৪০ জনকে দায়ী করে মামলার সুপারিশ by আবুল কাশেম

যুব কর্মসংস্থান সোসাইটির (যুবক) কাছে গ্রাহকদের পাওনা অর্থের পরিমাণ দুই হাজার ৫৮৮ কোটি টাকা। পাওনাদার তিন লাখ তিন হাজার ৭৩৯ জন। কিন্তু দেশের ৪৯টি তফসিলি ব্যাংকে যুবকের অর্থ রয়েছে মাত্র ৭৮ লাখ ৬৪ হাজার টাকা।
এসব তথ্য জানিয়ে যুবক কমিশন সম্প্রতি তাদের চূড়ান্ত প্রতিবেদন সরকারের কাছে জমা দিয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, সারা দেশে ৯১টি জমি প্রকল্প থাকলেও এর মধ্যে ৫০টি প্রকল্পে কোনো জমি বাকি নেই। এর বাইরে ১৮টি বাড়ি ও ১৮টি কম্পানি রয়েছে যুবকের। তবে জমি, বাড়িসহ অন্যান্য সম্পদ বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে। তাই যুবকের যেসব সম্পত্তি এখনো রয়েছে, একজন প্রশাসক নিয়োগের মাধ্যমে সেগুলো বিক্রি করে গ্রাহকদের বিনিয়োগ করা আসল অর্থ পরিশোধের সুপারিশ করেছে কমিশন। প্রশাসক নিয়োগ না হওয়া পর্যন্ত এসব সম্পত্তি সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসক বা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার আওতায় নিতে বলেছে কমিশন। একই সঙ্গে যুবক ও এর সহযোগী সব সংস্থার নিবন্ধন বাতিলেরও সুপারিশ করেছে দুই সদস্যবিশিষ্ট এ কমিশন।
যুবকের সম্পত্তি, জমি, বাড়ি, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও নগদ টাকা বেহাত করার দায়ে ৪০ জনের নাম উল্লেখ করেছে কমিশন। এই ৪০ জনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ফৌজদারি মামলা করার সুপারিশও করেছে কমিশন। এ ছাড়া দ্বিপক্ষীয় বিরোধিতা রয়েছে এমন সম্পত্তি যেমন বিকে টাওয়ার, একটি টেলিভিশন চ্যানেল, সাবেক সচিব মো. মোকাম্মেল হক ও ভোলার চেয়ারম্যান মজনু মিয়ার সঙ্গে জমি ক্রয়-বিক্রয় ও লেনদেনসংক্রান্ত জটিলতা, অতীশ দীপঙ্কর বিশ্ববিদ্যালয়ের বকেয়া ভাড়াসংক্রান্ত বিষয়াদিও প্রশাসকের মাধ্যমে নিষ্পত্তির সুপারিশ করেছে কমিশন। যুবক কমিশনের সদ্য সাবেক চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম গত বৃহস্পতিবার কালের কণ্ঠকে বলেন, 'যুবকের গ্রাহকদের পাওনা অর্থ পরিশোধ করতে হলে যুবকের সম্পত্তি দ্রুত সরকারের নিয়ন্ত্রণে নিতে হবে। পরে কম্পানি আইন সংশোধন করে বা নতুন আইন প্রণয়ন করে যুবকে প্রশাসক নিয়োগ দেওয়ার পর তা বিক্রি করে গ্রাহকদের বিনিয়োগ করা আসল অর্থ ফেরত দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। একই সঙ্গে তিন লাখেরও বেশি সাধারণ বিনিয়োগকারীর সঙ্গে প্রতারণাকারীদের বিরুদ্ধে চলমান মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি করতে হাইকোর্টের বিচারকদের নিয়ে একটি বিশেষ বেঞ্চ গঠনের সুপারিশও করেছি।'
যুবকের এ প্রতারণার জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোকেও দায়ী করেছে কমিশন। প্রতিবেদনে এ বিষয়ে কমিশন বলেছে, 'যেসব বিভাগ, মন্ত্রণালয় এসব অপরাধ রোধ ও নিয়ন্ত্রণ করার দায়িত্বে ছিল তারা সময়মতো তাদের দায়িত্ব ঠিকমতো পালন করেনি। সময়মতো সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা তাঁদের নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করলে এত বড় আর্থিক দুর্যোগ বা মানবিক বিপর্যয়ের সৃষ্টি হতো না।'
