ধর্ম ফলবান বৃক্ষরোপণ ‘সাদকায়ে জারিয়া’ by মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান

পৃথিবীতে সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য মানুষ প্রাকৃতিক উপায়ে খাদ্যশস্য ও মৌসুমি ফলমূল উৎপাদনের যেসব কার্যক্রম গ্রহণ করে থাকে, বৃক্ষরোপণ তন্মধ্যে অত্যাবশ্যকীয় কাজ।
আল্লাহ তাআলা মানুষ সৃষ্টি করে ভূপৃষ্ঠের প্রয়োজনীয় জীবনোপকরণ হিসেবে ফলবান বৃক্ষরাজি ও সবুজ-শ্যামল বনভূমির দ্বারা একে সুশোভিত ও অপরূপ সৌন্দর্যমণ্ডিত করেছেন। গাছপালার দ্বারা ভূমণ্ডল ও পরিবেশ-প্রকৃতির ভারসাম্যও সংরক্ষণ করা হয়েছে। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন, ‘আমি ভূমিকে বিস্তৃত করেছি ও তাতে পর্বতমালা স্থাপন করেছি এবং তাতে নয়নাভিরাম সর্বপ্রকার উদ্ভিদ উদ্গত করেছি। আর আমি আকাশ থেকে কল্যাণময় বৃষ্টিবর্ষণ করি এবং এর দ্বারা উদ্যান ও পরিপক্ব শস্যরাজি উদ্গত করি।’ (সূরা কাফ, আয়াত: ৭ ও ৯)
ইসলামে হালাল জীবিকা অর্জন ও জনকল্যাণমূলক বিষয় হিসেবে কৃষিকাজ তথা ফলবান বৃক্ষরোপণ ও শস্যবীজ বপনের প্রত্যক্ষ ইঙ্গিত রয়েছে। মানুষের মৌলিক চাহিদার যে প্রাথমিক প্রয়োজন এর একটি বিরাট অংশ প্রাকৃতিক উপায়ে বৃক্ষজাত সামগ্রী যেমন—ফলমূল, কাঠ প্রভৃতি থেকে আসছে। সাধারণত মানুষ ফলমূল, কাঠ ও ওষুধের উপকরণ পেতে বৃক্ষ রোপণ করে। আবহমানকাল ধরে ফলবান বৃক্ষরাজি মানুষের জীবন-জীবিকার উপাদান জুগিয়ে আসছে। আল্লাহ তাআলা মানুষের জীবিকার স্বার্থে তাদের আহার-বিহার, সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য বিধানের প্রতি দৃষ্টি রেখে এবং আরণ্যক প্রকৃতির মধ্যে সৃষ্টিকর্তার শ্রেষ্ঠত্ব উপলব্ধি করার জন্য অসংখ্য বৃক্ষ সৃজন করেছেন। এ সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে, ‘মানুষ তার খাদ্যের প্রতি লক্ষ করুক! আমিই প্রচুর বারি বর্ষণ করি, অতঃপর আমি ভূমিকে প্রকৃষ্টরূপে বিদারিত করি এবং তাতে উৎপন্ন করি শস্য, দ্রাক্ষা, শাকসবজি, জলপাই, খেজুর, বহু বৃক্ষবিশিষ্ট উদ্যান, ফল এবং গবাদিপশুর খাদ্য, তা তোমাদের ও তোমাদের গবাদিপশুর ভোগের জন্য।’ (সূরা আবাসা, আয়াত: ২৪-৩২)
আল্লাহ তাআলা মানুষকে যতগুলো নিয়ামত দান করেছেন, তন্মধ্যে শ্রেষ্ঠতম হচ্ছে বৃক্ষরাজি। সৃষ্টিকুলের জীবন-জীবিকা ও বৃহত্তর কল্যাণের জন্য গাছপালা, বৃক্ষলতা এবং মৌসুমি ফল-ফসলের প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য। যাবতীয় বৃক্ষরাজি মানুষ ও পশুপাখির জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে। আর সৃষ্টিজীবের খাদ্যের যে বিশেষ প্রয়োজন, তার প্রধান উপকরণ হচ্ছে ফলবান বৃক্ষের বিভিন্ন ফলমূল ও লতাপাতা। মহান আল্লাহর সৃষ্টি বৃক্ষরাজি যে কত বড় নিয়ামত, পবিত্র কোরআনের একাধিক আয়াত থেকে তার প্রমাণ পাওয়া যায়। আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেছেন, ‘তারা কি লক্ষ করে না, আমি ঊষর ভূমির ওপর পানি প্রবাহিত করে তার সাহায্যে উদ্গত করি শস্য, যা থেকে তাদের গবাদিপশু এবং তারা নিজেরা আহার গ্রহণ করে?’ (সূরা আস-সাজদা, আয়াত: ২৭)
