হিন্দি চ্যানেলের আগ্রাসন ও অরক্ষিত তারুণ্য by শেখ মাসুদ কামাল

সম্প্রতি ভারতের সুপ্রিমকোর্ট সে দেশের বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলের অনুষ্ঠান নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তাদের মতে, এখন টিভিতে অশ্লীলতা ও হিংসার ছড়াছড়ি। পরিবারের সবাইকে নিয়ে একসঙ্গে টিভি উপভোগ করা যায় না। এ অবস্থায় সুপ্রিমকোর্ট উদ্বিগ্ন হয়ে এ ব্যাপারে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য সরকারের কাছে নোটিশ পাঠিয়েছে। প্রসঙ্গত বলে রাখা ভালো, আমাদের দেশের সিনেমা হলগুলোতে ঢালাওভাবে বিদেশী সিনেমা প্রদর্শিত হয় না। এ ব্যাপারে অনেকের আক্ষেপ থাকলেও সরকার দেশীয় চলচ্চিত্র শিল্পকে চলমান রুগ্ন দশা থেকে মুক্তি দেয়ার লক্ষ্যে এ নীতি গ্রহণ করেছে। কিন্তু সরকার চলচ্চিত্র শিল্পকে এ নীতি গ্রহণের মাধ্যমে সুরক্ষা দিতে সমর্থ হলেও আমাদের ড্রয়িংরুম অরক্ষিত হয়ে পড়েছে ডিশ অ্যান্টেনার বদৌলতে। সেখানে হরহামেশা রুচি বিগর্হিত অনুষ্ঠান ঢুকে পড়ছে। তবে বিটিভিতে বিদেশী চলচ্চিত্র দেখানোর ঐতিহ্য চালু রয়েছে। এক্ষেত্রে বিটিভির চলচ্চিত্র যেন আমাদের সামাজিক, ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক, ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক ঐতিহ্য ও মূল্যবোধের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হয়- এ বিষয়ে নজর দেয়ার বিধান রয়েছে।
আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থায় দেশীয় চলচ্চিত্র শিল্পকে সুরক্ষা দেয়ার পদক্ষেপ গ্রহণের তৎপরতা পরিলক্ষিত হলেও বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের ব্যাপারে একেবারে নির্লিপ্ত থাকতে দেখা যায়। আর এ খাতের সবচেয়ে বড় হুমকি হচ্ছে হিন্দি স্যাটেলাইট টেলিভিশন। দেশে বেশ কটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল রয়েছে। এ খাতটি ক্রমেই তার আওতা বৃদ্ধি করে চলেছে এবং জনগণের একটি আস্থা ও নির্ভরযোগ্যতা অর্জন করেছে। এখন টেলিভিশন মানেই স্যাটেলাইট টেলিভিশন ও টেলিভিশন দর্শক মানেই উপগ্রহবান্ধব টেলিভিশনের দর্শক। এসব স্যাটেলাইট টেলিভিশনের সম্প্রচারকে ঘিরে তৈরি হয়েছে শিক্ষিত, দক্ষ, রুচিশীল এবং কারিগরি নিপুণতায় প্রশিক্ষিত একদল কর্মীবাহিনী। বিপুল সংখ্যক শিক্ষিত ব্যক্তির কর্মসংস্থানের একটি উল্লেখযোগ্য খাত সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু বিদেশী বিশেষত হিন্দি ছবির আগ্রাসনের কারণে এ খাতটি নানা হুমকির মুখোমুখি হচ্ছে। এসব হিন্দি ছবিতে সারাদিন কুরুচিপূর্ণ সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের সঙ্গে সাংঘর্ষিক, নান্দনিকতা বিবর্জিত এবং যৌন উত্তেজনায় পরিপূর্ণ ছবি দেখানো হয়। এসব অনুষ্ঠান কোনোভাবেই বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় মূলনীতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয় বিধায় এগুলোর গ্রহণযোগ্যতা সব সময়ই বিতর্কিত একটি ব্যাপার। এসব হিন্দি চ্যানেলে প্রচারিত বিভিন্ন অনুষ্ঠান এবং তাদের প্রদর্শিত বিভিন্ন প্রকার ছবি আমাদের তরণ প্রজন্মকে রুচিগত দিক থেকে অধঃপতিত ও বিকৃত করছে।
