দেশের কবি, মানবতার কবি by শেখ মাসুদ কামাল

নির্মলেন্দু গুণ বর্তমান বাংলা সাহিত্যের একজন জনপ্রিয় লেখক। কবি হিসেবে তার জনপ্রিয়তা শিখরস্পর্শী হলেও তিনি কেবল কবি নন_ একাধারে গল্পকার, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক, চিত্রকর ও সংগঠক।
আবার তিনি কখনও কখনও হতিহাসের আদলে কালজয়ী রচনা নির্মাণ করেন, যেখানে মুক্তিযুদ্ধ এক প্রবল পরিপ্রেক্ষিত হিসেবে কাজ করে। ২১ জুন কবির ৬৯তম জন্মদিন। নেত্রকোনা জেলার বারহাট্টা থানার অন্তর্গত কাশবনে তার জন্ম। গ্রামের নামটি আদিতে কাশবন ছিল না। এর নাম ছিল কাশতলা। কবি ভালোবেসে এর নাম দিয়েছেন কাশবন।
কাশবন একটি গ্রাম হলেও কবির ভালোবাসার ছোঁয়ায় এটি অন্যান্য গ্রাম থেকে একটু ভিন্নতর হয়ে উঠেছে। এ গ্রামে কবি সম্পূর্ণরূপে নিজ অর্থ ব্যয়ে একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় স্থাপন করেছেন। স্থাপন করেছেন একটি মনোরম চিত্রশালা। নিজস্ব অর্থায়নে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম ও বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি স্থাপন করেছেন। সেখানে তিনি স্বল্প পরিসরে দৃষ্টিনন্দন একটি পাঠাগার স্থাপন করেছেন। এ পাঠাগারে স্থাপিত কম্পিউটারে অন্তর্জাল (ইন্টারনেট) সংযোগ সম্পন্ন করেছেন। অবশ্য ইন্টারনেটের বাংলা প্রতিশব্দ হিসেবে অন্তর্জাল শব্দটি নির্মলেন্দু গুণের নিজস্ব আবিষ্কার। তবে মোবাইল ফোনের বাংলা প্রতিশব্দ হিসেবে তার 'মুঠোফোন' শব্দটি বাংলা ভাষায় যেভাবে গৃহীত ও সমাদৃত হয়েছে, অন্তর্জাল শব্দটি তেমন হয়নি। আশা করি, কালান্তরে এটি গৃহীত হবে।
সব মিলিয়ে তার প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা শতাধিক। তার প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে প্রেমাংশুর রক্ত চাই, না প্রেমিক না বিপ্লবী, অমীমাংসিত রমণী, দীর্ঘ দিবস দীর্ঘ রজনী, চৈত্রের ভালবাসা, ও বন্ধু আমার, আনন্দ কুসুম, বাংলার মাটি বাংলার জল, তার আগে চাই সমাজতন্ত্র, দূর হ দুঃশাসন, মুজিব-লেনিন-ইন্দিরা, শিয়রে বাংলাদেশ, ইয়াহিয়া কাল, মুঠোফোনের কাব্য উল্লেখযোগ্য। তার কলাম গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে নির্গুণের জার্নাল। ভ্রমণ বিষয়ক কাহিনীর মধ্যে আছে ভলগার তীরে, ভিয়েতনাম ও কাম্পুুচিয়ার স্মৃতি, গিনসবার্গের সঙ্গে, আমেরিকায় জুয়াখেলার স্মৃতি, ভ্রমি দেশে দেশে ইত্যাদি। তার প্রকাশিত আত্মজীবনী গ্রন্থের মধ্যে আছে আমার ছেলেবেলা, আমার কণ্ঠস্বর ইত্যাদি। তার প্রকাশিত শিশু-কিশোর সাহিত্য নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে কিশোর সমগ্র। তিনি বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরস্কারসহ অসংখ্য পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। কবিতায় তার কণ্ঠ নির্ভীক ও কাব্য ভাষা নির্মাণে সাধারণের বোধগম্যতার কাছাকাছি থাকার একটি প্রয়াস বেশ প্রবলভাবে তার কবিতায় লক্ষণীয়। '৭৫-এর পট পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে অনেক মুজিবভক্ত যখন পরাস্ত সহিসের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন, তখনও তার প্রতি কবির অনুরাগ ও ভালোবাসার প্রকাশে কবি ছিলেন উচ্চকণ্ঠ ও অকুতোভয়। ১৯৭৫ সালের আগস্টে দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পরিবর্তনের পর তিনিই প্রথম বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কবিতা লেখেন ও তা বাংলা একাডেমীর মুক্তমঞ্চে আবৃত্তি করেন। আমাদের এ বঙ্গদেশে যেখানে 'বুদ্ধিজীবীর রক্তে স্নায়ুতে সচেতন অপরাধ', সেখানে কবির এই বিশ্বাসের দৃঢ়তা ও বহিঃপ্রকাশ সত্যিই অভিনন্দন ও অনুকরণযোগ্য। অবশ্য তরুণ বয়সে কবি আরও অনেকের মতোই সমাজতান্ত্রিক আদর্শে দীক্ষিত হয়ে লিখেছিলেন 'তার আগে চাই সমাজতন্ত্র'। কিন্তু বর্তমান এককেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থায় সমাজতান্ত্রিক সে বিপল্গবের সম্ভাবনা যখন অনেকটা স্বপ্নবিলাসের মতো, সেখানে কবি এখনও আপাদমস্তক একজন মানবতা ও সাম্যের কবি। বৈষয়িকতাবিমুখ এ মানুষটি সবসময়ই প্রচণ্ড আমোদপ্রিয় এবং ঈর্ষণীয় প্রাণশক্তির অধিকারী। জীবনের সব অপ্রাপ্তি আর বঞ্চনার পরেও জীবনের মূলমন্ত্র 'দুঃখ করো না, বাঁচো' তারই একটি কাব্যগ্রন্থের নাম।
জন্মদিনে কবিকে শ্রদ্ধাঞ্জলি জানাই। প্রার্থনা করি, তিনি যেন কর্মক্ষম শতায়ু লাভ করেন। যেন সৃষ্টিশীলতায় তিনি অক্লান্ত থাকেন আজীবন। মানুষের প্রতি ভালোবাসা আর মমতায় তার জীবন হোক এক পুণ্য আনন্দধাম।

No comments

Powered by Blogger.