সরকার কেন ঘড়ির কাঁটা আর পিছিয়ে নিচ্ছে না -গদ্যকার্টুন by আনিসুল হক

ঘড়ির কাঁটা যখন এগিয়ে নেওয়া হয়, তখন আমাদের বলা হয়েছিল, অন্তত আমরা যা বুঝেছিলাম, শীতকালে আবার কাঁটা পিছিয়ে নেওয়া হবে। এখন শীত এসে যাচ্ছে, তবু ঘড়ির কাঁটা পেছাচ্ছে না। পৃথিবীর যেসব দেশে দিবালোক সাশ্রয় কর্মসূচি আছে, সেসব দেশে ঘড়ির কাঁটা বছরে একবার এগোনো হয়, আরেকবার পেছানোও হয়। আমাদের সরকার এগোনোর বেলায় এগোল, পেছানোর বেলায় পেছাচ্ছে না কেন?
এই বিষয়ে কৌতুক বলার চেষ্টা করব। এই রকম গুরুতর বিষয় নিয়ে কৌতুক আমার পাঠকেরা পছন্দ করবেন না আমি জানি। বিশেষ করে যে স্কুলছাত্রের মাকে ফজরের আজানের সময় ঘুমন্ত বাচ্চা কোলে নিয়ে স্কুলের পথে নামতে হচ্ছে, তাঁদের জন্যে এই সব রসিকতা রীতিমতো গাত্রদাহের কারণ হয়ে উঠবে। একজনের জন্যে যা রসিকতা, আরেকজনের জন্যে তা জীবনমরণ সমস্যা!
কৌতুক নম্বর এক। একটা বনে আগুন লেগেছে। দাবানল। পত্রিকার সম্পাদক তাঁর আলোকচিত্রীকে নির্দেশ দিলেন, এক্ষুনি এয়ারপোর্টে যাও। দেখবে, একটা বিমান অপেক্ষা করছে। সেটাতে উঠে পড়ো। বনের ওপর দিয়ে ওটা উড়াল দেবে। তুমি গিয়ে আকাশ থেকে দাবানলের ছবি তুলবে। আমরা এক্ষুনি সেই ছবিটা ছাপাখানায় পাঠিয়ে দেব।
আলোকচিত্রী ছুটলেন বিমানবন্দরের দিকে। সত্যি একটা বিমান অপেক্ষা করছে।
তিনি বিমানটাতে লাফ দিয়ে উঠলেন। পাইলটের পাশের সিটে বসলেন। বললেন, তাড়াতাড়ি। তাড়াতাড়ি। চলো। সময় নাই।
বিমানটা আকাশে উঠল।
নিচে দাবানলে জঙ্গল পুড়ে যাচ্ছে। মনে আগুন লাগলে কেউ দেখে না বটে, বনে আগুন লাগলে সবাই দেখে। পাইলট আর ফটোগ্রাফার আগুনের লেলিহান শিখা আকাশ থেকে দেখছেন।
আলোকচিত্রী বললেন, প্লেনটা একটু নিচের দিকে নাও, যাতে আমি ভালো করে ছবি তুলতে পারি।
পাইলট বললেন, আমি তো প্লেন নামাতে পারি না। ওটা তো স্যার আমাদের এখনো শেখানো হয় নাই।
মানে?
মানে, আমি এই কয়টা ক্লাসে এখন পর্যন্ত প্লেন শুধু ওপরে তোলা শিখেছি, নামানো শিখিনি। আপনি বলে দেন, কীভাবে নিচে নামাব।
আমি শেখাব কী করে? আমি পাইলট নাকি! আমি তো ফটোগ্রাফার।
কী বলেন? আপনি বিমান-প্রশিক্ষক নন?
না, আমি ফটোগ্রাফার। আমি ছবি তুলি।
হায় হায়, আমি তো ভেবেছিলাম আপনি ইন্সট্রাকটর। আমাকে অর্ডার করেছেন উড়তে। আমি উড়েছি।
এখন নামান।
আমি প্লেন নিচে নামানোটা শিখিনি।
এই সরকার রাত ১১টায় ঘড়ির কাঁটা এক ঘণ্টা এগিয়ে নিয়ে ১২টা বানাতে জানে। কিন্তু ১২টার কাঁটা কীভাবে আবার ১১টায় আনতে হয়, সেটা জানে না।
এই সমস্যার সমাধান আমি দিতে পারি। সরকারের ঘড়ির কাঁটা যদি কেবল সামনের দিকেই ঘোরে, পেছনের দিকে ঘোরানোর অপশন যদি তার না থাকে, তাহলে সামনের দিকে ১১ ঘণ্টা এগিয়ে নিলেই চলবে।
আচ্ছা, সরকার ঘড়ির কাঁটা শীতকালে পেছানোর অঙ্গীকার থেকে সরে এল কেন?
