সশস্ত্র বাহিনীকে ছাত্র-জনতার মুখোমুখি দাঁড় করাবেন না
বিবৃতিতে যা বলা হয়েছে
বিবৃতিতে জেনারেল ইকবাল করিম ভূঁইয়া বলেন, আমি এখানে উপস্থিত সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ সিনিয়রের অনুমতিক্রমে সবার পক্ষ থেকে এই বিবৃতি পেশ করছি। গত তিন সপ্তাহ ধরে দেশব্যাপী হত্যাযজ্ঞ, নির্যাতন, গুম এবং গণগ্রেপ্তারের যে ঘটনা চলেছে আমরা তাতে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন, মর্মাহত এবং ব্যথিত। অজস্র কিশোর-তরুণের অকাল জীবনাবসান ঘটেছে। আজ অভিবাবক হিসেবে নিজেদেরকে দায়মুক্ত ভাবতে পারছি না। তাই, বিবেকের তাড়নায় আমরা দেশবাসীর সামনে হাজির হয়েছি। বৈষম্যবিরোধী এই সংগ্রামের সকল শহীদদের রুহের মাগফেরাতের জন্য মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের দরবারে দোয়া করছি। এতে বলা হয়েছে, বৈষম্য, ভেদাভেদ ও জুলুমের অবসান করা ছিল একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার। তা না হয়ে উল্টো এসব আজ দেশের সর্বপর্যায়ে ভয়াবহভাবে বিস্তার লাভ করেছে। সমাজের নিচের স্তরে পড়ে থাকা সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সহ্যের সীমার বাইরে চলে গেছে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা ও অব্যবস্থাপনা। এই অবস্থার প্রতিকারে জনগণ আজ আত্মোৎসর্গেও পিছপা হচ্ছে না। এমন কষ্টকর পরিস্থিতির ভেতর দেশবাসীকে ঠেলে দেয়ার জন্য যারা দায়ী, বিচারের মাধ্যমে তাদের সাজা নিশ্চিত করে পুরো ব্যবস্থার মধ্যে স্বচ্ছতা, ন্যায্যাতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা প্রতিষ্ঠা না করা গেলে, সমাজে শান্তি, শৃঙ্খলা ও আস্থা ফিরিয়ে আনা যাবে না। বিবৃতিতে বলা হয়, দেশের নীতিনির্ধারকরা যদি বিবেক, বুদ্ধি ও হৃদয়হীন হয়ে না পড়তেন, তাহলে গত কয়েক সপ্তাহে বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড়, করুণ ও মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের ঘটনাগুলো ঘটতো না। এই সকল হামলা, আক্রমণ ও প্রতিরোধে অঙ্গহানি ঘটেছে অগণিত মানুষের। অন্ধ হয়েছেন বহুসংখ্যক কিশোর ও তরুণ। অসহায় নাগরিকরা প্রয়োজনীয় এবং জরুরি চিকিৎসাও পাচ্ছেন না। তার উপর চলছে ব্লকরেইড করে সন্ত্রাসীদের মাধ্যমে বাড়ি, ঘর, মেস চিনিয়ে ধরে নিয়ে যাওয়ার মতো ভয়ংকর সব ঘটনা। মিথ্যা মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছেন অথবা পালিয়ে বাড়াচ্ছেন হাজার-হাজার নিরপরাধ কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণী, যুবক ও যুবতী। এতে বলা হয়, সুস্থ মস্তিষ্কের কোনো বিবেকবান মানুষের পক্ষে দেশে এমন একটা যুদ্ধ পরিস্থিতি মেনে নেয়া সম্ভব না। আমরা নিজেরা নিজেদের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হতে পারি না। আমাদের দেশটাকে, এই প্রিয় রাজধানী শহর ঢাকা ও জেলা শহরগুলোকে যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হতে দিতে পারি না। তাই আজ এখানে দাঁড়িয়ে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলছি, ইনশাআল্লাহ তা আমরা করতে দেবো না। সকল শ্রেণি ও পেশার মানুষকে সঙ্গে নিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে শান্তি প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট থাকবো। বিবৃতিতে বলা হয়, কোটা সংস্কার আন্দোলনের শুরুটা দেশবাসী দেখেছেন। এর কোনোকিছুই মানুষের স্মৃতি থেকে মুছে যাওয়ার নয়। প্রথম পক্ষ অর্থাৎ শিক্ষার্থীরা শান্তিপূর্ণভাবে তাদের আন্দোলন এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। সারা দেশের শিশু, কিশোর ও তরুণরা শত উস্কানি, হামলা ও নির্যাতনের মধ্যেও ধৈর্য ধরে শৃঙ্খলার সঙ্গে আস্তে আস্তে আইন মেনে সামনে পা বাড়াচ্ছিল। এর বিপরীতে দ্বিতীয় পক্ষ যে উপর্যুপরি উস্কানি দিলো, গুণ্ডা-পাণ্ডা দিয়ে সন্ত্রাস চালালো এবং পুলিশ, র?