ইতিহাস, উপন্যাস ও হাফ-আখড়াই -সহজিয়া কড়চা by সৈয়দ আবুল মকসুদ

মুখবন্ধ: বিপ্লবের নিচে বাঙালি নামতে পারে না। বিপ্লবের চেয়ে ছোট কিছুতে সে সন্তুষ্ট নয়। গণতন্ত্রী হোক আর কমিউনিস্ট হোক, সমাজবাদী হোক আর ইসলামবাদী হোক—সবাই বিপ্লববাদী। ফরাসি দেশে বিপ্লব হয়েছিল মাত্র একবার, রুশ দেশে বিপ্লব হয়েছিল স্রেফ একটি, চীনে বিপ্লব হয়েছিল কোনো রকমে একখানা। ভিয়েতনামিরা বিপ্লবের কথা মুখ দিয়েও আনে না। ভারতে কোনো বিপ্লব হয়নি। ব্রিটেনে বিপ্লবের প্রয়োজন হয়নি, জার্মানিতে হয়নি, জাপানে বিপ্লব শব্দটি বোধ হয় প্রচলিতই নয়, মালয়েশিয়ায় বিপ্লবের কোনো প্রয়োজনই নেই।
বাংলাদেশে প্রথম বিপ্লব কবে হয়েছিল তা কেউ জানে না, হঠাত্ একদিন শুনলাম ‘দ্বিতীয় বিপ্লব’ শুরু হচ্ছে। কিন্তু অনেকের দ্বিতীয় বিপ্লবেও মন ভরল না। মধ্য-আগস্টে তারা ঘটিয়ে দিল তৃতীয় বিপ্লব। সেটা আনফিনিশড্ বা অসমাপ্ত থাকতেই নভেম্বরের প্রথম হপ্তায় ঘটে গেল বিপ্লব তিনটি: একটি ৩ নভেম্বর আর একটি ৬ নভেম্বর এবং পরিপূর্ণটি ৭ নভেম্বর। অর্থাত্ ’৭১ থেকে ’৭৫-এর ৭ নভেম্বর পর্যন্ত বিপ্লব হলো সাকল্যে ২+৩=৫টি।
নভেম্বরের বিপ্লবগুলো বাংলাদেশের ইতিহাসের অংশ। সুতরাং নভেম্বরের বিপ্লবত্রয় নিয়ে রোমাঞ্চকর ত্রিলজি রচিত হতেই পারে। ফি-বছর ইতিহাস পর্যালোচিত হওয়া অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু তা হচ্ছে না। বঙ্কিমচন্দ্রের ভাষায়, ইতিহাসের বিষয়বস্তু নিয়ে ইতিহাস লেখা হচ্ছে না—রচিত হচ্ছে উপন্যাস। ইতিহাসের বিষয়বস্তু নিয়ে ঐতিহাসিক উপন্যাসও রচিত হতে পারে। কিন্তু যা হচ্ছে তা আসলে উপন্যাসও নয়, রচিত হচ্ছে আখড়াই বা হাফ-আখড়াই। উনিশ শতকে কলকাতা ও তার আশপাশে যেমন আসর বসত আখড়াইয়ের, নভেম্বর নিয়েও বাংলাদেশের কাগজগুলোয় বসেছে পাঁচালি ও আখড়াইয়ের আসর—শুধু রমণীঘটিত আদিরসাত্মক উপদানটুকু অনুপস্থিত। একদল ৩ তারিখের মহাবীর খালেদ বিন ওয়ালিদের পাঁচালি গাইছে, আর একদল ৭ তারিখের বীরকে চে গুয়েভারার সারিতে নিয়ে বসিয়ে দিচ্ছে। একশ্রেণীর কলাম লেখক বলছেন, ৭ তারিখ থেকে ‘প্রথম ও শেষ বাংলাদেশ’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে; আর একদল উপসম্পাদকীয় রচনা লেখক অব্যাহত গাইছে: পনেরোই আগস্টের আগে ‘কি সুন্দর দিন কাটাইতাম’।