আত্মসাৎকারী ৪০ জন : কমিশনের প্রতিবেদনে যুবকের গ্রাহকদের অর্থ-সম্পদ আত্মসাৎকারী হিসেবে ৪০ জনের নাম-ঠিকানা উল্লেখ করে বলা হয়, অনুসন্ধানে এদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। এই ৪০ জনের মধ্যে প্রথম ৩৬ জনের নামের তালিকা কালের কণ্ঠের হাতে রয়েছে। এ তালিকার প্রথমেই রয়েছেন যুবকের চেয়ারম্যান আবু মোহাম্মদ সাঈদ। অন্যদের মধ্যে যুবকের নির্বাহী পরিচালক হোসাইন আল মাসুম, যুবকের পরিচালক মো. মনির উদ্দিনের নামও রয়েছে। যুবকের স্মারকে এই তিনজনের যে ঠিকানা রয়েছে সেখানে তাঁরা কেউই এখন আর নেই বলেও কমিশন প্রতিবেদনে বলেছে।
যুবকের গ্রাহকদের বিনিয়োগ করা অর্থ-সম্পদ আত্মসাৎকারী হিসেবে কমিশন অন্য যাদের নাম উল্লেখ করেছে, তার মধ্যে রয়েছেন সুনীল কুমার বিশ্বাস। যুবক হাউজিং লিমিটেডের জমি নিউ ফ্যান্টাসি হাউজিংয়ে স্থানান্তর করেছেন তিনি। সুনীল কুমার বিশ্বাস নিউ ফ্যান্টাসি হাউজিংয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। যুবকের টাকায় তিনি এ প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন বলে কমিশন উল্লেখ করেছে।
যুবকের আমানত খেয়ানতকারীদের মধ্যে আরো আছেন মাসুদ পারভেজ মানিক ও মো. লোকমান হোসেন। তাঁরা যুবকের সহযোগী প্রতিষ্ঠান যুবক হাউজিং অ্যান্ড রিয়েল এস্টেট ডেভেলপমেন্ট লিমিটেডের শীর্ষ পদে ছিলেন। ভিক্টোরি হাউজিং লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নুর হোসেন জুয়েলের বিরুদ্ধেও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে বলে কমিশন প্রতিবেদনে দাবি করেছে।
কমিশন বলেছে, নারায়ণগঞ্জ হাউজিংয়ের চেয়ারম্যান হাবিব উল্লাহ মিয়া ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক ওবায়দুর রহমান যুবক হাউজিংয়ের জমি তাঁদের নিজস্ব প্রকল্পে স্থানান্তর করেছেন। আর ঢাকার শুক্রাবাদের ফরিদা ইয়াসমিন আফরোজা, মোহাম্মদপুরের মো. সিরাজ উদ্দিন, মাকসুদা রহমান, উত্তরার আনোয়ার বেগম ও ধানমণ্ডির হামিদা বেগম যুবক হাউজিংয়ের জমি স্থানান্তর করেছেন প্রোগ্রেসিভ হাউজিংয়ের নামে। তাঁদের মধ্যে ফরিদা ইয়াসমিন প্রোগ্রেসিভ হাউজিংয়ের চেয়ারম্যান এবং সিরাজ উদ্দিন ব্যবস্থাপনা পরিচালক। মাকসুদা রহমান, আয়োনারা বেগম ও হামিদা বেগম আছেন পরিচালক হিসেবে।
প্রতিবেদনে যুবক হাউজিংয়ের জমি স্থানান্তর করার অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে উল্লেখ করা হয়েছে নিউ ফ্যান্টাসি হাউজিংয়ের পরিচালক লুৎফুন্নেছা মিনু, ওয়াহেদ মিল্টন ও রুকসানা আক্তারের বিরুদ্ধে। এ ছাড়া যুবকের সহযোগী প্রতিষ্ঠান টেলিবার্তার ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ এন এম গোলাম সারওয়ার ও পরিচালক শাহনাজ বেগমকেও অর্থ-সম্পদ আত্মসাতের জন্য দায়ী করেছে কমিশন।
প্রতিবেদন পেশ : মো. রফিকুল ইসলামের নেতৃত্বে ২০১১ সালের ৪ মে গঠিত যুবক কমিশন প্রতিবেদনটি তৈরি করে। গত ৩ মে কমিশনের মেয়াদ শেষ হওয়ার তিন দিন পর ৬ মে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে প্রতিবেদনটি জমা দিয়েছেন কমিশন চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম। কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে তৈরি করা সারসংক্ষেপ অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের কাছে পাঠিয়েছেন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব ড. এম আসলাম আলম। অর্থ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা জানান, মন্ত্রীর নির্দেশনা মোতাবেক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এসব বিষয়ে কথা বলতে যুবকের নির্বাহী পরিচালক হোসাইন আল মাসুমের মোবাইল ফোন নম্বরে কয়েক দিন ধরে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তা বন্ধ পাওয়া যায়। বিনিয়োগকারীদের ভয়ে তিনি এবং সংস্থাটির অন্যরা বেশির ভাগ সময়ই আত্মগোপনে থাকেন বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে।
ভবিষ্যতে যাতে যুবকের মতো আর কোনো প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠতে না পারে, সে জন্য একটি স্থায়ী কমিশন গঠনের সুপারিশ করেছে কমিশন। এ ছাড়া যুবকের কর্মকর্তাদের নামে কেনা সব স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি প্রশাসনিক বা বিচারিক আদেশের মাধ্যমে বাজেয়াপ্ত বা অধিগ্রহণ করতে বলা হয়েছে। ড. ফরাসউদ্দিন কমিশনের জারি করা গণবিজ্ঞপ্তির পর যুবক যেসব সম্পত্তি নামে-বেনামে বিক্রি বা হস্তান্তর করেছে, তা আইনিভাবে উদ্ধার করে সরকারের হেফাজতে নিতে হবে। যুবকের উত্থান প্রসঙ্গে কমিশন বলেছে, যুবকের অশুভ উত্থানের পেছনে ভূমিকা রেখেছে সরকারি ছত্রচ্ছায়া। এ ছাড়া তৎকালীন মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, রাজনৈতিক নেতা ও আমলাদের পৃষ্ঠপোষকতা ছিল। যুবকের শীর্ষপর্যায়ের কর্মকর্তাদের শাস্তি প্রসঙ্গে কমিশন আইনজীবীদের উদ্ধৃত করে বলেছে, নতুন আইন প্রণয়ন না করা পর্যন্ত এই প্রতারকচক্রকে কাঠগড়ায় তোলা যাবে না।
এদিকে কমিশন সূত্রে জানা গেছে, যুবকের অবৈধ ব্যাংকিং কার্যক্রম বাংলাদেশ ব্যাংক বন্ধ করার পরও সংস্থাটি সারা দেশে কয়েক শ সমবায় সমিতি গড়ে তুলেছে। ঢাকার নবাবগঞ্জে উর্বশী বহুমুখী সমবায় সমিতি, পটুয়াখালীতে দুমকী যুবকল্যাণ বহুমুখী সমবায় সমিতি, নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে আইডিয়াল বহুমুখী সমবায় সমিতিসহ বিভিন্ন নামে বিভিন্ন স্থানে সমিতি খুলে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করছে তারা। এ ছাড়া যুবকের গ্রাহকদের অর্থে কেনা ধানমণ্ডির ২৮ নম্বর রোডের ১৫ নম্বর বাড়ি ও কুমিল্লা শহরের ১০৪ শতক জমি অন্যত্র বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। এর বাইরেও মেঘনা সি ফুডস, বিচ হ্যাচারির শেয়ার ও সুইফট ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্টের মালিকানাও অসৎ উদ্দেশ্যে বিক্রি বা হস্তান্তর করেছে যুবক।
১৯৯৪ সালে সদস্যদের মধ্যে ক্ষুদ্রঋণ বিতরণের মধ্য দিয়ে যুবক কার্যক্রম শুরু করে। ওই সময় প্রায় ২০ ধরনের ব্যবসা শুরু করে সংস্থাটি। ২০০৬ সালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংকের আলাদা তদন্তে প্রতারণার বিষয়টি ধরা পড়ার পর ওই বছরের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে আমানতকারীদের টাকা ফেরত দেওয়ার নির্দেশ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। পরে সময়সীমা ২০০৭ সালের মার্চ পর্যন্ত বাড়ানো হয়। তবে যুবক গ্রাহকদের পাওনা ফেরত দেয়নি।

No comments

Powered by Blogger.