আমরা সঠিক কারণ জানি না। ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণ করে দেখা যাক। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তখন বিদেশে ছিলেন। শোনা গেল, তাঁর অনুপস্থিতিতে এত বড় একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত হবে না ভেবে তাঁর প্রত্যাবর্তনের জন্যে অপেক্ষা করা হচ্ছে। তিনি এলেন। তারপর আমরা সিদ্ধান্ত জানলাম, ঘড়ির কাঁটার আর নড়চড় হবে না।
এত দিন আমরা জানতাম, সময় ও স্রোত কারও জন্যে অপেক্ষা করে না। এখন আমরা শিখলাম, সময় প্রধানমন্ত্রীর জন্যে অপেক্ষা করে।
একবার কিংবদন্তি ব্যাটসম্যান স্যার ডন ব্রাডম্যান ব্যাট করতে নামবেন। হাজার হাজার দর্শক সেই খেলা দেখতে এসেছেন। তিনি নেমেই শূন্য রানে বোল্ড আউট হয়ে গেলেন। তখন তিনি স্টাম্প আর উইকেট আবার সাজিয়ে বললেন, খেলা এখন থেকে শুরু হলো। আগেরটা খেলার অংশ না। হাজার হাজার দর্শক তোমার বোলিং দেখতে আসেনি, আমার ব্যাটিং দেখতে এসেছে।
অর্থাত্ বড় মানুষদের জন্যে নিয়ম পাল্টানো যায়। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান একটা নিয়ম এই দেশে পাল্টে দিয়েছিলেন। আগে বয়স্কাউটরা হ্যান্ডশেক করত বাম হাতে। কারণ তাদের স্লোগান তারা ‘সদা প্রস্তুত’। ডান হাতে কখন কী কাজ করতে হয়, তাই বাম হাত এগিয়ে তারা করমর্দন করত। তো স্কাউটরা একবার গেছে প্রেসিডেন্ট জিয়ার সঙ্গে দেখা করতে। তিনি করমর্দনের জন্যে ডান হাত এগিয়ে দিলেন। ছেলেরা বাম হাত এগিয়ে দিল। জিয়া বিব্রত। ছেলেরা জানাল, স্যার, এটা আমাদের নিয়ম। স্কাউটরা বাম হাতে করমর্দন করে থাকে। দুনিয়াজোড়া এই কেতাই মানা হচ্ছে। তিনি বললেন, দুনিয়ার নিয়ম এই দেশে চলবে না। আমরা ভদ্র জাতি, আমাদের বয়স্কাউটরা এখন থেকে ডান হাতে করমর্দন করবে। সেই থেকে এই দেশের বয়স্কাউটরা ডান হাতে করমর্দন করে।
আমরা জানি না, কার মর্জিতে শীতকালে ঘড়ির কাঁটা পেছানোর পূর্বঘোষিত অন্তত পূর্ব-অনুমিত ঘোষণা থেকে আমরা সরে আসছি। কেউ কি নেই, যিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বলতে পারেন, এটা ঠিক হচ্ছে না। দেশের মানুষ এটা পছন্দ করছে না। (গ্রীষ্মকালে দিবালোক সাশ্রয় কর্মসূচিতে আমার সমর্থন আছে।)
এই বিষয়ে একটা রুশ কৌতুক বলব। একজন রুশ, একজন মার্কিনি আরেকজন ইংরেজ গল্প করছে নিজেদের দেশের চিকিত্সা কত উন্নত, তা নিয়ে। মার্কিনি বলল, আমরা মস্তিষ্কের অপারেশনে খুব উন্নতি করেছি, করোটি না খুলেই এখন ব্রেন অপারেশন হয় আমেরিকায়।
ইংরেজ বলল, আমরা হূদযন্ত্রের সার্জারিতে এত উন্নত হয়েছি যে, আমাদের আর চেস্ট ওপেন করতে হয় না।
আর রুশ বলল, আমরা দাঁতের চিকিত্সায় খুব উন্নতি করেছি। রোগীকে মুখ হাঁ করতে হয় না, দাঁতের অপারেশনের কাজ করা চলে।
মুখ হাঁ করতে কী অসুবিধা? মুখ খুলতে তো কাটাছেঁড়া করতে হবে না, রক্তপাত ঘটবে না। ইংরেজ ও আমেরিকান জিজ্ঞেস করল।
আমাদের দেশে মুখ খোলা নিষেধ কিনা! রুশ জবাব দিল।
বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শকেরা সবাই কি মুখ বন্ধ রেখে শুধু মাথা নেড়ে ‘জি হ্যাঁঁ’ ‘জি হ্যাঁ’ করেন?
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.