শাহরি রমজান-সৎ পথে উপার্জন প্রশিক্ষণের মাস by মাওলানা শাহ আবদুস সাত্তার

রমজানুল মোবারক আত্মশুদ্ধি ও ত্যাগ-তিতিক্ষার শিক্ষায় প্রতিনিয়ত রোজাদারদের উৎসাহিত করে। এ মাসে রোজাদাররা আল্লাহর পক্ষ থেকে রহমত, বরকত, মাগফিরাত এবং অশেষ নেয়ামত প্রাপ্ত হয়।
মানবজীবনে সততা ও হালালভাবে উপার্জিত অর্থ দ্বারা জীবিকা নির্বাহ করা একটি প্রধান গুণ। ইসলাম হালালভাবে অর্থ উপার্জনের তাগিদ দিয়েছে। উপার্জনের ক্ষেত্রে মানুষকে অনেক অসৎ চিন্তা পরিত্যাগ করতে হয়। নিজেকে সত্যবাদী, পরিশ্রমী, বিশ্বাসী, মিতব্যয়ী ও ইনসাফের প্রতি নজর দেওয়া বিশেষ প্রয়োজন।
রমজানুল মোবারকের পূর্ণতা পেতে হলে রোজাদারদের হালাল পন্থায় উপার্জিত খাবারদাবার থেকে শুরু করে সব কিছুই হালাল অর্থে হতে হবে, না হলে রোজার পূর্ণতা আদায় হয় না। আল্লাহর কবুলিয়ত পাওয়া যাবে না। তাই প্রত্যেক রোজাদারই চেষ্টা করেন রমজানের সেহরি, ইফতারের ব্যবহৃত জিনিসপত্রসহ যাবতীয় খরচাদি নিখুঁত-পবিত্র সৎ অর্থের মাধ্যমে নিজেদের পরিচালিত করতে। সত্যিকার রোজাদারদের অন্তর হারাম অর্থ থেকে অন্তত রোজার মাসে বিরত থাকার চেষ্টা করে। রোজার মাস চলে গেলে আবার অবৈধ পন্থায় উপার্জনের চিন্তা-চেতনা এসে রমজানের অর্জনটুকু বরবাদ করে ফেলে। তাই পবিত্র রমজানকে সৎ পথে জীবিকা অর্জনে প্রশিক্ষণের মাস হিসেবে গ্রহণ করতে হবে, যেন সারা বছর আমরা হালাল উপার্জন দ্বারা জীবিকা নির্বাহের পরম শিক্ষা লাভ করতে সমর্থ হই।
হালাল উপার্জনের প্রতি পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, 'হে ইমানদারগণ, আমি তোমাদের যে রিজিক দান করেছি, তাতে যা হালাল, পবিত্র তা-ই তোমরা গ্রহণ করো।' অন্যত্র বলা হয়েছে, 'তোমরা পবিত্র রুজি অর্থাৎ হালালভাবে অর্জিত রুজি দ্বারা জীবিকা নির্বাহ এবং সৎ কাজ করো।' হালাল রুজি দ্বারা জীবিকা অর্জন করা ফরজ। ইবাদত-বন্দেগি কবুল হওয়ার পূর্বশর্তই হচ্ছে সৎ উপার্জন। বলার অপেক্ষা রাখে না যে সৎভাবে জীবিকা উপার্জনের সুফলে হালাল খাদ্যদ্রব্য আহার করলে দেহ-মন-আত্মা সজীব হয়ে ওঠে। আত্মিক প্রশান্তি পাওয়া যায়।
অন্যদিকে অনেক মানুষ হারাম পথে উপার্জিত অর্থ দ্বারা সুস্বাদু খাদ্য আহার করেও মানসিক তৃপ্তি পায় না। তার অন্তর বলে ওঠে, 'খেলাম তো ভালোই কিন্তু অসৎভাবে হারাম উপায়ে এ জীবিকা অর্জন করে নিজে ভক্ষণ করেছি, পরিবারের সবাইকে খেতে দিয়ে অন্যায় করেছি। হারামভাবে অর্জিত অর্থ দ্বারা পেটভর্তি আহার করে অন্তর কলুষিত করেছি এবং আত্মার পবিত্রতা ও শক্তিকে বিপর্যস্ত করেছি।'
