সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ-ক্ষমতাসীনদের রাজনীতি কোন পথে by আলমগীর হোসেন

বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে আওয়ামী লীগের যেসব নেতাকর্মীর ওপর বর্বরোচিত হামলা-মামলা, সীমাহীন অত্যাচার-নির্যাতন হয়েছিল, এমনকি ছেলে রাজনীতি করার কারণে বৃদ্ধ পিতা অথবা ওই পরিবারের স্কুলপড়ূয়া ছাত্র পর্যন্ত এদের অত্যাচার-নির্যাতন থেকে রেহাই পায়নি,
তারা আজ কোথায়? আওয়ামী লীগ কি এসব নেতাকর্মীর কোনো মূল্যায়ন করেছে? অবহেলিত-বঞ্চিত-অত্যাচারিত নেতাকর্মীর পরিবারের খবর নিয়েছে? তারা অত্যাচার-নির্যাতনের শিকারই নয় শুধু, জীবনের সবটুকু উজাড় করে দিয়ে গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর পক্ষে ভোটযুদ্ধে লড়াই করে বিজয় ছিনিয়ে এনেছিল। কোথায় তাদের মূল্যায়ন? রাষ্ট্রক্ষমতায় এসে নিজেদের আখের গোছানোর তালে বিভোর থেকে কি তারা আগামী নির্বাচনের বৈতরণী পার হওয়ার স্বপ্ন দেখেন? চারদিকে কিসের আলামত। দল কি কারও ব্যক্তিগত সম্পদ নাকি সমষ্টিগত, দলের আদর্শে বিশ্বাসী হয়ে দলের কর্মকাণ্ডে সাংগঠনিক অংশগ্রহণকারীদের সম্পদ।
গণতন্ত্রের জন্য গলা ফাটাই, গণতন্ত্রের জন্য জীবন উৎসর্গ করে দেব; দলের ভেতরে কতটুকু গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি, অন্যের কথা বলার অধিকার আছে কি-না? গণতন্ত্র কাকে বলে? নির্বাচন এলে দু-চারটি মায়াকান্না কথায় হাজার হাজার নেতাকর্মীর মন গলবে? যদি গলত তাহলে সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ফলাফল এমন হতো না।
কোনো ব্যক্তিকে বা তার পরিবারকে ক্ষমতাসীন এবং অর্থশালী পরাক্রম ব্যক্তি বা পরিবার হিসেবে গড়ে তোলার জন্যই কি হাজার হাজার নেতাকর্মী রাজনীতি করে? অবশ্যই করে না। তোষামোদ করার রাজনীতি শেষ। জমিদার পরিবারের রাজনৈতিক নেতাদের নেতাকর্মীরা তোষামোদ করত। এখন যুগ পাল্টে উরমরঃধষ যুগ হয়েছে। এ আমলে সাধারণ ঘরের কোনো নেতা জমিদারদের মতো তোষামোদ আশা করলে ভুল হবে। স্বাধীনচেতা ছাত্র-যুবসমাজ কালোকে কালো এবং সাদাকে সাদা বলতে চায়। তারা মনে করে রাজনীতি করে দল যদি কিছু অর্জন করে, এখানে আমার নূ্যনতম অধিকার আছে। সব অধিকার থেকে আমাকে কেউ বঞ্চিত করতে পারে না। দল রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসার পর স্পষ্টত একটি গ্রুপ ক্ষমতার কিছু স্বাদ পেয়ে ক্ষমতায় আসীন ব্যক্তির তোয়াজ করছে। কিন্তু বিরাট অংশ অবহেলিত বঞ্চিত। তারা ক্ষুব্ধ। ক্ষমতায় আসীন ব্যক্তি তৃণমূল নেতা-কর্মীদের তোয়াজ না পেয়ে তাদের দূরে সরিয়ে রেখে দলকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। তার ওপর গ্রুপিং তো আছেই। যার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি সিটি করপোরেশন নির্বাচনের আজকের ফলাফল। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাত্র ৫-৬ মাস বাকি_ এ অল্প সময়ের মধ্যে ক্ষমতাসীনরা কি পারবে দলের এ অবস্থার পরিবর্তন করে দলকে সঠিক নেতৃত্ব দিতে? তা প্রায় অসম্ভব; ভবিষ্যৎ নির্বাচনে এর প্রভাব পড়তে বাধ্য।
চারদিকে আওয়ামী লীগের বন্ধুর চেয়ে শত্রুর সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। এ অবস্থায় সব পর্যায়ে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের ঐক্যবদ্ধ থাকার কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু যে বেদনা হৃদয়ে বিঁধে আছে, তা শোধরাবে কে? প্রথমে দলের নেতাকর্মীদের আস্থায় আনা তারপর তাদের নিয়ে নিজ নিজ গ্রামে/ওয়ার্ডে দলনিরপেক্ষ ভোটারদের কাছে যাওয়া এবং তাদের দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত করা খুবই জরুরি। দলের নেতাকর্মী নেতার প্রতি আস্থা হারালে কারা দলের গুণগান গাইবে? সাধারণ মানুষের কাছে দলের ভালো ভালো সফলতার কথা কারা বলবে? প্রচারের অভাবে সব সফলতা বিলীন হয়ে যাবে, নিষ্ফল হয়ে যাবে। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা, শিক্ষা খাতে অভাবনীয় সফলতা, স্বাস্থ্যে আছে সফলতার দিগন্ত এবং অন্যান্য অনেক উন্নয়নমূলক কাজ যুগান্তকারী অধ্যায় সূচনা করেছে। সরকার, দলের সফলতা অবশ্যই আছে। কিন্তু যেভাবে প্রচার পাওয়া দরকার, তা হচ্ছে না মোটেও।
