আমার প্রিয় by নীলুফার মঞ্জুর

বিজয়া প্রতিমূর্তি জীবন্ত হয়ে ওঠে
আমার মা বই পড়তে ভীষণ ভালোবাসতেন। আমার বইয়ের প্রতি ভালোবাসা তৈরি করেন আমার মা।
তাঁর প্রিয় লেখক ছিলেন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তাঁর জীবনের অমূল্য সম্পদ ছিল শরৎ রচনাবলি। যেহেতু বই পড়ার ক্ষেত্রে আমি নীরবে মাকেই অনুসরণ করছি, তাই আমারও প্রিয় লেখক হয়ে গেলেন শরৎচন্দ্র। দত্তা উপন্যাসটি আমি বারবার পড়েছি। বিজয়ার প্রতিমূর্তি বারবার মূর্ত আর জীবন্ত হয়ে উঠত আমার মধ্যে। নিজেকে বিজয়া ভাবতে ভালো লাগত। রোমাঞ্চিত হতাম এই ভেবে যে, আমিও বিজয়ার মতোই দৃঢ়চেতা আর সাহসী।

দুই বিঘা জমি
শৈশব থেকেই কবিতার সঙ্গে বন্ধুত্ব আমার। আমার বাবা ছিলেন কবি। তিনি মুহূর্তে অসাধারণ কবিতা লিখে ফেলতেন। বাবার পরিবারের সবারই এই গুণটি ছিল। আরেকটি গুণ ছিল, নিমেষে মুখে মুখেই কবিতা বানিয়ে ফেলতেন আর সেগুলো আবৃত্তি করতেন। ব্যাপারটি বেশ স্বতঃস্ফূর্ত আর প্রাণবন্ত ছিল। আমি অবাক বিস্ময়ে তাঁদের সৃজনশীলতা উপভোগ করতাম। বাবার কণ্ঠে আবৃত্তি শুনে শুনেই আমি বড় হয়েছি। তাঁর দরাজ কণ্ঠে, ‘কালের যাত্রাধ্বনি শুনিতে কি পাও’—বহুবার শুনেছি! প্রায়ই মনে হয়, বাবা কবিতাটা আবৃত্তি করছেন আর আমি শুনছি। আমার প্রিয় কবিতা ‘দুই বিঘা জমি’। সেই ছোট্ট বয়সেই জমিদারের নিষ্ঠুরতা আমার নিষ্পাপ হূদয়কে ক্ষতবিক্ষত করেছিল।

বলাকা সিনেমা হলে গিয়ে ‘ঘেটুপুত্র কমলা’ দেখেছি
কিশোর বয়সেই আমি অনেকবার সত্যজিৎ রায়ের অপুর সংসার দেখেছি। আগে প্রায়ই হলে গিয়ে সিনেমা দেখতাম। এখন আর হলে গিয়ে দেখা হয় না। তবে বেশ কিছুদিন আগে বলাকা সিনেমা হলে গিয়ে ঘেটুপুত্র কমলা দেখেছি। বেশ ভালো লেগেছে ছবির কাহিনি। প্রতিটি দৃশ্য যেন শিল্পীর তুলিতে আঁকা প্রাণবন্ত ছবি। পরিচালকের প্রতিভা আমাকে সত্যি মুগ্ধ করেছে।

তুমি কেমন করে গান করো হে গুণী
গানের আমি একনিষ্ঠ শ্রোতা, এটা বলাই যায়। কারণ, সব ধরনের গান আমাকে মুগ্ধ করে। এ ক্ষেত্রে ভাষাটাও কোনো বিষয় হয়ে দাঁড়ায় না। সুর আমাকে সে কোন অজানায় নিয়ে যায়। আমি সুরেই বুঁদ হয়ে থাকি। মা আবদুল লতিফের কাছে গান শিখেছিলেন। মা গাইতেন, ‘তুমি কেমন করে গান করো হে গুণী, আমি অবাক হয়ে শুনি।’ এখনো গানটি আমার হূদয়ে গুঞ্জরিত হয়। মন বিহ্বল হয়!

আমি ঘরে বসেই আড্ডা দিই
আড্ডা দিতে আমি ভীষণ ভালোবাসি। তবে এই নাগরিক জীবনের ব্যস্ততায় আড্ডার ধরনও পাল্টেছে। এখন আমি ঘরে বসেই আড্ডা দিই। আর আমার আড্ডার সঙ্গী ছয় নাতি-নাতনি। তাদের হরেক রকম গল্প আর তাদের প্রাণোচ্ছল সঙ্গ আমাকে পূর্ণতায় ভরিয়ে তোলে।

আলাস্কার তুষারমণ্ডিত সেই স্বর্গীয় দৃশ্য দেখতে চাই
ভ্রমণ আমার বরাবরই প্রিয় ছিল। এখনো দেশ বিদেশের বিভিন্ন স্থান দেখতে ভীষণ ভালো লাগে। আমার স্বামী আর আমার এই বয়সে এসে এমন একটা বোধ জন্মেছে, মনে হয় পৃথিবীর সব, সবকিছু দেখা উচিত। তাই যখন খুশি বেরিয়ে পড়ি। আমরা পৃথিবীর প্রায় সব কটি মহাদেশ ভ্রমণ করেছি। পাড়ি দিয়েছি বিশাল বিশাল মহাসাগরও। ভ্রমণে বেড়ানোর কিছু স্মৃতি প্রায় শিহরিত করে আমায়। এই যেমন আমাজান রেইন ফরেস্টে হেঁটে বেড়ানোর অভিজ্ঞতা। অথবা মিসরের পিরামিড আকাশছোঁয়া উচ্চতা যেবার আমায় মুগ্ধ করল! সেবার নৌকায় চড়ে নীলনদে বেড়িয়েছি। অথবা মনে পড়ে চীনের সেই বিশাল প্রাচীর। কী অপূর্ব আর অবিশ্বাস্য সৃষ্টি!
জীবনে যদি দ্বিতীয়বার যাওয়ার সুযোগ পাই, তবে আলাস্কার তুষারমণ্ডিত সেই স্বর্গীয় দৃশ্য দেখতে চাই।
ঘটনাটা ২০১১ সালের। আমরা ছোট্ট একটা প্লেনে পাইলটসহ মোট ছয়জন আলাস্কায় পৌঁছাই। উড়োজাহাজ থেকে নেমে দেখলাম, সেখানে দিগন্তছোঁয়া বরফ ছাড়া আর কিছুই নেই। সূর্যের প্রখর আলো পড়ে চারদিক আলোঝলমলে পরিবেশ। এত ঔজ্জ্বল্যতায় চোখ ধাঁধিয়ে গিয়েছিল। পুরো এলাকাটা ছিল ভীষণ নিস্তব্ধ। মনে হচ্ছিল, শুভ্রতা যেন নীরবে কারও আরাধনা করছে। এমন স্বর্গীয় সৌন্দর্যের কাছে নিজেকে অতি ক্ষুদ্র মনে হতে লাগল। সেই শুভ্র সৌন্দর্যে ঘেরা আলাস্কা আমার চোখে ছবি হয়ে আছে। সুযোগ
পেলে সেই শান্ত পেলব সৌন্দর্য আবার দেখতে চাই।
অনুলিখন: সুচিত্রা সরকার

No comments

Powered by Blogger.