আমেরিকার স্টেট ডিপার্টমেন্টের তিরিশ বছর পরপর অবমুক্ত করা দলিলপত্র নিয়ে বিশ্বব্যাপী রচনা লেখা হয়। বাংলাদেশও একটা স্টেট। এই স্টেটেরও রয়েছে নানা দলিলপত্র। সেগুলো অবমুক্ত করাই আছে। জোগাড় করে সেগুলোর বক্তব্য দিয়ে রচনা লেখা সম্ভব। আমেরিকার সঙ্গে আমার ভাব নেই বলে বাংলাদেশের কাগজপত্রের ওপরই আমি নির্ভর করতে চাই। পঁচাত্তর-পূর্ববর্তী ও পরবর্তী কিছু লিফলেট আমার রচনার মূল উপাদান। অর্থাত্ আমার কথা কম, লিফলেটের কথাই বেশি। আমি ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি এ জন্য যে লেখাটি হবে উদ্ধৃতিনির্ভর।
প্রথম পরিচ্ছেদ: পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে ছয় দফা দিয়ে বঙ্গবন্ধু বিশেষভাবে আগরতলা মামলার পর থেকে অসাধারণ জনপ্রিয়তা অর্জন করলেও তাঁর খুব ছোট অথচ শক্তিশালী প্রতিপক্ষও ছিল। সেই প্রতিপক্ষ ছিল ডানে এবং বাঁয়ে। ষোলোই ডিসেম্বর পাকিস্তানিদের পতন হলেও আওয়ামী লীগ সরকারের ওই প্রতিপক্ষগুলো থেকেই যায়। যখন সবাইকে নিয়ে একটি সদ্যস্বাধীন রাষ্ট্রে সংহত জাতি গঠনের কোনো উদ্যোগ দেখা গেল না, তখন ওই বাম ও ডান শক্তিগুলো আরও শক্তিশালী হতে থাকে। তারই পরিণতিতে বিনা বাধায় ঘটতে পারে পনেরোই আগস্টের মতো নির্মম ঘটনা। ১৯৭২-৭৫ সময়ের রাজনৈতিক দ্বন্দ্বগুলো বিশ্লেষণ করলেই তা বোঝা সহজ হবে। তখনকার রাজনৈতিক স্রোতের পরিচয় পাওয়ার উপায় সে সময়ের সংবাদপত্র ও প্রচারপত্র পর্যালোচনা করা। ওই সময়ের দৈনিক গণকণ্ঠ, জনপদ ও বঙ্গবার্তা-র নির্বাচিত লেখার একটি সংকলন আগামী বইমেলার সময় প্রকাশের সম্ভাবনা আছে। তবে বিভিন্ন রাজনৈতিক গোষ্ঠীর প্রচারপত্র আরও নির্ভরযোগ্য। হাজার দেড়েক লিফলেটের সংগ্রহ আমার কাছে আছে, তার থেকে সামান্য কিছু উদ্ধৃতি দেওয়া যাবে।
আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ হলেও জামায়াত, মুসলিম লীগ প্রভৃতি পাকিস্তানপন্থী ছাড়া ডান-বাম প্রায় সব দলই কমবেশি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়। স্বাধীনতার পর সরকার সেই দলগুলোকে মূল্যায়ন করেনি। দেশ গঠনে তাদের সহযোগিতা গ্রহণ করেনি। ফলে স্বাধীনতার সপক্ষের ওই সব দলও সরকারের প্রতিপক্ষে পরিণত হয়। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, ন্যাপ (মো), ছাত্র ইউনিয়ন সরকারের ঘনিষ্ঠ মিত্র ছিল। তাদেরও অগ্রাহ্য করা হয়। ১৯৭২ সালের ২০ মে অনুষ্ঠিতব্য ডাকসু নির্বাচনের কয়েকদিন আগে ‘অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ন্যায়সংগত’ শীর্ষক এক প্রচারপত্রে বাংলা ছাত্র ইউনিয়ন লিখেছিল:
