সময়ের শ্রেষ্ঠ কবিতা -স্মরণ by দীপংকর চন্দ

সুপরিকল্পিত এক বিকেলের সূচনালগ্ন। মতিঝিলের কর্মক্লান্ত জনস্রোত, যন্ত্রযানের দীর্ঘ মিছিল পেছনে ফেলে ইত্তেফাক ভবনের দিকে এগোলাম আমরা। অভিসার সিনেমা হল অতিক্রম করে পৌঁছালাম রাজধানী সুপার মার্কেটের কাছেই আর্ট হ্যাভেন নামের একটি ছোট্ট দোকানের সামনে। দোকানটির স্বত্বাধিকারী ইকরাম হোসেন একজন অতি সাধারণ মানুষ। কিন্তু নিয়তির বিচিত্র খেয়ালে কত অবিশ্বাস্য ঘটনাই যে ঘটে পৃথিবীতে! ধনতান্ত্রিক সমাজের বিবেচনায় ইকরাম হোসেনের মতো আপাতদৃষ্টিতে অপাঙেক্তয়, একজন অতি সাধারণ মানুষের হাতেও লেখা হয় সময়ের শ্রেষ্ঠ কবিতা ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক।’
আর্ট হ্যাভেনের স্বল্পায়তন পরিসরে প্রবেশ করি আমরা। কথা হয় একহারা গড়নের ইকরাম হোসেনের সঙ্গে। শুরুতেই ব্যক্তিজীবনের বর্ণনা। ১৯৬৮ সালে মহানগর ঢাকায় জন্ম তাঁর। অল্প বয়সে পিতৃবিয়োগের কারণে ইকরাম হোসেনের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাগ্রহণ পরিপূর্ণভাবে বাধাগ্রস্ত হয়। বেঁচে থাকার তাগিদে বিভিন্ন কাজ করার চেষ্টা করেন তিনি। লেদ মেশিন, গ্যাস ওয়েলডিং, ইঞ্জিন ডেন্টিংয়ের কাজ করতে করতে একদিন যুক্ত হন মতিঝিল শাপলা চত্বরের কাছেই আশরাফ মোটরস নামের একটি গাড়ির ওয়ার্কশপে। এই ওয়ার্কশপেই অঙ্কনশিল্পী বাদশা মিয়ার সঙ্গে পরিচয়। মূলত বাদশা মিয়ার হাত ধরেই পেশা বদল ঘটে ইকরাম হোসেনের। এরপর বছর চারেক অতিক্রান্ত হয়।
দিলকুশা বাণিজ্যিক এলাকায় বিসিআইসি ভবনের উল্টো দিকের ফাঁকা জায়গায় তখন সুউচ্চ ভবন ছিল না; ছিল গাড়ির ওয়ার্কশপ, গ্যারেজ, দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য স্বল্প ব্যয়ে নির্মিত প্রান্তনিবাস এবং কয়েকটি ছোট দোকান। এখানেই পপুলার পাবলিসিটি নামের একটি আর্টের দোকানে কাজ শুরু করলেন ইকরাম হোসেন। পপুলার পাবলিসিটির কাছেই ক্যাফে চায়নার গলি। বনগ্রাম রোড থেকে এখানে আড্ডা মারতে আসতেন নূর হোসেন। মতিঝিল-দিলকুশার বিভিন্ন অফিসে পুরোনো কাগজ, পরিত্যক্ত যন্ত্রাংশ ক্রয়-বিক্রয়ের সঙ্গে জড়িত জলিল ভাইয়ের সঙ্গে ভীষণ সখ্য ছিল ঝাঁকড়া চুলের এই যুবকটির। নূর হোসেনের সঙ্গে মাঝেমধ্যেই দেখা হতো ইকরাম হোসেনের, সৌজন্যমূলক বাক্যবিনিময়ও হতো, তবে বেশি ঘনিষ্ঠতার সুযোগ হয়নি কর্মব্যস্ততার কারণেই। ইকরাম হোসেন জানতেন, নূর হোসেন আওয়ামী লীগের একনিষ্ঠ কর্মী। রাজনৈতিক যেকোনো কর্মসূচিতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন তিনি।
১৯৮৭ সাল তখন। রাষ্ট্রক্ষমতায় অগণতান্ত্রিকভাবে অধিষ্ঠিত সরকারের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ দেশের সব রাজনৈতিক জোট। প্রজাতন্ত্রের নিয়ন্তাশক্তির স্বৈরাচারী কর্মকাণ্ডে অতিষ্ঠ জনসাধারণ। বিক্ষোভ-আন্দোলনে প্রায় প্রতিদিনই উত্তাল রাজপথ। মিছিলে অংশগ্রহণকারীদের জীবনহানির সংখ্যা বাড়ছে আশঙ্কাজনকভাবে। পরিস্থিতির গুরুত্ব অনুধাবন করে বিরোধী দলগুলো ১০ নভেম্বর ঢাকা অবরোধ কর্মসূচি পালনের সিদ্ধান্ত নিল। শুরু হলো কর্মসূচি সফল করার প্রস্তুতি।