মানুষের জীবনধারণের প্রয়োজনীয় উপকরণ পুষ্টিকর ফল-ফসল, খাদ্যদ্রব্যের উপকারিতা ও স্বাস্থ্যসচেতনতার বিষয়ে ইসলামে দিকনির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। পবিত্র কোরআনে প্রাকৃতিক উপায়ে সৃষ্ট বহু ফল-ফসল ও খাদ্যশস্যের কথা বলা হয়েছে। ইসলামের আবির্ভাবস্থল আরব দেশে খেজুর, আঙুর, জায়তুন, আনার প্রভৃতি ফল বেশি উৎপন্ন হতো বলে আল্লাহ তাআলা এসব বিশেষভাবে বর্ণনা করেছেন, ‘তিনিই লতা ও বৃক্ষ উদ্যানসমূহ সৃষ্টি করেছেন এবং খেজুরগাছ, বিভিন্ন স্বাদবিশিষ্ট খাদ্যশস্য, জলপাই ও দাড়িম্ব-বাগিচা সৃষ্টি করেছেন। এরা একে অন্যের সদৃশ ও বিসদৃশও। যখন তা ফলবান হয় তখন তার ফল আহার করবে আর ফসল তোলার দিনে তার দেয় প্রদান করবে এবং অপচয় করবে না।’ (সূরা আল-আনআম, আয়াত: ১৪১) মানবদেহের জন্য খাদ্য হিসেবে ফলমূল বিশেষ উপকারী, তাই আল্লাহপাক এটিকে বিশেষ নিয়ামত হিসেবে উল্লেখ করেছেন, ‘তিনি তোমাদের জন্য বৃষ্টি দ্বারা উৎপাদন করেন ফসল, জায়তুন, খেজুর, আঙুর এবং সর্বপ্রকার ফল, নিশ্চয়ই এতে চিন্তাশীল ব্যক্তিদের জন্য রয়েছে নিদর্শন।’ (সূরা আন-নাহল, আয়াত: ১১)
ইসলামে ফলদ বৃক্ষরোপণ ও ফসল ফলানোকে সবিশেষ সওয়াবের কাজ হিসেবে ‘সাদকায়ে জারিয়া’ বা অবিরত দানরূপে আখ্যায়িত করা হয়েছে। কোনো ব্যক্তি যদি একটি বৃক্ষরোপণ ও পরিচর্যা করেন, তাহলে ওই গাছটি যত দিন বেঁচে থাকবে এবং মানুষ ও অন্যান্য জীবজন্তু যত দিন তার ফল বা উপকার ভোগ করতে থাকবে, তত দিন ওই ব্যক্তির আমলনামায় পুণ্যের সওয়াব লেখা হতে থাকবে। সাদকায়ে জারিয়ার জন্য ফলবান বৃক্ষই বেশি উপকারী। রাসুলুল্লাহ (সা.) ঘোষণা করেছেন, ‘যখন কোনো মুসলমান একটি ফলবান বৃক্ষের চারা রোপণ করে, আর এতে ফল আসার পর সে নিজে অথবা অন্য কোনো মানুষ তা থেকে যা ভক্ষণ করে তা তার জন্য সাদকা (দানস্বরূপ), যা চুরি হয়, যা কিছু (খোসা, আঁটি ইত্যাদি) গৃহপালিত পশু খাবে এবং বিভিন্ন পাখপাখালি যা খাবে, সবগুলো তার জন্য সাদকা।’ (বুখারি ও মুসলিম)
কোনো মুসলমান কর্তৃক রোপিত বৃক্ষ থেকে কোনো মানুষ কারও অজান্তে ফল বা খাদ্যশস্য আহার করে জীবনধারণ করলে অথবা তার বপনকৃত শস্যবীজ থেকে উৎপাদিত খাদ্য কোনো পশুপাখি বা জীবজন্তু ভক্ষণ করে ক্ষুধা নিবারণ করলে তার কোনো ক্ষতি হবে না বরং তা দান-সাদকা হিসেবে গণ্য হবে।
ইসলামি মূল্যবোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে আমাদের ফলবান বৃক্ষরোপণ ও পরিচর্যায় মনোযোগী হতে হবে। অবশ্য আমরা প্রত্যেকে যদি জাতীয় বৃক্ষমেলা থেকে সংগৃহীত ১০টি করে ফলদ, ১০টি করে বনজ ও ১০টি করে ঔষধি গাছের চারা রোপণ করি, তাহলে নিজেদের দারিদ্র্য বিমোচন, অর্থনৈতিক নিরাপত্তা বা সমৃদ্ধি অর্জন, প্রাকৃতিক উপায়ে খাদ্য ও পুষ্টির চাহিদা এবং চিকিৎসার জন্য ওষুধ তৈরিতে তা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। তাই প্রকৃতি ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় এবং মানুষের সুস্থভাবে বেঁচে থাকার প্রয়োজনেই ভূপৃষ্ঠকে ফুল ও ফলের গাছে গাছে ভরিয়ে দেওয়া উচিত।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, গবেষক ও কলাম লেখক।
dr.munimkhan@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.