‘বাংলাদেশ পাকিস্তানী ঔপনিবেশিকদের শাসন ও শোষণের কবল থেকে মুক্ত হয়েছে বটে, কিন্তু আজো আমাদের দেশে বৈদেশিক প্রভুত্ব, পররাজ্য লোভীদের বল্গাহীন উলঙ্গ শোষণ, সাম্রাজ্যবাদীদের কুটিল চক্রান্তের ফাঁদ, আমলাতন্ত্রের জুলুম ও নির্যাতন, লোভী-ব্যবসায়ী মজুতদার ও মুনাফাখোরদের শোষণ, চোরাচালান ও চোরাকারবারীদের সীমান্তের মধ্য দিয়ে সম্পত্তি পাচার, জোতদার মহাজনদের কৃষকের ওপর নির্দয় শোষণ, স্বাধীন মত প্রকাশে কণ্ঠরোধ, ফ্যাসিবাদের ভয়াল ভ্রূকুটি, শ্রমিকের কৃষকের রক্তপাত, রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে প্রাণনাশ, মা-বোনের অশ্রুজল, পিতার বক্ষে বিদীর্ণ হাহাকার, ক্ষুধাতুর শিশুদের দুমুঠো অন্নের আহাজারী, বেকারত্বের অভিশাপ, ...অনাগত জীবনের অনিশ্চয়তা আজো অব্যাহত রয়েছে। সমাজতন্ত্রের বুলি কপচিয়ে একশ্রেণীর রাজনীতিকরা জনগণকে ক্রমাগতভাবে ভাঁওতা দিয়ে যাচ্ছে। কৃষক শ্রমিক রাজ কায়েম হয়ে গেছে—এই আপ্তবাক্য উচ্চারণ করে কেউ আত্মপ্রসাদ লাভ করতে পারেন, কিন্তু এতে জনগণের উদরপূর্তি হয় না।’
শেষ করা হয়েছিল কয়েকটি স্লোগান দিয়ে: ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’, ‘বাংলাদেশ-ভারতের সর্বহারা মানুষের ঐক্য জিন্দাবাদ’, ‘মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ধ্বংস হোক’, ‘জয় হোক জনতার’ প্রভৃতি। আজকাল প্রায়ই বলা হয় ‘জিন্দাবাদ’ শব্দটিকে একাত্তরে কবর দেওয়া হয়েছে, কিন্তু দেখা যাচ্ছে স্বাধীনতার পরেও বাম সংগঠনগুলোও ‘জিন্দাবাদ’ ব্যবহার করেছে।
স্বাধীনতার কয়েক মাস পরেই বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি দেবেন সিকদার ও সম্পাদক আবুল বাসার ‘ব্যর্থ অযোগ্য সরকারকে উত্খাত কর’ শীর্ষক এক প্রচারপত্রে সরকারের অযোগ্যতা ও ব্যর্থতার দীর্ঘ তালিকা দিয়ে বলেন, ‘অযোগ্য, ব্যর্থ, পুতুল সরকারের কীর্তিকলাপে অতিষ্ঠ হয়ে জনগণ তার অবসান চায়, এর পদত্যাগ দাবী করছে। বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি মনে করে আবেদন নিবেদনে এর ইতি হবে না, মানুষের দুঃখ-দুর্দশার অবসান হবে না। একে উত্খাত করতে হবে আপোসহীন সংগ্রাম করে বিপ্লবের মাধ্যমে।
‘...শোষণহীন সমাজ বা সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার যে ফাঁকা বুলি আওয়ামী লীগ দিচ্ছে, তা জনগণকে শোষণের নূতন জালে বাঁধা ছাড়া আর কিছুই নয়।’
মেজর এম এ জলিল ‘সংগ্রামী মুক্তিযোদ্ধা ও দেশবাসীর প্রতি আবেদনে’ বাহাত্তরের ১৬ ডিসেম্বরের আগেই বলেন: ‘লে. কর্নেল জিয়াউদ্দিনকে ও লে. কর্নেল তাহেরকে আর্মি থেকে বিনা বিচারে dismiss করা হয়েছে। অন্যায়, অবিচার ও দুর্নীতির একটা সীমা থাকে বঙ্গবন্ধু। হয়তো এইভাবে ধীরে ধীরে একদিন বাংলার গোটা সামরিক বাহিনী স্তিমিত হয়ে যাবে। কিন্তু কেন? এটা কি তা হলে তোমার ক্ষমতা লোভের প্রকাশ, না কোনো বন্ধু মহলের কু ইঙ্গিত। ...হক কথা, মুখপত্র, স্পোকম্যান ও বাংলার মুখকে তুমি বন্ধ করেছো। তুমি বাংলার মানুষকে ভালোভাবেই চেনো, পারবে কি তুমি সাড়ে সাত কোটি মানুষের বলিষ্ঠ কণ্ঠকে রুদ্ধ করে আইয়ুব ও ইয়াহিয়ার মতো একনায়কের শোষণ চালাতে। অসম্ভব। তোমার স্বপ্ন হয়তো আগামী দিনেই ভেঙে যাবে।’