৮ নভেম্বর সকালে দোকানে কাজ করছিলেন ইকরাম হোসেন। এমন সময় কয়েকজন বন্ধুসহ সেখানে উপস্থিত হলেন নূর হোসেন। একটা কাজ করে দেওয়ার কথা বললেন ইকরাম হোসেনকে। সে সময় ব্যস্ত ছিলেন ইকরাম হোসেন। তাই তিনি পরদিন বিকেলে নূর হোসেনকে দোকানে আসতে বললেন। ৯ নভেম্বর। শীতের পড়ন্ত বিকেলে নূর হোসেন এলেন পপুলার পাবলিসিটিতে। ঘণ্টাখানেক বসলেন। তারপর সন্ধ্যার ঠিক আগ মুহূর্তে ইকরাম হোসেনকে নিয়ে চললেন ক্যাফে চায়নার গলির পাশের প্রান্তনিবাসের একটি অংশে। সেখানে জামা খুললেন নূর হোসেন। ঊর্ধ্বাঙ্গ সম্পূর্ণ অনাবৃত করে ইকরাম হোসেনকে বললেন, আজ আপনি এমন এক জায়গায় কিছু কথা লিখবেন, যা আপনি আপনার জীবনে কোনো দিন লেখেননি। নূর হোসেনের কথায় খানিকটা বিভ্রান্ত হলেন ইকরাম হোসেন। দ্বিধাগ্রস্ত হলেন। নূর হোসেনের অনাবৃত ঊর্ধ্বাঙ্গে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে নিশ্চিত হতে চাইলেন লেখার স্থান সম্পর্কে! হ্যাঁ, নিশ্চিত করলেন নূর হোসেন, জানালেন লিখতে হবে এই শরীরেই। কাছের একটা দেয়ালে চক দিয়ে ‘স্বৈরাচার নীপাত যাক, গনতন্ত্র মুক্তি পাক’ (এই বানানেই) কথাগুলো লিখলেন। তারপর এ কথাগুলো লিখে দিতে বললেন তাঁর বুকে-পিঠে। কারণ, আগামীকালের ঢাকা অবরোধ কর্মসূচিতে এভাবেই অংশ নিতে চান তিনি। কিন্তু এই দুঃসাহসী কাণ্ড যে নূর হোসেন নামের প্রাণোচ্ছল যুবকটির মৃত্যুর কারণ হতে পারে!—না! না! এ কাজ কিছুতেই করতে পারেন না ইকরাম হোসেন! তিনি ফিরে যেতে উদ্যত হতেই তাঁর হাত চেপে ধরলেন নূর হোসেন, দৃঢ় কণ্ঠে বললেন, গণতন্ত্রের মুক্তির জন্য তাঁর মতো শত প্রাণের বলিদান ভীষণ প্রয়োজন আজ। নূর হোসেনের এ কথায় আকস্মিকভাবে দ্বিধামুক্তি ঘটল ইকরাম হোসেনের। আপত্তির প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে কম্পিত হাতে তিনি তুলি তুলে নিলেন, সাদা অ্যানামেল পেইন্টের কৌটার মুখ খুললেন, তারপর মিনিট বিশেকের মধ্যে লিখে ফেললেন সময়ের শ্রেষ্ঠ কবিতা।
১০ নভেম্বর। সকাল থেকেই ঢাকায় জারি ছিল ১৪৪ ধারা। কিন্তু সেই ধারা অগ্রাহ্য করে পথে নামলেন নূর হোসেন। স্বৈরাচার নিপাতের লক্ষ্যে, গণতন্ত্র মুক্তির দাবিতে মুষ্টিবদ্ধ হাত ঊর্ধ্বে তুলে স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত করলেন দশদিগন্ত। অবধারিতভাবে পুলিশ গুলি চালাল। সেই গুলিতে নূর হোসেনের নিষ্প্রাণ দেহ মাটিতে লুটাল ঠিকই, কিন্তু সময়ের শ্রেষ্ঠ কবিতা শরীরে ধারণ করে নূর হোসেন পৌঁছে গেলেন অমরাবতীর অনিন্দ্য সুন্দর উপকূলে।

No comments

Powered by Blogger.