সরল গরল সংবিধান নিয়ে পুলিশের মিথ্যা মামলা by মিজানুর রহমান খান

র্যাবের গুলিতে পা হারানো লিমনের বিরুদ্ধে র্যাবের দায়ের করা মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করা হয়েছে। কিন্তু আমরা বিস্মিত যে বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের ভাবমূর্তির প্রশ্নে জড়িত এমন একটি মিথ্যা মামলা এখনো প্রত্যাহার করা হয়নি।
যশস্বী কলাম লেখক সৈয়দ আবুল মকসুদ এর দুটি শিরোনাম দিয়েছিলেন। ক্ষমতার প্রয়োগ ও অতি প্রয়োগ কিংবা বিচার আগে না শাস্তি আগে। দুটোই বেশ জুতসই।
গতকাল (শনিবার) ফোন করেছিলাম আসাদুজ্জামানের কাছে। তিনি বঙ্গবন্ধু সেতুর টোল প্লাজার কর্মকর্তা। জানালেন তাঁর মামলাটি ডিসমিস হয়ে গেছে। তাঁকে বলি, ডিসমিস হয়নি। বরং আজ এই মামলার তারিখ। তখন তিনি সন্ত্রস্ত হলেন। কেউ টোল না দিলে তাঁর গাড়ি থামানোই তাঁর পেশা। অথচ এটা করতে গিয়ে তিনি এক দিন জেল খাটেন। বঙ্গবন্ধু সেতুর টোল আদায়কারী চীনা কোম্পানির মালয়েশীয় পরিচালক ইউস্রি বিন ইউসুফ অবশ্য এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু সেতু কর্তৃপক্ষ বিবিএর নির্বাহী পরিচালককে একটি চিঠিও দিয়েছেন। তিনি বললেন, ‘সরকারের সঙ্গে আমাদের চুক্তি অনুযায়ী আসাদ তাঁর কর্তব্য পালন করেছিলেন। তবে আচরণগত ব্যত্যয় ঘটলে তাঁরা দুঃখিত।’ প্রত্যক্ষদর্শী অন্য পদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গেও আমি পরদিন টেলিফোনে কথা বলি। তাঁরা বলেন, তাঁর (আসাদের) কোনো ভুল হয়ে থাকলে সে জন্য বিচারকের কাছে আমরা ক্ষমা প্রার্থনা করেছিলাম। তবে পুরো ঘটনার অভিনবত্ব হচ্ছে সংবিধান লঙ্ঘনের অভিযোগে ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার করা। সংবিধান লঙ্ঘনের দায়ে হাইকোর্টের রায়ে দোষী সাব্যস্ত হয়েও জেনারেল এরশাদ ডুগডুগি বাজিয়ে চলেছেন। সেই দেশে সংবিধান লঙ্ঘনের দায়ে তবু তো একটা নগদ শাস্তির ঘটনা ঘটল।
গত ১০ জুন আমরা এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রারের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট মাননীয় বিচারপতির বরাবর একটি পত্র দিই। এতে বলি যে, গত ৪ জুন ২০১৩ পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) আবদুল হালিম আদালতে একটি প্রতিবেদন পেশ করেন। এতে তিনি দাবি করেন, ‘বিচারকের পরিচয় জেনেও উক্ত আসামি অবৈধভাবে তাঁর গাড়ি প্রায় ১০ মিনিট আটকে রাখেন। এ ঘটনায় বাংলাদেশ সংবিধানের ১০৮ অনুচ্ছেদের লঙ্ঘন ঘটে। এতে তাঁর অপরাধ হয়। এই বিষয়ে মহামান্য বিচারপতি মহোদয় আসামি আসাদুজ্জামানকে গ্রেপ্তার করার মৌখিক নির্দেশ দেন। তিনি ঢাকায় ফিরে আসামির