এভাবেই তৈরি হচ্ছিল জনমত ও পনেরোই আগস্টের পটভূমি। সরকার সতর্কতা অবলম্বনের প্রয়োজন মনে করেনি। কঠিন ভাষায় নির্বাচন বর্জনের ডাক দিয়ে ২৪/১২/৭২ ‘সশস্ত্র জাতীয় বিপ্লবী যুদ্ধকে এগিয়ে নিয়ে’ আসার আহ্বান জানায় পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী)। তাঁরা ‘দখলদারী সোভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ ও তাদের আজ্ঞাবহ ভারতীয় সম্প্রসারণবাদকে উচ্ছেদ’ এবং ‘মুজিবের পুতুল সরকারকে উচ্ছেদ’ করার আহ্বান জানান। নির্বাচন বর্জনের ডাক আসে আরও অনেকগুলো কমিউনিস্ট গ্রুপ থেকে। ’৭৩-এ আ ফ ম মাহবুবুল হক (সভাপতি) ও মাহমুদুর রহমান মান্নার (সাধারণ সম্পাদক) ছাত্রলীগের প্রচারপত্রগুলোর ভাষাও বিপ্লবাত্মক ও সরকার উত্খাতের অঙ্গীকারে পরিপূর্ণ।
১৯৭৪ সালে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের সরকারবিরোধী তত্পরতা খুবই বলিষ্ঠ ছিল। ২৬ এপ্রিল দেশব্যাপী গণবিক্ষোভ দিবসের আগে এক প্রচারপত্রে বলা হয়: ‘ভারত-রুশ-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের কবলে পড়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব আজ বিপন্ন। প্রতি বছর শত শত কোটি টাকার পাট, চামড়া, চাউল, মাছ ও অন্যান্য আমদানিকৃত দ্রব্য পাচার হয়ে যাচ্ছে সীমান্তের ওপারে।’
জাসদের শক্তিকে সরকার খুব ছোট করে দেখে বিরাট ভুল করে। বামপন্থীদের দিক থেকে যখন সরকার ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলন চলছিল, তখন নিষিদ্ধঘোষিত ইসলামি দলগুলোও বসে ছিল না। জামায়াত গোপনে ছাত্রসমাজের মধ্যে কাজ করছিল। ১৯৭৫ সালের ১২ মার্চ একদলীয় শাসনের মধ্যে ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র মিলনায়তনে সিরাতুন্নবী উপলক্ষে এক সেমিনারের আয়োজন করা হয়। আয়োজক ‘বাংলাদেশ ছাত্র ইসলামী মিশন’। মিশনের সভাপতি মুহম্মদ আবু তাহের এক প্রচারপত্রে প্রশ্ন রাখেন, ‘আমাদের (মুসলমানদের) এ দুরবস্থা কেন?’ জবাবে তিনি বলেন: “আমাদের সামনে এ জিজ্ঞাসার জবাব নিয়ে হাজির হয়েছে ‘বাংলাদেশ ছাত্র ইসলামী মিশন’।...আল্লাহর দেওয়া নীতিমালা থেকে বিচ্যুতির কারণেই যে আমাদের সার্বিক অধঃপতন ঘটেছে—এ কথা উপলব্ধির সময় এসেছে।” তখন নাকি বাংলাদেশ ধর্মনিরপেক্ষ ছিল। ওই সেমিনারে বক্তা ছিলেন ‘মোফাচ্ছেরে কোরআন মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী এবং বিচারপতি কে এম বাকের।’ বাংলাদেশে পাকিস্তানি ইসলামি রাজনীতির শুরু ১২ মার্চ ১৯৭৫ থেকে।