দেশে যখন ডিশ অ্যান্টেনার প্রবেশ ঘটে, তখন এ বিষয়টি নিয়ে আমাদের সুধী মহলে অনানুষ্ঠানিক একটি বিতর্কের অবতারণা হয়েছিল। বিতর্কটি হচ্ছে- ডিশ সংস্কৃতির আগ্রাসন আমাদের দেশীয় সংস্কৃতির স্বাতন্ত্র্যকে বিনষ্ট করবে কিনা? একদল এ ভেবে উদ্বিগ্ন ছিল যে, ডিশ সংস্কৃতি আমাদের সাংস্কৃতিক স্বকীয়তাকে বিনষ্ট করবে। আরেক দল ছিল মুক্তআকাশ অর্থাৎ ডিশ সংস্কৃতির পক্ষে। কিন্তু ভারতে এ ধরনের কোনো বিতর্ক সূচিত হওয়ার কারণ ঘটেনি। কারণ ভারতে আমাদের দেশের কোনো টেলিভিশন প্রোগ্রাম প্রদর্শনের কোনো সুযোগ নেই। এ ব্যাপারে ভারত সরকার আরোপিত কোনো বিধিনিষেধের কথা আমাদের জানা নেই। ভারতীয় ক্যাবল অপারেটররা স্ব-উদ্যোগে সে দেশে বাংলাদেশের কোনো টেলিভিশন অনুষ্ঠানের সম্প্রচার বা প্রদর্শনী বন্ধ রেখেছে। এমনকি ভারতীয় ক্যাবল অপারেটররা কিছুদিনের জন্য হলেও পরীক্ষামূলকভাবে আমাদের দেশের টিভি অনুষ্ঠান তাদের দেশের বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে সম্প্রচার করেছিল, এমন তথ্য আমাদের জানা নেই।
১৯৯০ সালের মাঝামাঝি থেকে সমগ্র বিশ্ব ব্যবস্থায় একটি রাজনৈতিক পরিবর্তন আসে এবং সে পরিবর্তনটি অত্যন্ত দ্রুতগতিতে সম্পন্ন হয়। এর সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থায়ও পরিবর্তনের সূচনা ঘটে। আর বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সমান্তরালে মিডিয়ার ক্ষেত্রেও একটি পরিবর্তন আসে। এ পরিবর্তনকে অনেকে মিডিয়া বিপ্লব নামে আখ্যায়িত করেন। সেই মিডিয়া বিপ্লবের তরঙ্গাভিঘাতে আমরা পিছিয়ে থাকলেও আমাদের প্রতিবেশী দেশে এ বিপ্লবের তরঙ্গ এক মহাজাগরণ তৈরি করে। গড়ে ওঠে বেসরকারি টেলিভিশন খাত এবং ভারতের অপরাপর খাতের মতোই বিশাল অর্থনৈতিক বিনিয়োগের ফলে এটি একটি শক্তিশালী অবকাঠামো হিসেবে খুব স্বল্প সময়ের মধ্যেই এক বিশাল মহীরুহে পরিণত হয়েছে। বৃহৎ আয়তনের ও বিশাল জনসংখ্যা অধ্যুষিত ভারতের ডিশ টিভির এক বিশাল এ দেশীয় দর্শক তথা ভোক্তাবাজার তৈরি হয় এবং একই সঙ্গে নিজস্ব প্রস্তুতকৃত পণ্য ও ভারতে বাণিজ্যরত বিভিন্ন বহুজাতিক কোম্পানির বিজ্ঞাপনের সমবায়ে এ খাতটি ক্রমেই পুষ্টি লাভ করে। কাজেই একদিকে বিশাল ভোক্তা বাজারের আনুকূল্য ও অপরদিকে বিজ্ঞাপনের পৃষ্ঠপোষকতায় ভারতীয় বেসরকারি টেলিভিশন খাতের এক জ্যামিতিক প্রবৃদ্ধি ঘটে এবং তাদের আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। ভারতীয় টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর তুলনায় বাংলাদেশের টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর অনুষ্ঠানের গুণগতমান তেমন উৎকর্ষ লাভ করতে পারেনি। অধিকাংশ ব্যক্তিই এমন অভিমত পোষণ করেন। তবে এখানে একটি বিষয় আমাদের মানতেই হবে যে, ভারতের বাজার খুবই বিস্তৃত এবং সে তুলনায় আমাদের বাজার খুবই সীমিত। তদুপরি ভারতের বিশাল বিনিয়োগের তুলনায় আমাদের বিনিয়োগ খুবই সামান্য। এ অবস্থায় প্রতিবেশী দুদেশের বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর মধ্যে এক অসম