগুলোতেও পরিবর্তন ঘটতে লাগল।
কিন্তু বিভক্ত জার্মানির সমস্যা রয়েই গেল। এ অবস্থাকে জার্মান জনগণ স্বাভাবিক মনে করেনি। আমার কাছেও এটি স্বাভাবিক মনে হতো না। পশ্চিম ও পূর্ব জার্মানিতে তখন নতুন সরকার ক্ষমতাসীন হয়, তাদের মধ্যে সম্পর্কেও পরিবর্তন আসে। পূর্ব জার্মানির নেতা এরিক হনেকার এতটা একগুঁয়ে না হলে গণতান্ত্রিক পরিবর্তনের সূচনা করতে পারতেন। তাঁর একগুঁয়েমির জন্য আমাকে অনেক ভুগতে হয়েছে। কিন্তু তিনি পূর্ব জার্মানিতে নিজেদের পিরিস্ত্রোইকা শুরু করেননি। ফলে তাঁদের দেশে লড়াই ছড়িয়ে পড়ে।
জার্মানরা জাতি হিসেবে খুব দক্ষ। হিটলারের অধীনে এবং পরে তারা যে অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গেছে, তার পরও এক নতুন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে। হনেকার যদি তাঁর জনগণের সামর্থ্যের সুযোগ নিয়ে গণতান্ত্রিক ও অর্থনৈতিক সংস্কার শুরু করতেন, তাহলে পরিণতি অনেক অন্য রকম হতে পারত।
আমার সামনে আমি এসব ঘটেতে দেখেছি। ১৯৮৯ সলের ৭ অক্টোবর পূর্ব জার্মানিতে হনেকারের সঙ্গে আমি ও ওয়ারশ জোটভুক্ত দেশগুলোর প্রতিনিধিরা এক কুচকাওয়াজ পরিদর্শন করছিলাম। কাছেই পূর্ব জার্মানির ২৮টি অঞ্চল থেকে আসা গ্রুপ মশাল ও স্লোগানসংবলিত ব্যানার হাতে মিছিল করতে করতে এগিয়ে যাচ্ছিল। পোল্যান্ডের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মিয়েজেস্লাভ রাকভস্কি জানতে চান আমি জার্মান বুঝি কি না। আমি বলি, ‘ব্যানারে কী লেখা, সেটা বোঝার মতো জানি। পিরিস্ত্রোইকার কথা আছে তাতে। তারা গণতন্ত্র আর পরিবর্তনের কথা বলছে। তারা বলছে, গর্বাচেভ, আমাদের দেশে অবস্থান করুন!’ তখন রাকভস্কি বলেন, ‘এঁরা পূর্ব জার্মানির ২৮টি অঞ্চলের জনগণের সত্যিকারের প্রতিনিধি হয়ে থাকলে, এর অর্থ হলো দিন ঘনিয়ে আসছে।’ আমারও তেমনটাই মনে হয়েছিল।
১৯৮৯ সালের মার্চ মাসে সোভিয়েত নির্বাচনের পর বার্লিন দেয়ালের পতন অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে।
১৯৮৯ সালের জুন মাসে পশ্চিম জার্মানির চ্যান্সেলর হেলমুট কোহলের সঙ্গে আমার সাক্ষাতের পর এক সংবাদ সম্মেলনে জানতে চাওয়া হয়, জার্মান প্রশ্নে আলোচনা হয়েছে কি না? আমার উত্তরটা ছিল, ‘ইতিহাস এটি তৈরি করেছে, আর ইতিহাসই তার সমাধান বাতলাবে।’
পূর্ব জার্মানির কমিউনিস্ট নেতাদের সঙ্গে সাক্ষাতে আমি তাঁদের আবারও বলি, ‘এ বিষয়টি আপনাদের নিজস্ব, সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্বও আপনাদের।’ আমি তাঁদের সতর্ক করি, ‘ইতিহাসের শিক্ষা কী? কাজে যে দেরি করে সে ঠকে।’ তারা যদি সংস্কারের, পরিবর্তনের পথে হাঁটত, জার্মানির দুই অংশের মধ্যে কোনো ধরনের সমঝোতা বা চুক্তি থাকত, তবে ধীরে ধীরে জার্মানির একত্রীকরণ ঘটানো যেত। কিন্তু ১৯৮৯-৯০ সালের দিকে পূর্ব ও পশ্চিম উভয় অংশের জার্মানরা তখনই একত্রীকরণের কথা জোরেশোরে বলতে শুরু করে। তাদের ভয় ছিল এ সুযোগ যদি আর না আসে।