২৬ মার্চ ’৭৫ বঙ্গবন্ধু সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এক জনসভা করেন। জনসভা উপলক্ষে দল থেকে নয় তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয় থেকে বহু প্রচারপত্র প্রকাশ করে। মন্ত্রণালয় থেকে এক সার্কুলার জারি করে এই নির্দেশ দিয়ে যে ওই দিন ‘ঢাকার এক শ মাইলের মধ্যে’ কেউ কোনো জনসভা করতে পারবে না। ওই বিজ্ঞপ্তিটি ছিল অত্যন্ত অগণতান্ত্রিক। সেটা বঙ্গবন্ধুর জ্ঞাতসারে হয়েছিল কি না বলা যায় না। অতি উত্সাহীদের কাজও হতে পারে।
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ: সাড়ে তিন বছর ধরে গণতান্ত্রিক পথে না গিয়ে বল প্রয়োগ করে সরকার উত্খাতের যে আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত এবং চেষ্টা হয়েছে তার সামান্য নমুনা দেওয়া হলো। সুতরাং ’৭৫-পরবর্তী সরকারের বিরুদ্ধে যে তেমন কোনো প্রতিবাদ হলো না বরং প্রকাশ্য ও নীরব সমর্থন পাওয়া গেল প্রচুর, তা অস্বাভাবিক নয়। নভেম্বরের প্রথম হপ্তায় ঘন ঘন বিপ্লব সংঘটিত হওয়ায় মানুষ স্থিতিশীলতা চাইছিল। জিয়া সেটা দিতে পেরেছিলেন। আমেরিকাসহ বহির্বিশ্বের পূর্ণ সমর্থন তিনি পান। দেশের মধ্যে মাঠপর্যায়ে থেকে সচিব পর্যায়ের আমলা পর্যন্ত, ব্যবসায়ী-পেশাজীবী থেকে বুদ্ধিজীবী পর্যন্ত সবাইকেই তিনি মোটামুটি কাছে পান।
মিলিটারি ডিকটেটর জিয়াউর রহমান ইতিহাসের কাছে বাড়তি সুবিধা পেয়েছিলেন এইটুকু যে তিনি নিজে ক্যু করেননি। বন্দী অবস্থায় ক্যু করা যায় না। একটি সিপাহি অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে জনগণের সমর্থন নিয়ে তিনি ক্ষমতা পান। তিনি গণতান্ত্রিক নেতা খালেদা জিয়ার মতো ছিলেন না। সবার সঙ্গেই একটি সমন্বয় করার চেষ্টা করেছেন। আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও জাসদের বিপুলসংখ্যক নেতা-কর্মীকে জেলে ঢোকালেও আওয়ামী বুদ্ধিজীবীদের তিনি পুরস্কৃত করেছেন। বেগম জিয়া যেমন বিএনপি-ইসলামপন্থী ছাড়া আর কাউকে টেলিভিশন, রেডিও, বাংলা একাডেমীর ত্রিসীমানায় ঢুকতে দেননি তাঁর দশ বছরে, জিয়া তা করেননি। আল কুদ্স কমিটির তিনি ছিলেন অন্যতম সদস্য, কয়েকদিন বাদ দিয়ে তিনি মধ্যপ্রাচ্য শান্তি আলোচনায় যেতেন। আমেরিকার পূর্ণ পৃষ্ঠপোষকতায় তিনি আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে একটি জায়গা করে নিয়েছিলেন।