প্রতিযোগিতা বিদ্যমান আছে এবং এ অসম প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের অবস্থান হবে পশ্চাৎপদ, এটাই স্বাভাবিক। সরকার দেশীয় চলচ্চিত্র শিল্পসহ অন্যান্য রুগ্ন শিল্পকে রক্ষার জন্য যেমন সুরক্ষা বা প্রতিরক্ষামূলক এক ধরনের নীতিমালা প্রণয়ন করেছে, তেমনি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলকে রক্ষার জন্য এ ধরনের নীতিমালা প্রণয়ন করতে বাধা কোথায়? অথচ এমন একটি নীতিমালা প্রণয়ন জরুরি ও সময়ের দাবি।
ভারতে বাংলাদেশের টেলিভিশন অনুষ্ঠান দেখার কোনো সুযোগ নেই। এ কথা আগেই বলেছি। কিন্তু বাংলাদেশের একজন টেলিভিশন দর্শকের দেশীয় অনুষ্ঠানমালা উপভোগ করার পাশাপাশি ভারতীয় বিভিন্ন চ্যানেলের অনুষ্ঠানমালা উপভোগ করারও সুযোগ রয়েছে। ভারতীয় এসব অনুষ্ঠানের আধিক্যই বেশি। ফলে সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবে হিন্দি চ্যানেলের প্রভাব আমাদের ওপর সবচেয়ে বেশি। আর এর ফলে আক্রান্ত হচ্ছে আমাদের তরুণ সমাজ তথা জাতির সবচেয়ে সম্ভাবনাময় প্রজন্ম। অনুকরণপ্রিয়তা এ বয়সের একটি অতি সাধারণ বৈশিষ্ট্য হওয়ায় তারা তাদের আচার-আচরণ, চলনে-বলনে এবং পোশাক-আশাকে হিন্দি রীতির প্রতিফলন ঘটাচ্ছে। এ কাজটি তারা করছে অত্যন্ত উৎসাহে এবং এর পরিণতি সম্পর্কে সম্যক কোনো ধারণা ছাড়াই। হিন্দি চ্যানেলের অনুকরণ ও অনুসরণ আমাদের তরুণ প্রজন্মর কাছে আধুনিকতার সমার্থক হয়ে পড়েছে। এমনকি প্রাত্যহিক জীবনের কথাবার্তায় বাংলা শব্দের সঙ্গে হিন্দি শব্দের মিশেল তথাকথিত স্টাইলে পরিণত হয়েছে। সার্বিক দিক বিবেচনায় বিশাল বিনিয়োগকৃত হিন্দি চ্যানেলগুলোর তুলনায় আমাদের স্বল্প পুঁজির চ্যানেলগুলোর টেকা দায় হয়ে পড়েছে।
বাংলাদেশকে হিন্দি চ্যানেলের আগ্রাসী প্রভাব থেকে মুক্ত করতে ও বেসরকারি টিভি চ্যানেলগুলোকে সুরক্ষা দিতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারেন আমাদের দেশীয় ক্যাবল অপারেটররা। ভারতীয় ক্যাবল অপারেটররা সে দেশে বাংলাদেশের কোনো টিভি চ্যানেল না দেখিয়ে যেভাবে তাদের দেশীয় শিল্পকে সুরক্ষা দিয়ে যাচ্ছেন, একইভাবে আমাদের ক্যাবল অপারেটররা তরুণ প্রজন্মকে হিন্দি চ্যানেলের আগ্রাসন থেকে বাঁচিয়ে তাদের দেশপ্রেমের পরিচয় দিতে পারেন। এছাড়া দেশে হিন্দি চ্যানেলের প্রদর্শনী বন্ধ হলে তা আমাদের দেশীয় চ্যানেলগুলোর জন্য আর্থিক মুনাফা লাভের এক সুযোগ তৈরি করবে। কারণ অনেক বহুজাতিক কোম্পানি কেবল হিন্দি চ্যানেলগুলোতেই তাদের পণ্যের বিজ্ঞাপন দিয়ে থাকে। যেহেতু হিন্দি চ্যানেলের অবাধ প্রদর্শনী বেশ নিশ্চিতভাবেই ঘটে চলেছে, ফলে বাড়তি পয়সা খরচ করে তাদের পণ্যের বিপণন ও ক্রেতা সৃষ্টির জন্য বাংলাদেশের কোনো চ্যানেলে বিজ্ঞাপন দেয়ার প্রয়োজন নেই। সার্বিক দিক বিবেচনায় দেশের সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য সংরক্ষণের প্রয়োজনে বিদেশী চ্যানেল বিশেষত হিন্দি চ্যানেলের অবাধ প্রদর্র্শনীর ব্যাপারে একটি সুস্থ ও সংরক্ষণমূলক নীতিমালা প্রণয়ন করা এখন সময়ের দাবি।
শেখ মাসুদ কামাল : প্রাবন্ধিক

No comments

Powered by Blogger.