বিরুদ্ধে বিচার কার্যক্রম গ্রহণ করবেন।...আপাতত ৫৪ ধারায় তাঁকে গ্রেপ্তার করে আদালতে সোপর্দ করা হলো।’
আসাদের বিরুদ্ধে কার্যত অসদাচরণের অভিযোগ আনা হয়েছে। এবং এর প্রতিকার হলো বিভাগীয় তদন্ত হওয়া। সংবিধান লঙ্ঘনের প্রশ্নই ওঠে না। আর আইনের শর্ত হলো, কোনো বিচারক তাঁর নিজের হেতুর বিচার করতে পারেন না। তাই তদন্ত ছাড়াই একজন নাগরিককে কারাগারে নিক্ষেপ আমাদের প্রাচীন ইংল্যান্ডের স্মৃতি স্মরণ করিয়ে দিয়েছে। কিংস বেঞ্চের সেকালের বিচারকেরা আদালত অবমাননাকারীর দুই হাত কেটে আদালতের ফটকে পেরেক দিয়ে পুঁতেও রেখেছেন। টোল প্লাজায় যা ঘটেছে তা আধুনিক বাংলাদেশের নিরিখে কম অভাবনীয় নয়। যদিও এটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আরও কিছু ঘটনা সমাজে বেশ আলোড়ন তুলেছে। ডেইলি স্টার-এ খবর বেরিয়েছিল যে প্রধান বিচারপতি এবং আপিল বিভাগ ওই ঘটনায় গভীর উষ্মা প্রকাশ করেছেন। তাই ভেবেছিলাম এর অবসান ঘটেছে। আসাদের হয়রানি শেষ হয়েছে। কিন্তু তা হয়নি। এই মামলায় নিম্ন আদালতে সকালে আসাদের জামিন নামঞ্জুর ও বিকেলে মঞ্জুরের ঘটনা ঘটেছে। টোল আদায়ের আইন ও বিধি পর্যালোচনায় প্রতীয়মান হয় যে পুলিশ যে অভিযোগ এনেছে, তা একটি সাজানো মামলা। এর বিবরণ আমাদের কাছে অবিশ্বাস্য মনে হয়েছে। আমি ৫ জুন তথ্য অধিকার আইনে সাধারণ ডায়েরির অনুলিপি চেয়েছি। পুলিশ তা দিতে অস্বীকার করেছে। তারা একটি উত্তর দিয়েছে, যাতে এর সংক্ষিপ্ত ভাষ্য আছে। আদালতে পাঠানো পুলিশের প্রতিবেদনে অসম্ভব কথা লেখা: ‘হাইকোর্ট বিভাগের মহামান্য বিচারপতি মহোদয় ঢাকা সফর শেষে না ফিরিয়া যাওয়া এবং বিচার কার্যক্রম শুরু না করা পর্যন্ত আসামিকে জেলহাজতে আটক করা একান্ত প্রয়োজন।’ ফিওদর দস্তয়ভস্কির ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট উপন্যাসের নায়ক রদিওন রাসকলনিকভ ভীষণ মানসিক ও নৈতিক দ্বন্দ্বে পড়েছিল। উচ্চতর লক্ষ্য অর্জনে সে নেপোলিয়ন বোনাপার্টের কথা ভেবে খুন করাকেও গ্রহণযোগ্যতা দিতে পেরেছিল। আমরা কোন লক্ষ্য সাধনে একে গ্রহণযোগ্যতা দেব, তা বুঝে উঠতে পারছি না।