কিছুদিন যাবত্ লক্ষ করছি জিয়াকে নিন্দা করতে গিয়ে প্রবল রাজনৈতিক প্রজ্ঞার অধিকারী কেউ কেউ বলতে চাইছেন, ৩ থেকে ৬ নভেম্বরের উত্তম বীরেরা যদি কোনো রকমে সরকার গঠন করতে পারতেন, তা হলে বাংলাদেশ যে সোনার বাংলা হতো তাই নয়, তা হতো সোনায় সোহাগা। সব ঘটনা আমাদের চোখের সামনে ঘটেছে, দানাপানি তো দূরের কথা, চা খাওয়ার অবসরও পাওয়া যায়নি পাঁচ দিন। ৩ থেকে ৬-এর দুর্বল ব্যক্তিত্বসম্পন্ন লোকগুলো দেশের যে সর্বনাশটা করেছেন তা হলো: ভারতবিরোধী চেতনাকে একটি স্থায়ী রূপ দিয়ে গেছেন। স্বাধীনতার পর থেকেই সে চেতনা কিছুটা ছিল, কিন্তু ৫-৬ নভেম্বরের ঘটনায় তা দৃঢ়মূল হয়। এখনো জামায়াত-বিএনপি তাই পুঁজি করে রাজনীতি করছে। সেই সাংঘাতিক ভারতবিরোধী জোয়ারের মধ্যে ভারতীয় হাইকমিশনার সমর সেন যে ঠান্ডা মাথায় পরিস্থিতি সামাল দিয়েছেন, তা তুলনাহীন।
সেই সংকটময় সপ্তাহে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক বিষিয়ে তুলতে পশ্চিমী প্রচারমাধ্যম জঘন্য ভূমিকা পালন করে। ৮ নভেম্বর রয়টার এক ডেসপাচে জানায়, ভারত-বাংলাদেশ যুদ্ধ আসন্ন। সে যুদ্ধও বন্দুক আর টোটা-গুলতির যুদ্ধ না। তাদের ভাষায়, তা হবে thermo-nuclear বা হাইড্রোজেন বোমার যুদ্ধ। ভারতের হাতে কি তখন হাইড্রোজেন বোমা ছিল? আর থাকলেও কি তারা তা বাংলাদেশের মানুষের মাথায় ফেলত? ওই খবরের প্রতিক্রিয়া যা হয়েছিল তা হলো, দোকানের বস্তা বস্তা চাল বিক্রি হয়ে গেল। যুদ্ধ কত দিন চলে! আর একটি বিষয় হলো, ৩ নভেম্বরের বীরেরা লম্ফ না দিলে জিয়া কোনোদিন রাষ্ট্রপতি হতে পারতেন না।
১৯ নভেম্বর ’৭৫ জাসদ, ছাত্রলীগ, শ্রমিক লীগ ও বিপ্লবী গণবাহিনী এক ইশতেহারে বলে: ‘ভারত, রাশিয়া ও আমেরিকার চর ও দালালরা বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে খর্ব করার জন্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত।...ভারতীয় আধিপত্যবাদ, রাশিয়ার সংশোধনবাদ এবং আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদের প্রভাবমুক্ত গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা কায়েম করেই জাতীয় স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে রক্ষা করা সম্ভব।’
জিয়ার বিরুদ্ধে যখন একদল মাথা চাড়া দিচ্ছে সুতরাং তারও বন্ধু দরকার। পরের সপ্তাহে ২৬ নভেম্বর ইউনাইটেড পিপলস পার্টির সভাপতি ক্যাপ্টেন আবদুল হালিম চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক কাজী জাফর আহমদ, সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কর্নেল আকবর হোসেন ও যুগ্ম সম্পাদক রাশেদ খান মেনন রাষ্ট্রপতি সায়েমের সঙ্গে সাক্ষাত্ করেন। এক দীর্ঘ স্মারকলিপিতে তাঁরা বলেন: ‘গত ৭ই নভেম্বর দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীর বীর সিপাহী ও জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব ও গণতান্ত্রিক পরিবর্তনের প্রশ্নে দেশবাসীর দৃঢ় সংকল্পের কথা পুনরায় ব্যক্ত হয়েছে।...