প্রকৃতি বন্দনা by মোবাশ্বির আলম মজুমদার

প্রকৃতির রূপ পরিবর্তনের চিহ্ন শিল্পীর ক্যানভাসে স্থান করে নেয় তখনই, যখন একজন শিল্পী পরিপূর্ণ মনোযোগ দেন প্রকৃতি পাঠে। আচার্য জয়নুলের প্রকৃতি পাঠের অধ্যবসায় অনুজ শিল্পীদের মধ্যে আমরা বাংলাদেশের ধারাবাহিক চিত্র নির্মাণে খুঁজে পাই।
ওয়ারিয়র রহমান ছবি আঁকা শুরু করেছেন প্রকৃতির কাছে। নদীবিধৌত বাংলার জল-হাওয়া তাঁকে তাড়িয়ে বেড়ায়। বাংলার ষড়্ঋতুর রংবদল শিল্পীর ক্যানভাসে হাজির হয়। বাস্তবধর্মী চিত্র রচনার শিক্ষায়তনিক পর্যায় পেরিয়ে ওয়ারিয়র রহমান প্রকৃতিকে বিষয় করেই নিরীক্ষায় মনোযোগী হয়েছেন। মাধ্যমের ক্ষেত্রে তিনি বেছে নিয়েছেন জলরং। নির্দিষ্ট কিছু রঙের প্রতি ঝোঁক সত্ত্বেও তাঁর ছবি কখনো একঘেয়ে মনে হয়নি। এই উপমহাদেশে চীনা ও জাপানি চিত্রকলায় জলরং মাধ্যমের অঙ্কন চর্চা শুরু হয়। পরবর্তীকালে ভারতীয় চিত্রকলায় জলরং মাধ্যমের চর্চা হতে দেখা যায়। রূপমাধুর্য সৃজনের আদর্শকে বাংলাদেশের শিল্পকলায় প্রোথিত করেন জয়নুল, কামরুল, সফিউদ্দিন ও এস এম সুলতান। তরুণ ওয়ারিয়র তাঁদের দেখানো পথ অনুসন্ধান করে চলেছেন। প্রসঙ্গক্রমে শিল্পী প্রকৃতি বন্দনা নিয়ে বলেন, ‘একাডেমি বা প্রাতিষ্ঠানিক শিল্প শিক্ষা-পদ্ধতিতে একটা রীতি চালু আছে, যা দেখো তা-ই আঁকো। এ অভ্যাস আমার প্রথম প্রদর্শনীতে দেখা গেছে।’ সব কটি ছবিই প্রকৃতির কাছাকাছি গিয়ে আঁকা। প্রদর্শনীর ৩৬টি ছবিই জলরঙে আঁকা। চিত্রতলের স্থান ব্যবস্থাপনা তাঁর কাজে স্পষ্ট। চিত্র নির্মাণের ব্যাকরণের শতভাগ প্রয়োগের জন্য একাডেমিক রূপ তাঁর কাজে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। একটি একরোখা ধ্যান ওয়ারিয়র চর্চা করেন। প্রকৃতির সঙ্গে মনঃসংযোগের ব্যাপ্তি স্পষ্ট দেখা যায় ক্যানভাসে। সরল, কোমল, স্নিগ্ধ, মায়া—এ চারটি বিষয়ে শিল্পী গভীর চর্চা করেন। ক্যানভাস উষ্ণতা বা দ্রোহ তৈরি করে না। প্রকৃতির স্নেহের পরশ বুলিয়ে দর্শক মাতিয়ে রাখে। নিসর্গের রং আর বিষয়ের মধ্যে দর্শককে নিয়ে যায়। তেলরঙে আঁকা ‘রিফ্লেকশন অব নেচার’ বা প্রকৃতির ছায়া ছবিটি এ প্রদর্শনীর সবচেয়ে বড় পরিসরের ক্যানভাস। নদীর পরিপ্রেক্ষিতে রচনার সঙ্গে নদীর জলে আকাশের ছায়া আমাদের বাংলার চিরচেনা রূপের কাছে নিয়ে যায়। প্রকৃতি পাঠ করে শিল্পী বেছে নেন ছবির উপযোগী বিষয়।
সবুজাভ নীল আকাশের প্রতি শিল্পী টান অনুভব করেন। স্পেস ম্যানেজমেন্ট বা চিত্রতলে স্থানের শুদ্ধ ব্যবহার একটি শিল্পকর্মের জন্য জরুরি। কোনো কোনো ছবিতে এ ব্যবস্থাপনায় শিল্পী মনোযোগী হলেও কিছু ছবিতে মনোযোগ বিচ্ছিন্ন হয়েছে। এতে কিছু কাজ নিছক ফ্রেমবন্দী ক্যানভাস মনে হয়। শিল্পী যখন একটি শিল্পকর্ম সমাপ্ত করেন সে শিল্পকর্মের তাৎপর্য নির্ধারণে দর্শক ও শিল্পী একাত্ম হন। ওয়ারিয়র রহমান সে ধরনের ছবি এঁকেছেন, যা দর্শকদের সঙ্গে একমত হওয়া যায়। রেখার সাযুজ্য-ধ্বনির যোগ শিল্পকর্মের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ছবিগুলোর মধ্যে রেখার ঐক্য রয়েছে। প্রাচ্যে রেখা-প্রধান কাজের মাধ্যমে ছবির বক্তব্য স্পষ্ট করেন শিল্পীরা। প্রদর্শনীর কাজগুলোতে রঙের সঙ্গে রেখার বন্ধন সুস্পষ্ট। ওয়ারিয়র নিজেকে ‘নেচার আর্টিস্ট’ বা প্রকৃতিবাদী শিল্পী হিসেবে ভাবেন। তাঁর প্রকৃতি অধ্যয়নের দূরদৃষ্টি আমরা ছবিতেই খুঁজে পাই। গ্যালারি পরিসরের নৈকট্য ছবি দেখা খানিক বিঘ্নিত হলেও শিল্পাঙ্গনের এ আয়োজন আশা জাগায়। শিল্পাঙ্গন ঢাকায় ৭ থেকে জুন শুরু হওয়া এ প্রদর্শনী শেষ হয় ১৬ জুন।

No comments

Powered by Blogger.