১৯৮৫-৮৮ সময়কালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান ও আমি যদি নিরস্ত্রীকরণ চুক্তি স্বাক্ষর ও আমাদের সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণে সফল না হতাম, তবে পরের এই অগ্রগতিগুলো অচিন্ত্যনীয় হতো। এগুলোও সম্ভব হতো না, যদি না সোভিয়েত ইউনিয়নে আমরা আগেই পিরিস্ত্রোইকা শুরু করতাম। পিরিস্ত্রোইকা না হলে স্নায়ুযুদ্ধের অবসান ঘটতই না। এরপর কিন্তু পারমাণবিক যুদ্ধের হুমকি পুরোদস্তুর জারি থাকার কারণে দুনিয়া বেশি দূর এগোতে পারেনি।
অনেকে জানতে চায়, কেন আমি পিরিস্ত্রোইকা শুরু করেছিলাম। কারণগুলো কি প্রধানত অভ্যন্তরীণ, না বৈদেশিক? অভ্যন্তরীণ কারণ অবশ্যই প্রধান ছিল, কিন্তু পারমাণবিক যুদ্ধের শঙ্কা এত গুরুতর ছিল যে এটির তাত্পর্যও কম ছিল না। নিজেদের ধ্বংস করে ফেলার আগে কিছু একটা করতে হবে তো। এ কারণেই আমি ও রিগ্যান যেসব বড় পরিবর্তন ঘটিয়েছিলাম, সেগুলো এত গুরুত্বপূর্ণ। রিগ্যানের উত্তরসূরি জর্জ এইচ ডব্লিউ বুশ এ প্রক্রিয়া অব্যাহত রেখেছিলেন। এটাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। ১৯৮৯ সালের ডিসেম্বরে মাল্টায় আমরা ঘোষণা করি, আমরা আর পরস্পরের শত্রু বা বৈরী নই। এর মধ্য দিয়েই স্নায়ুযুদ্ধের অবসান ঘটে। এ বিষয়ে ইতিহাসবিদেরা একমত নাও হতে পারেন। তাঁরা তাঁদের মতো ভাবুন। কিন্তু যে ঘটনাগুলো আমি এখানে বললাম, এগুলো না ঘটলে স্নায়ুযুদ্ধের অবসান ঘটত না।
রিগ্যান আর আমি ঐতিহাসিক সমঝোতায় পৌঁছাই। মতাদর্শিক অবস্থানের ঊর্ধ্বে কিছু বিষয় থাকে। ১৯৮৫ সালে জেনেভায় আমরা যৌথভাবে ঘোষণা করি, ‘পারমাণবিক যুদ্ধ অগ্রহণযোগ্য, এতে কেউ জয়ী হতে পারে না।’ ১৯৮৬ সালে রিকিয়াভিকে পারমাণবিক অস্ত্র ধ্বংস করা উচিত এ বিষয়ে আমরা মতৈক্যে পৌঁছি। স্নায়ুযুদ্ধের অবসান ঘটাতে হবে, এমন ভাবনা উভয় পক্ষেই তখন জোরদার হচ্ছিল।
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের মধ্য দিয়েই স্নায়ুযুদ্ধের অবসান ঘটেছে, এ দাবি ঠিক নয়। যুক্তরাষ্ট্রের অনেক সাংবাদিক, রাজনীতিক ও ইতিহাসবিদ মনে করেন, স্নায়ুযুদ্ধে আমেরিকা জয়লাভ করেছে; এটি ঠিক নয়। সোভিয়েত ইউনিয়নে নতুন নেতৃত্বে না এলে এবং নতুন বৈদেশিক নীতি গ্রহণ না করলে এসবের কিছুই ঘটত না। স্নায়ুযুদ্ধের অবসান কোনো একক ঘটনা নয়, এটি একটি প্রক্রিয়া। বুশ ও আমি মাল্টায় বৈরিতা অবসানের ঘোষণা দিয়েছি, কিন্তু রিগ্যানের ভূমিকাও ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের সঙ্গে সঙ্গে রিগ্যানের মনোভাবের মৌলিক পরিবর্তন ঘটেছিল। অতএব, আমরা সবাই বিজয়ী। আমরা সবাই স্নায়ুযুদ্ধে জয়লাভ করেছিলাম। স্নায়ুযুদ্ধের জন্য উভয় পক্ষের প্রতিবছর ১০ ট্রিলিয়ন ডলার করে ব্যয় করা তো আমরা বন্ধ করতে সক্ষম হয়েছিলাম।
যুক্তরাষ্ট্রের দ্য নেশন পত্রিকায় প্রকাশিত সাক্ষাত্কার থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ: আহসান হাবীব
মিখাইল গর্বাচেভ: সোভিয়েত ইউনিয়নের সাবেক প্রেসিডেন্ট।

No comments

Powered by Blogger.