চট্টগ্রামে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে ড. ইউনূস-মানুষ জাগলে গ্রামীণ ব্যাংক ভাঙতে পারবে না সরকার

'সরকার কিভাবে গ্রামীণ ব্যাংকের মালিকানা নিতে চাইছে, তা আমার বোধগম্য নয়'- এ অনুভূতি ব্যক্ত করে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, 'গ্রামীণ ব্যাংকের ৯৭ শতাংশ শেয়ারের মালিক এ প্রতিষ্ঠানের সদস্যরা।
বাকি ৩ শতাংশের মালিক সরকার। এখন সরকার যে প্রক্রিয়ায় মালিকানা নিতে চাইছে, তা ছিনতাই ছাড়া আর কিছুই নয়। কোনো আইনে এর মালিকানা সরকার নিতে পারে না। এর পরও সরকার উঠেপড়ে লেগেছে।'
ড. ইউনূস বলেন, 'সরকার বলছে গ্রামীণ ব্যাংক ভেঙে দেবে। কিন্তু দেশের মানুষ জেগে উঠলে, মানুষ প্রতিরোধ করলে সরকার চাইলেও তা ভাঙতে পারবে না।'
তিনি আরো বলেন, 'সরকার পল্লী বিদ্যুৎ ও শিল্প ব্যাংকের মতো আইন করে গ্রামীণ ব্যাংকের মালিকানা জোরজবরদস্তি করে নিতে চাইছে। দেশের মানুষ এ অন্যায় কখনো মেনে নেবে না।'
গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে চট্টগ্রামের ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে তাঁকে দেওয়া এক সংবর্ধনায় চট্টগ্রামের কৃতী সন্তান ড. ইউনূস এসব কথা বলেন। 'ড. ইউনূস সুহৃদ' নামের একটি সংগঠন এ সংবর্ধনার আয়োজন করে। ইস্ট ডেল্টা ইউনিভার্সিটির উপাচার্য অধ্যাপক সিকান্দার খানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আলমগীর মোহাম্মদ সিরাজউদ্দিন, অর্থনীতিবিদ ড. মঈনুল ইসলাম, ডা. ফজলুল করিম, অধ্যক্ষ রওশন আরা হানিফ, অধ্যাপিকা তাহমিনা বেগম, ফারুকী-ই আজম বীরপ্রতীক, দৈনিক আজাদীর সম্পাদক এম এ মালেক, চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্সের সাবেক সভাপতি আমীর হুমায়ুন চৌধুরী প্রমুখ।
ড. ইউনূস বলেন, 'সরকার গ্রামীণ ব্যাংকের মালিকানা নিতে চাইলে এর সদস্যদের শেয়ার কিনে নিতে হবে। না হয় মালিকানা ছিনতাই করতে হবে।' তিনি বলেন, 'যে আইনের কারণে গ্রামীণ ব্যাংক নোবেল পুরস্কার পেয়েছে, সে আইন সংশোধন করতে চায় সরকার। বিশ্ববাসীর কাছে গ্রামীণ শব্দটি এখন সম্মানের বিষয় হিসেবে বিবেচিত হয়। বিশ্ববাসী যেমন তাজমহল দেখতে ভারতে যায়, তেমনি গ্রামীণ ব্যাংকের মডেল দেখতে বাংলাদেশে আসে।'
দারিদ্র্য বিমোচন প্রসঙ্গে ড. ইউনূস বলেন, 'গ্রামীণ ব্যাংকের ঋণ নিয়ে অনেক বেকার কর্মসংস্থান তৈরি করে স্বাবলম্বী হয়েছেন। আর যারা ঋণের টাকা ভোগ করেছে তাদের দারিদ্র্য কখনো দূর করা সম্ভব নয়। গ্রামীণ ব্যাংকের দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সমাদৃত। স্পেনের মতো উন্নত দেশে ৫০ শতাংশ তরুণ বেকার। তারাও বাংলাদেশের গ্রামীণ ব্যাংকের মডেল অনুসরণ করে দারিদ্র্য বিমোচন করার উদ্যোগ নিয়েছে। একেক দেশের একেক সমস্যা রয়েছে। সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে সমাধান করার উদ্যোগ নিলে দারিদ্র্য বিমোচন সহজ হয়ে যায়। আমরা তা না করে সব কিছু তালগোল পাকিয়ে ফেলছি।'
মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল প্রসঙ্গে ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, প্রথম দিকে এ তথ্যের কারণে আমাকে পাগল বলা হয়েছিল। বিদেশি সংস্থার দোসর বলা হয়েছিল। এ মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোলের আটটি উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার সাতটি আমরা অর্জন করতে পেরেছি। শুধু মাতৃ মৃত্যুহার হ্রাসে আমাদের এখনো উন্নতি হয়নি।'
সোশ্যাল বিজনেস বা সামাজিক ব্যবসা প্রসঙ্গে ড. ইউনূস বলেন, 'আমরা সবাই যে যার অবস্থান থেকে সামাজিক ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে পারি। তবে এ ক্ষেত্রে লক্ষ্য হওয়া উচিত সমাজের বিরাজমান সমস্যা দূর করা।'
বিভিন্ন দেশের উদাহরণ তুলে ধরে ড. ইউনূস বলেন, 'হাইতি, ব্রাজিল, গ্রিস, জার্মানিসহ বিভিন্ন দেশ আমার পরামর্শ নিয়ে এখন সোশ্যাল বিজনেসের মাধ্যমে কর্মসংস্থান তৈরি এবং দারিদ্র্য বিমোচন করছে।'
অনুষ্ঠানে অর্থনীতিবিদ ড. মঈনুল ইসলাম বলেন, 'সরকার চাইলেই কলমের খোঁচায় গ্রামীণ ব্যাংককে ভাঙতে পারবে না।' এ ব্যাংককে ভাঙার চেষ্টার পেছনে বামপন্থীদের হাত রয়েছে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
অনুষ্ঠানে সভাপতির বক্তব্যে অধ্যাপক সিকান্দার খান বলেন, সরকার গ্রামীণ ব্যাংকের মালিকানা ছিনতাইয়ের যে চক্রান্ত করছে, তা প্রতিহত করা হবে। 'ড. ইউনূস সুহৃদ' আগামী তিন মাসব্যাপী যে কর্মসূচি দেবে, তাতে উপস্থিত সবাইকে অংশ নেওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
এর আগে অর্থাৎ গতকাল সকালে একই মিলনায়তনে 'ড. ইউনূস সুহৃদ'-এর উদ্যোগে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন ড. ইউনূস। সভায় তিনি বলেন, 'এখন যাঁরা দেশের নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তাঁরা ২০ বছর পর থাকবেন না। তখন আমরা তরুণরা দায়িত্ব নেব- এমন চিন্তা করলে তরুণসমাজ এগিয়ে যেতে পারবে না। এগুলো পুরনো ধ্যানধারণা। নেতৃত্ব এখন থেকে দিতে হবে। এমন এক নেতৃত্ব সৃষ্টি করতে হবে যারা দুর্নীতিমুক্ত।' ড. ইউনূস সুহৃদ চট্টগ্রামের সংগঠক ও দৈনিক আজাদী সম্পাদক এম এ মালেকের সভাপতিত্বে মতবিনিময় সভায় কবি আবুল মোমেন, অধ্যাপক সিকান্দার খান প্রমুখ বক্তব্য দেন।

No comments

Powered by Blogger.