আওয়ামী লীগের কর্তাব্যক্তিরা গত সাড়ে চার বছরে বেশির ভাগ সময় নষ্ট করেছেন নিজ দলের নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে রাজনৈতিক কৌশল নির্ধারণ করতে। বিরোধী দলের রাজনীতির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নিজের পক্ষে অথবা নিজ দলের পক্ষে কাজ করতে পেরেছেন খুবই কম, তারপর নিজে, আত্মীয়স্বজন এবং চাটুকারদের তয়-তদবির নিয়ে ব্যস্ত থেকেছেন। দলের ক্ষতিগ্রস্ত নেতাকর্মীদের ত্যাগ, নেতাকর্মীদের নিয়ে ভাবার সময় কোথায়! নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকায় জনহিতকর কাজ করে ওই এলাকার সংশ্লিষ্ট গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সংযোগ ঘটিয়ে ব্যাপক জনমত নিজের এবং দলের পক্ষে গড়ে তোলার প্রয়োজন মনে করেননি। দলের ভেতর উপদল তৈরি করে কাউকে শাসন আবার কাছের মানুষদের সুবিধা দেওয়ার চেষ্টায় বিভোর থেকেছেন। ফলে দলের অধিকাংশ নেতাকর্মী হয়েছে রাজনীতিবিমুখ। দল ঝিমিয়ে পড়েছে। তা ছাড়া ক্ষমতাসীন ব্যক্তির আত্মীয়-স্বজনের দাপটে দলের নেতাকর্মী কোণঠাসা হয়ে কোনো রকম মান-সম্মান রক্ষা করে চলার চেষ্টা করেছে। বিরোধী দলে থাকা অবস্থায় সংগঠনের সব ক্রিয়া-কর্ম চলত সংগঠন দ্বারা। ক্ষমতায় আসার পর সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে গেছে। নিজ আত্মীয়-স্বজনই হয়ে উঠেছে প্রধান। সংগঠনের সঙ্গে দূরত্ব বেড়েছে, দূরত্ব বেড়েছে জনগণের সঙ্গে। পত্র-পত্রিকা পড়লে মনে হয় আওয়ামী লীগ করে নেতাকর্মীরা না-জানি কত সুবিধায় আছে কিন্তু এমন কর্মীর কথা লেখা হয় না যারা বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে কয়েকবার জেল খেটেছে, ১২-১৪টি মিথ্যা মামলার আসামি হয়ে বছরের পর বছর কোর্ট-কাচারি আর থানায় হাজিরা দিয়ে অর্থ ব্যয় করে জীবনের মহামূল্যবান সময় নষ্ট করেছেন। অথচ দল ক্ষমতায়_ তারা এক কাপ চা কিনে খাওয়ার মতো সুবিধাও পায়নি।
একদিকে ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী এ দলটির ইসলামিক চেতনার সমর্থন নেই বললেই হয়। তারপর নিজেদের মধ্যে আত্মকলহ দলকে এমন অবস্থায় নিয়ে গেছে, যেন ক্ষেত্রবিশেষে নিজের দলের চেয়ে বিরোধী দলের নেতাকর্মীরাই আপন। একজন রাজনৈতিক কর্মী জীবন-যৌবন মিথ্যা করে জীবনের মহামূল্যবান সময় দলের জন্য, দলের নেতার জন্য ব্যয় করেন। ক্ষেত্রবিশেষে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দলের জন্য কাজ করেন। জেল-জুলুম, হামলা-মামলা মাথায় নিয়ে বিরামহীনভাবে রাজনীতিতে সক্রিয় থাকেন। তারপর যখন দেখেন দল ক্ষমতায় আসার পর তার মূল্য নেই, ক্ষমতাবান ব্যক্তি তার আত্মীয়-স্বজন আর চাটুকারদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। জেল খাটা, হামলা-মামলার শিকার হওয়া, এগুলো সবই বেকার, বৃথা; মিথ্যা সব আশা-ভরসা, সে কী কারণে আবার ওইসব নেতার জন্য ঝুঁকি নেবে? এভাবে অনেক সক্রিয় কর্মী হয়েছে নিষ্ক্রিয়, জাতীয় পর্যায়ের ব্যর্থতা তো আছেই।
অযোগ্য লোকদের কারণে সব সফলতা যেন ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় যে অন্যায়-অত্যাচার, নির্যাতন, লুটপাট হয়েছে তা যেন সবকিছু নিমিষে ধুয়ে-মুছে গেছে। ক্ষমতাসীনরা সঠিকভাবে প্রচার না করার কারণে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সব অপকর্ম জনগণ ভুলতে বসেছে। এসব নেতার ব্যর্থতার কারণে যদি আবার তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের জেলে যেতে হয়, মিথ্যা মামলার আসামি হতে হয়, নির্যাতনের শিকার হতে হয়, জীবন দিতে হয়, এর দায়ভার থেকে নেতারা কেউ রেহাই পাবেন না। সেদিন বেশি দূরে নয়, তৃণমূল নেতাকর্মীরা নেতাদের ব্যর্থতার জন্য জবাব চাইবে।

স আলমগীর হোসেন :সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.