্যাব, আনসার ও বিজিবি নামিয়ে, আকাশে হেলিকপ্টার উড়িয়ে, নির্বিচারে গুলি করে অগণিত শিশু, কিশোর ও তরুণদের তাজা প্রাণ হরণ করলো, তা দেশবাসী কি এত সহজে, এই অল্প সময়ের মধ্যেই ভুলে যাবে। এতে বলা হয়, আক্রমণকারীরা গণআন্দোলনের প্রতিরোধের মুখে পিছপা হতে বাধ্য হলে, পরবর্তী পর্যায়ে ব্যবহার করা হলো বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীকে। তাদেরকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে, কখনো সম্মুখভাগে কখনো পেছনে ও পাশে দাঁড় করিয়ে অন্যান্য বাহিনীগুলো এই গণআন্দোলনের উপর তাদের জুলুম, অত্যাচার, নির্যাতন অব্যাহতভাবে চালিয়ে যাচ্ছে। কোনোভাবেই এমন পরিস্থিতির দায় দেশপ্রেমিক সশস্ত্র বাহিনীর নেয়া উচিত নয়। বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী অতীতে কখনো দেশবাসী বা সাধারণ জনগণের মুখোমুখি দাঁড়ায়নি, তাদের বুকে বন্দুক তাক করেনি। বিবৃতিতে বলা হয়, একটি রাজনৈতিক সংকটকে সামরিকীকরণের যে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, আমরা সশস্ত্রবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা এর তীব্র বিরোধিতা করছি। পার্শ্ববর্তী দেশ মিয়ানমার সামরিক সরকারের এমন অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্তের কারণে সম্পদশালী সেই দেশটিকে আজ ধ্বংসের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। এই শাসকদেরকে গণহত্যার দায় নিয়ে এখন আন্তর্জাতিক আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হচ্ছে। অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিস্থিতি থেকে উদ্ভূত এই রাজনৈতিক সংকটকালে আমরা ক্ষমতাসীন সরকারের প্রতি ‘রাজপথ থেকে সশস্ত্র বাহিনীকে তাদের ছাউনিতে’ ফিরিয়ে নেয়ার আহ্বান জানাচ্ছি। আমাদের সীমান্ত এ মুহূর্তে অরক্ষিত। ছাত্রদের যৌক্তিক আন্দোলন দমনের জন্য সীমান্ত থেকে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক বিজিবি সদস্যদের প্রত্যাহার করা হয়েছে। বর্তমান সময়ে সশস্ত্র বাহিনীকে অবিলম্বে সেনা ছাউনিতে ফিরিয়ে নিয়ে যেকোনো আপদকালীন সংকট মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত রাখা প্রয়োজন। অনুরোধ করে বলছি, এ সংকট আলাপ আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের উদ্যোগ গ্রহণ করুন। দেশপ্রেমিক সশস্ত্র বাহিনীকে ছাত্র-জনতার মুখোমুখি দাঁড় করাবেন না। এতে বলা হয়েছে, সংঘটিত সকল হত্যাকাণ্ড, জখম, গুলি, হামলা, ভাঙচুর, সন্ত্রাসের ঘটনার স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য তদন্ত হতে হবে জাতিসংঘের নেতৃত্বে এবং তাদের অধীনে। আমরা সকলে বাংলাদেশের মানুষকে সম্মান ও শ্রদ্ধা করি এবং ভালোবাসি। সশস্ত্র বাহিনীতে কর্মরত সকল সদস্য সার্বভৌমত্ব রক্ষার শপথ ও সর্বোচ্চ আত্মত্যাগের প্রস্তুতি নিয়েই এই পেশায় নিয়োজিত আছেন। আজ দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে আমাদের সকল সহকর্মীকে বিনীতভাবে অনুরোধ করবো, সৈনিকের পেশার সর্বোচ্চ মর্যাদা, মানবিকতা ও নৈতিক মানদণ্ড বজায় রেখে দায়িত্ব পালন করবেন। বিবৃতিতে বলা হয়, বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী গত তিন দশক এর বেশি সময় অক্লান্ত পরিশ্রম ও ত্যাগের মাধ্যমে যে সম্মান, মর্যাদা ও গৌরব অর্জন করেছে, তা আজ কঠিন পরীক্ষার মুখে পড়েছে। সার্বজনীন মানবাধিকারের সর্বোচ্চ আন্তর্জাতিক মান রক্ষা করেই আপনাদের সকলকে নিজ দেশের জনগণের পক্ষে দাঁড়াতে হবে। চোখের সামনে আমরা নিজেদের মাতৃভূমিকে ধ্বংস হতে দিতে পারিনা। দেশমাতৃকার স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার এই মহান ব্রত পালনে আল্লাহ নিশ্চয়ই আমাদের সকলের সহায় হবেন, ইনশাআল্লাহ তিনি নিশ্চয়ই আমাদের হেফাজত করবেন।
No comments