হাদিস শরিফে উল্লেখ করা হয়েছে, কেউ যদি হারাম উপার্জিত অর্থ দ্বারা এক লোকমা খাদ্য ভক্ষণ করে, তাহলে তার ৪০ দিনের ইবাদত বাতিল হয়ে যায়। অসৎ পন্থায় জীবিকা উপার্জনকারীদের গুনাহ বেড়ে যায় এবং ইবাদত-বন্দেগি বাতিল হয়ে যায়। আল্লাহর দরবারে কবুল হয় না। হজরত রাসুলে করিম (সা.) আরো বলেছেন, যে ব্যক্তি সৎ ও হালালভাবে জীবিকা অর্জন করে, রোজ কেয়ামতের দিন তার মুখমণ্ডল পূর্ণিমার চাঁদের মতো উজ্জ্বল হয়ে উঠবে।
হারাম খাদ্য খেয়ে যে দেহ সতেজ ও পুষ্ট হয়, ওই দেহ নিয়ে সে বেহেশতে প্রবেশ করতে পারবে না। সৎ জীবিকা আহরণ এবং এর সুফল সম্পর্কে হজরত ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত আছে, কোনো ব্যক্তি যদি ১০ দিরহাম মূল্য দিয়ে এক টুকরা কাপড় ক্রয় করে, আর সেই ১০ দিরহামের এক দিরহাম যদি হারাম উপার্জনের হয়, তবে ওই কাপড় পরিধানকারী যত দিন তা ব্যবহার করবে তার নামাজ কবুল হবে না।
আল্লাহ মানুষের বাস্তব জীবনে আয়-উপার্জন করে সৎভাবে জীবিকা নির্বাহ করার বহু পথ খোলা রেখেছেন। যেমন- ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকরি-বাকরি, অফিস-আদালত, বিবিধ কলকারখানা, যানবাহন, ক্ষেত-খামারে দিনমজুর বা শ্রমিকের কাজ করা ইত্যাদির মধ্যে সর্বোৎকৃষ্ট ও সর্বাধিক লাভজনক উপার্জনের পন্থা হলো হালালভাবে ব্যবসা-বাণিজ্য করা। হজরত রাসুলে করিম (সা.) ইরশাদ করেছেন, সত্যবাদী ও সৎ ব্যবসায়ীরা পরকালে আম্বিয়া সিদ্দিকীন ও শহীদানের সঙ্গে থাকবে। আল্লাহ সৎ পথে জীবিকা অর্জনের সুন্দর ও সহজ পথ খোলা রেখেছেন; কিন্তু আমরা অনেকেই সেই পথের বিপরীতে অসৎ অভিশপ্ত উপায়ের আশ্রয় গ্রহণ করি।
পবিত্র রমজান মাস চলছে। ইবাদত-বন্দেগির এ মাসে আমরা যেন খাঁটি মুসলমান হয়ে অন্যায় ও হারাম পথে, জোর-জুলুম করে লুকোচুরির মাধ্যমে অন্য মানুষ ঠকানো ও সর্বস্বান্ত করার মানসিকতা বর্জন করার শপথ নিতে পারি। এ রমজান মাসটি মূলত সব দিক দিয়েই সারা বছরের বিবিধ সৎ কাজে মানসিকতা, ত্যাগ-তিতিক্ষা ও আত্মশুদ্ধি করার এক চমৎকার প্রশিক্ষণের পবিত্র মাস। আমরা এ মাসে সৎ জীবিকা অর্জন করে প্রশিক্ষিত হয়ে পরবর্তী বছরে সৎ উপার্জনের পথে অটল ও অবিচল থাকব।
লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশ সিরাত মিশন

No comments

Powered by Blogger.