সে কারণে আমরা আমাদের চিঠিতে উল্লেখ করি যে ‘একজন দায়িত্বশীল পুলিশ কর্মকর্তার উল্লিখিত বিবরণ আমাদের দারুণভাবে বিস্মিত করেছে।’ ১৯২৬ সালের আদালত অবমাননা আইন বাতিল করে ২০১৩ সালে নতুন আইন জারি করা হয়েছে। এর ৯ ধারা মতে, টোল প্লাজার ঘটনা ‘অন্য কোনো কার্য’, যা এই আইনের পরিধিভুক্ত গণ্যে আদালত অবমাননার দায়ে শাস্তিযোগ্য হবে না। বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক রায় দিয়েছেন, ‘সংবিধানের ১০৮ অনুচ্ছেদ সুপ্রিম কোর্টের একটি কোর্ট অব রেকর্ড হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করত ইহার অবমাননার জন্য তদন্তে আদেশদান বা দণ্ডাদেশ দানের ক্ষমতাসহ আইন সাপেক্ষে অনুরূপ আদালতের সকল ক্ষমতার অধিকারী করিয়াছে। কিন্তু ১০৮ অনুচ্ছেদ সুপ্রিম কোর্টকে নতুন করিয়া কোনো ক্ষমতা বা এখতিয়ার প্রদান করে নাই।’ ওই রায়ে তিনি আরও বলেন, ‘সাধারণত ১০২ অনুচ্ছেদে প্রদত্ত আদেশ প্রতিপালিত না হইলেই ১০৮ অনুচ্ছেদ অনুসারে আদালত অবমাননার অভিযোগ উত্থাপিত হইয়া থাকে। অবস্থা অনুসারে সেইরূপ মামলা দায়ের ও ইহার কার্যক্রম হাইকোর্ট ন্যায়-বিচারকল্পে ও আইনের শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রাখিয়া নির্ধারণ ও নিষ্পত্তি করে।’ আমরা এটাও অবহিত করি যে, ‘পুলিশ কর্মকর্তা বিষয়টি কর্তব্যরত টোল আদায়কারী কর্মকর্তার ব্যক্তিগত অসদাচরণগণ্যে অভিযুক্ত করতে পারতেন। কিন্তু দৃশ্যত আপনার বরাতে আদালতে লিখিতভাবে যে ধরনের বিবরণ দিয়েছেন, তা রীতিমতো অবিশ্বাস্য এবং প্রচলিত আইনের গুরুতর বিচ্যুতি বলেই প্রতীয়মান হয়। এর সঙ্গে মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের ভাবমূর্তি জড়িয়ে পড়েছে বলে আমাদের বিশ্বাস। আদালতের সুমহান মর্যাদা সুরক্ষার ব্রত থেকেই আমরা তাই ওই বিবরণের সত্যতা যাচাইয়ের চেষ্টা করেছি।’
সুপ্রিম কোর্ট রেজিস্ট্রার গতকাল নিশ্চিত করেন যে তিনি আমাদের চিঠি বিচারপতি মহোদয়ের কাছে পাঠিয়েছিলেন। তবে তিনি তা তাৎক্ষণিক তাঁর কাছে ফেরত পাঠিয়ে দেন। ঈশ্বরদী শহরের মাওলানা আবুল খায়ের রিজভি আমাকে বলেন, বিচারপতি সপরিবারে তাঁর বাড়িতে নিমন্ত্রণ রক্ষা করেন। কারণ, তিনি দোয়া করেছিলেন। তাতে উপকার মিলেছে। তাই ধন্যবাদ জানাতে এসেছেন। অবশ্য ওই অঞ্চলের একটি বৃহৎ মাদ্রাসার অধ্যক্ষসহ অনেকেই আমাকে বলেছেন, আবুল খায়ের জিন হাজির করতে পারেন। তিনি অবশ্য জিন হাজির করার কথা অস্বীকার করেন। বলেন, ‘জিনে ধরলে আমি ফুঁ-ফা দিই।’ এর চেয়েও বড় কথা, তিনি আহলে সুন্নত আল জামায়াতের সুপরিচিত নেতা। রিজভি তরিকায় ‘মোজাহারে ইসলাম’ নামে একটি মাদ্রাসা চালান, যা সরকারিভাবে নিবন্ধিতও নয়। ভারতের বারলেভিতে মাদ্রাসায় পড়েছেন তিনি, সেই সুবাদে তিনি বারলেভির খাদেম। তারা সবুজ পাগড়িধারী। রিজভি তরিকার একটি পাকিস্তানি টিভি চ্যানেল (মাদানি) বিহারি-অধ্যুষিত ঈশ্বরদীতে জনপ্রিয়। আবুল খায়েরও সবুজ পাগড়ি পরেন। হেফাজতের বিরুদ্ধে ‘আহলে সুন্নত’-এর ১৩ দফা দাবি বর্তমানে সরকারের পক্ষে যাচ্ছে। কিন্তু আহলে সুন্নত সন্দেহমুক্ত নয় বলে অধ্যাপক আলী রীয়াজ যে দাবি করেছেন, তার সঙ্গে আমরা একমত। পাকিস্তান তাদের নিষিদ্ধও করেছে। মার্কিন সরকারের উদ্বেগ আছে। বাংলাদেশে ব্লাসফেমি আইনের দাবিতে আন্দোলনসহ তাদের নানা বিতর্কিত কার্যক্রম রয়েছে। ওই নেতার বাড়িতে সুপ্রিম কোর্টের একজন বিচারকের ব্যক্তিগত সফরেরও একটি অসাধারণ সামাজিক তাৎপর্য রয়েছে। বাংলাদেশ সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদের আওতায় প্রণীত আচরণবিধিতে বলা আছে, A judge should respect and comply with the law and should act at all times in a manner that promotes public confidence in the integrity and impartiality of the judiciary.
আমরা ১৩ জুনের মধ্যে রেজিস্ট্রারের দপ্তরের সাড়া আশা করেছিলাম। গতকাল ১৩ জুলাই পেরিয়ে গেলেও কোনো উত্তর পাইনি। গত ৫ জুন আমি আবদুল হালিমের সঙ্গে কথা বলি, এর বিবরণ এ রকম: ১০৮ অনুচ্ছেদের কথা জানলেন কী করে? ‘বিচারপতি মহোদয় আমাকে বলেছেন। কাগজপত্র থাকলে ঘটনাস্থলেই তাঁকে জেল বা জরিমানা দিতে পারতেন।’ আপনি কীভাবে গ্রেপ্তার করলেন। পরোয়ানা জারি করেছিলেন? ‘না। মহামান্য বিচারকের মৌখিক অভিযোগের ভিত্তিতে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।’
আপনি কি গ্রেপ্তারের নির্দিষ্ট কারণ রেকর্ড করেছেন? ‘আরে ভাই, বললাম তো বিচারকের মৌখিক আদেশে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।’ সংবিধান লঙ্ঘন করলে কি ৫৪ ধারায়—‘এটা আমার ব্যাপার নয়। আদালতের ব্যাপার। আপনি কেন কোয়েরি করছেন। এটা করতে আপনার কোনো অধিকার নেই। এটা আপনি বুঝবেন না।’ কিন্তু আপনার কি মনে হয় না যে আইনের রক্ষক হয়ে এভাবে—‘আপনার কাছে এই কৈফিয়ত দিতে বাধ্য নই। যেটা বলেছি সেটাই লিখে দিন।’
এর ৩০ দিন পর গতকাল তাঁকে ফোন করি। কবে রিপোর্ট দিচ্ছেন? ‘কালকেই দেব।’ ওপর থেকে কোনো নির্দেশ পেয়েছেন? ‘আমি তিন-চার দিন আগে বিচারপতি মহোদয়ের কাছে ফোন করেছিলাম। তিনি অব্যাহতি দিতে রাজি হয়েছেন। তবে রিপোর্টের শেষে লিখে দেব এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের মামলা দায়েরের সুযোগ থেকেই যাবে।’ এর মানে আসাদ যে একেবারে বেঁচে গেলেন, তা নয়। আমরা হাসব, না কাঁদব।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.