ভয়ংকর বিপদের পূর্বাভাস-উপকূলীয় জনজীবন রক্ষায় উদ্যোগ প্রয়োজন

সবচেয়ে বড় বিপদ সম্পর্কে আমরা সবচেয়ে বেশি উদাসীন। বাংলাদেশের দিকে ধেয়ে আসা দুর্যোগ নিয়ে সারা দুনিয়া আতঙ্কিত, অথচ বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকরা তো নয়ই, বাংলাদেশের মানুষও তা নিয়ে খুব কমই চিন্তিত।
বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক এক গবেষণা প্রতিবেদনে সেই বিপদ সম্পর্কে কিছু পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, কয়েক দশকের মধ্যে বাংলাদেশের খাদ্য উৎপাদন কমে যাবে আশঙ্কাজনক হারে, জনজীবন চূড়ান্তরূপে বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে এবং অবকাঠামোর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হবে। এর কারণ মূলত জলবায়ু পরিবর্তনের অস্বাভাবিক দ্রুতগতি। এই প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে, বাংলাদেশ হবে এই পরিবর্তনের কারণে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশ। এর ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি যেমন দ্রুততর হবে, তেমনি বাংলাদেশে বন্যার প্রকোপ বাড়বে; বাড়বে মরুকরণ প্রক্রিয়ার গতি এবং সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস ও ঘূর্ণিঝড়ের তীব্রতাও অনেক বৃদ্ধি পাবে। মোট কথা, জলবায়ু পরিবর্তনের যতগুলো কুফল আছে, তার সবই বাংলাদেশে প্রবল আকারে দেখা দেবে। সংগত কারণেই বাংলাদেশ ও নেপালে বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর জোহানেস জাট বলেছেন, দারিদ্র্য বিমোচনে বাংলাদেশ যে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করছিল, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে তা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবে। কিন্তু সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য আমরা কী করছি? সাইক্লোন সিডরে প্রায় ৩৫ লাখ ঘরবাড়ি প্লাবিত ও বিধ্বস্ত হয়েছিল। ২০৫০ সাল নাগাদ এমন একটি সাইক্লোনে ১০ ফুট পানির নিচে চলে যাবে প্রায় ৯৫ লাখ ঘরবাড়ি। তখন জীবন ও ফসলের কতটা ক্ষয়ক্ষতি হবে, তা অনুমান করতেও কষ্ট হয়।
বিশ্বব্যাংকের পক্ষে এ গবেষণা সম্পাদন করেছে পোস্টড্যাম ইনস্টিটিউট ফর ক্লাইমেট ইমপ্যাক্ট রিসার্চ এবং ক্লাইমেট অ্যানালিটিকস অ্যান্ড পিয়ার। গবেষণাপত্রটি মূল্যায়ন করেছেন বিশ্বের প্রথিতযশা ৯০ জন বিজ্ঞানী। গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০৯০ সাল নাগাদ বৈশ্বিক তাপমাত্রা বেড়ে যাবে ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বাড়লেই আমাদের দক্ষিণাঞ্চলের ৪০ শতাংশ কৃষিজমি অনাবাদি হয়ে পড়বে। অধিকাংশ মানুষ উদ্বাস্তু হবে। এখনই উপকূলীয় অঞ্চলের প্রায় দুই কোটি মানুষ অতিরিক্ত লবণাক্ততার প্রভাবে এবং সুপেয় পানির অভাবে কষ্টকর জীবনযাপন করছে। আগামী দশকে এই প্রক্রিয়া আরো ত্বরান্বিত হবে। কিন্তু কী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে সম্ভাব্য বিপর্যয় মোকাবিলায়? কিছু বিলাসী চিন্তাভাবনা, বিদেশ সফর, বৈশ্বিক ফোরামে হাত পাতা, প্রকল্পের নামে অন্যায্য সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ- এসবই তো চলছে। কিন্তু আমরা অন্ধ হলেই কি প্রলয় বন্ধ থাকবে? নিশ্চয়ই না। নদী সংস্কার, পাকাপোক্ত করে উপকূলীয় বাঁধ নির্মাণ, পাকা ঘরবাড়ি নির্মাণে সহায়তাদান, প্রচুর আশ্রয়কেন্দ্র স্থাপন, বিকল্প কৃষিপদ্ধতির প্রবর্তনসহ প্রয়োজনীয় উন্নয়নকাজগুলোকে মূল বাজেটে নিয়ে দ্রুততার সঙ্গে সম্পন্ন করতে হবে। তা না হলে স্বপ্নের পদ্মা সেতু দক্ষিণাঞ্চলের মানুষকে কেবল উদ্বাস্তু হতেই সহায়তা করবে।

No comments

Powered by Blogger.