স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব ও গণতান্ত্রিক পরিবর্তনের জন্য দেশপ্রেমিক জনতা ও সশস্ত্রবাহিনীর এই ঐক্য বাংলাদেশের ঐতিহ্যে নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে।...১৫ আগস্টের পর যে বিপদসমূহ জনগণের সামনে এসে দাঁড়ায় তা হলো (১) ১৫ই আগস্টের পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য রুশ-ভারত শক্তির তত্পরতা ও দেশের অভ্যন্তরে তাদের ভাড়াটিয়া অনুচরদের সাবোটাজ, ষড়যন্ত্র ও জনগণকে বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টা, ..।’
অসংখ্য দল, সংগঠন ও ব্যক্তি জিয়ার পাশে দাঁড়িয়ে যায়। ফলে জিয়া সাহস পান তাঁর প্রতিপক্ষকে নির্মূল বা নির্জীব করতে। ২৮ জুন ’৭৬ কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে ‘দেশবাসী, সেনাবাহিনী, বিডিআর, পুলিশ বাহিনীর অফিসার ও সিপাহীদের নিকট কর্নেল তাহেরের আবেদন’-এ বলা হয়: “১৯৭৫ সালের ৩রা নভেম্বর ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ ভারতের ইঙ্গিতে একটি নীরব ‘ক্যু’ (সামরিক অভ্যুত্থান) ঘটিয়ে দেশকে বিদেশীদের হাতে তুলে দেবার এক জঘন্য চক্রান্তে লিপ্ত ছিল। সেদিন সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফ হিসেবে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান তাঁর পবিত্র দায়িত্বের কথা ভুলে গিয়ে প্রাণ বাঁচানোর জন্য পদত্যাগ করে অসহায়ের মত হাত গুটিয়ে বসেছিলেন। ...গোটা জাতির জন্য সে দিনগুলো ছিল চরম হতাশা ও আতঙ্কের দিন। ঠিক সে সময়ে বাংলাদেশের বীর বিপ্লবী সিপাহীরা এগিয়ে এসেছিল বুকে সাহস, হূদয়ে ঈমান আর দেশমাতাকে বাঁচাবার এক অগ্নিশপথ নিয়ে।’
উপসংহার: পুরোনো কাসুন্দি ঠিকমতো ঘোটা দিলে ভালো, বেঠিক ঘোটা দিলে তা বিপজ্জনক বিষে পরিণত হয়। মহাজোটের অসাম্প্রদায়িক নির্বাচিত সরকার এখন ক্ষমতায়। সবারই উচিত, এখন এমন নীতি ও পথ অনুসরণ করা, যাতে গণতন্ত্র সুসংহত হয়। এবং এমন কিছু না করা, যাতে প্রতিহিংসার বসে নতুন ষড়যন্ত্র দানা বাঁধে। দলমত-নির্বিশেষে আমাদের সিদ্ধান্ত হওয়া উচিত, আর যেন কোনো সামরিক জান্তা অথবা সেনা-সমর্থিত দৈব সরকার জাতির কাঁধে চেপে না বসে।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।

No comments

Powered by Blogger.