ড্রাগনের করমর্দন :বাংলাদেশ-ভারত প্রস্তুত? by সুবীর ভৌমিক

চীনের প্রস্তাবিত বাংলাদেশ-চীন-ভারত-মিয়ানমার (বিসিআইএম) অর্থনৈতিক করিডোর প্রকল্পের অগ্রগতির ব্যাপারে দেশটি আগ্রহ নিয়ে পর্যবেক্ষণ করছে। চীনের প্রধানমন্ত্রী লি কেকিয়াংয়ের সাম্প্রতিক ভারত সফরের সময় ভারত ও চীন এ প্রকল্পের সম্ভাব্যতা বের করার ব্যাপারে ঐকমত্যে পেঁৗছেছে।
এখন মনে হচ্ছে, এ প্রকল্পের ব্যাপারে নয়াদিলি্ল দ্বিতীয়বার ভাবছে।
গত জুনে চীনের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মন্ত্রীদের জানিয়েছেন, একটি আন্তর্জাতিক হাইওয়ে তৈরিতে বেইজিং আগ্রহী। এই হাইওয়ে এসব দেশকে চীনের ইয়োনান প্রদেশের সঙ্গে সংযুক্ত করবে। বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে গিয়ে এই হাইওয়ে শেষ হবে কলকাতায়। অবশ্য এখনও চীন চূড়ান্ত রুট প্রকাশ করেনি। তার পরও এটি বলা যায় যে, চীন বিসিআইএম গাড়ির শোভাযাত্রার রুটের ব্যাপারে আগ্রহী।
এই রুট তৈরি খুব একটা কঠিন কাজ হবে না। কারণ এ ক্ষেত্রে মিয়ানমারে অবস্থিত চীনের তৈরি উত্তর-দক্ষিণ হাইওয়ের সঙ্গে ভারতের তৈরি কালেমইয়ো-তামু রোডের সংযোগ প্রয়োজন। এটি আবার মণিপুরে অবস্থিত মোরেহ পর্যন্ত যাবে। এখন যা প্রয়োজন তা হলো, ভারতের উত্তর-পূর্বে মোরেহ-ইম্ফল-শিলচর-তামাবিল হাইওয়ে তৈরি করা। এটি সিলেট পর্যন্ত যাবে। সেখান থেকে ঢাকা এবং তারপর কলকাতা। এভাবে হাইওয়েটি সব স্থানকে সংযুক্ত করবে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত স্টিলওয়েল রোডের উন্নতি সাধনের ব্যাপারে চীন এক সময় আগ্রহী ছিল। মনে হচ্ছে, এখনও দেশটি এ ব্যাপারে আগ্রহী। এই রোডটি আসাম ও অরুণাচল প্রদেশ থেকে শুরু হয়ে মিয়ানমারের ভেতর দিয়ে চীনের ইয়োনান প্রদেশে গিয়ে শেষ হয়েছে। কিন্তু ভারতের সেনাবাহিনী এ ব্যাপারে কিছুটা সতর্ক। তারা মনে করছে, এই সড়ক হয়তো যুদ্ধের সময় চীনকে কৌশলগত সুবিধা দেবে। অন্যদিকে বাণিজ্য কর্মকর্তারা মনে করেছেন, চীন এই সড়ক ব্যবহার করে উত্তর-পূর্ব ভারতে নিজেদের পণ্যের আঁস্তাকুড় তৈরি করবে।
কলকাতা-ঢাকা-সিলেট-ইম্ফল-মোরেহ-তামু-মান্দালয়-মুসে-ইয়োনান রুটকেই চীন বিসিআইএম আন্তর্জাতিক হাইওয়েতে রূপান্তরিত করতে চায়। হাইওয়ে তৈরি হয়ে গেলে চীন এর সঙ্গে বাণিজ্যকেন্দ্র ও শিল্পাঞ্চল জুড়ে দেওয়ার প্রস্তাব করবে। কলকাতা-অমৃতসর করিডোর, যা ভারতের প্রধানমন্ত্রী তৈরি করতে আগ্রহী, তা তৈরিতে দিলি্ল চাইলে চীন বিনিয়োগ করে সহযোগিতা করতে পারে। জাপান যদি দিলি্ল-মুম্বাই করিডোরের ব্যাপারে আগ্রহী হয় তাহলে চীন অমৃতসর-কলকাতা করিডোর ও বিসিআইএম করিডোরের ব্যাপারগুলো দেখবে।
ব্যবসা-বাণিজ্যে নব্য ব্যবস্থা আনয়নে বিশ্বের দ্বিতীয় ও তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশের সঙ্গে অধিক সমন্বয় তৈরি করা চীনের প্রধানমন্ত্রী লি কেকিয়াংয়ের পরিকল্পনা। এই পরিকল্পনার গুরুত্বপূর্ণ অংশ বিসিআইএম।
বিসিআইএমের 'হিমালয়ান হ্যান্ডশেক'-এর মাধ্যমে কাছে টানার পাশাপাশি ভারতকে ওবামার 'অপরিহার্য এশিয়া' এবং সিনজো আবের 'মুক্তির বৃত্ত' থেকে বের করে আনার চেষ্টাও চলছে। যেহেতু হিমালয় অঞ্চলে ভারত ও চীনের বিবদমান সীমান্ত দিয়ে সামান্য বাণিজ্যই চলে; চীন এখন পূর্ব ভারতের সঙ্গে একটি কার্যকর স্থল রুট তৈরি করতে চাইছে, যেটি একই সঙ্গে বিপুল প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনাময় দুই দেশ বাংলাদেশ ও মিয়ানমারকে যুক্ত করবে।
লি ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলকেন্দ্রিক 'লুক ইস্ট' উদ্যোগ এবং চীনের দক্ষিণাঞ্চল থেকে মিয়ানমারমুখী 'ব্রিজহেড' উদ্যোগ উদৃব্দত করেছেন। যদি কেবল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াই লক্ষ্য হয়, তাহলে ভারতের 'লুক ইস্ট' নীতি সামান্যই অর্থ বহন করে। কারণ থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, কম্বোডিয়া কিংবা ভিয়েতনামের বন্দরগুলো ভারতের স্থল রুটের তুলনায় যে কোনো নৌবন্দর থেকে কাছে। অন্যদিকে চীনের পূর্বাঞ্চলীয় বন্দরগুলো যেহেতু বেশ দূরে, সেখান থেকে আন্তর্জাতিক মহাসড়ক ব্যবহার করে পশ্চিমাঞ্চলীয় বিপুল বাজারে ঢুকতে 'লুক ইস্ট' নীতি দেশটির জন্য অর্থবহ হয়।

স সুবীর ভৌমিক :বিবিসির সাবেক সংবাদদাতা; হিন্দুস্তান টাইমস থেকে
ভাষান্তর একরামুল হক শামীম

No comments

Powered by Blogger.