নবীর ট্রেনে কাটা পড়া নিয়ে রহস্য by তৌহিদুল ইসলাম মিন্টু, এস এম আজাদ ও বিশ্বজিৎ পাল বাবু

কয়েক হাজার কোটি টাকার দায়গ্রস্ত প্লেসমেন্ট শেয়ার ব্যবসায়ী নবী উল্যাহ নবীর ট্রেনে কাটা পড়া নিয়ে রহস্য আরো ঘনীভূত হয়েছে। তিনি রেললাইনে দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন, নাকি তাঁকে হত্যা করা হয়েছে- এ প্রশ্নের উত্তর মিলছে না।
ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে উচ্চ পর্যায়ের সরকারি লোকজনের কয়েক হাজার কোটি টাকা আটকা পড়ে আছে নবীর কাছে। তাঁর লাশ গতকাল ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরে গ্রামের বাড়িতে নেওয়া হয়।
প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, ট্রেনের নিচে পড়ার পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত পাঁচজন ব্যক্তির সঙ্গে নানা সমস্যা নিয়ে কথাবার্তা চলছিল নবীর। এক পর্যায়ে বিকেল ৫টার দিকে অগ্নিবীণা ট্রেনে কাটা পড়ে মারা যান তিনি।
অনেকেই ধরা : ২০০৯ ও ২০১০ সালের শেয়ার ব্যবসা যখন ভয়ংকর রকমের চাঙ্গা তখন নবী উল্যাহ নবী রাজধানীর বনশ্রীতে প্লেসমেন্ট শেয়ার বিকিকিনির জন্য আলাদাভাবে গড়ে তোলেন গ্রিন বাংলা গ্রুপ নামে একটি কার্ব মার্কেট। এতে বছরে অন্তত এক হাজার কোটি টাকার প্লেসমেন্ট শেয়ার কেনাবেচা হতো। বিভিন্ন কম্পানির রাইট শেয়ার নিয়েও আগাম বাণিজ্য চলত সেখানে। এই প্লেসমেন্ট বাণিজ্যের ফাঁদে পড়েন প্রভাবশালী ব্যক্তিরাও। মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, পদস্থ সরকারি কর্মকর্তা, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, ব্রোকারেজ হাউসের শীর্ষ নির্বাহীসহ অনেকের মোটা অঙ্কের টাকা আটকে যায় গ্রিন বাংলা গ্রুপের কাছে। ভুয়া প্লেসমেন্ট শেয়ার বিক্রি করে অন্তত চার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেন নবী। এ নিয়ে ২০১১ সালের ৩১ জুলাই কালের কণ্ঠে একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এরপর নবী নিখোঁজ হন। ১৪ দিন নিখোঁজ থাকার পর মারাত্মক আহতাবস্থায় বাড়ি ফেরেন তিনি। সূত্র জানায়, এরপর থেকে র‌্যাব-১-এর সার্বক্ষণিক নজরদারিতে চলতে হতো তাঁকে। তাঁর বাসা ও অফিসে র‌্যাবের নজরদারি ছিল বলে দাবি করেছেন স্বজনরা। এ সময় তিনি বিনিয়োগকারীদের টাকা ফেরত দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। পাওনাদারদের অনেকে নবীর বিরুদ্ধে লেনদেনসংক্রান্ত বিষয়ে র‌্যাব-১-এর কাছে অভিযোগ করেছেন।
সরেজমিন রেলক্রসিং : মালিবাগ রেলক্রসিংয়ের পূর্ব-উত্তরে রেলওয়ের গেটম্যানদের লাল রঙের ছোট্ট একটি পাকা ঘর। গেটম্যান সালেহ আহমেদ জানান, বুধবার দুপুর ২টার সময় ডিউটি করতে এসে তিনি দেখেন ছয় ব্যক্তি তাঁর ঘরে বসে আছেন।
তাঁরা র‌্যাবের লোক বলে পরিচয় দেওয়ায় আর কোনো কথা বলেননি সালেহ আহমেদ। দুপুর ২টা থেকে বিভিন্ন সময় আশপাশে ঘোরাঘুরি করেন ওই ছয় ব্যক্তি। বিকেল ৫টার দিকে যখন ময়মনসিংহ থেকে ঢাকাগামী অগ্নিবীণা ট্রেন আসে তখন দক্ষিণ-পশ্চিম পাশের লাইন টানতে যান তিনি। ফিরে এসে সালেহ দেখেন ওই ছয়জনের একজন ট্রেনের নিচে পড়ে দুই ভাগ হয়ে গেছেন।
সালেহ আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, "ট্রেন চলে যাওয়ার পর সঙ্গে থাকা পাঁচজন 'আমাদের লোক আমাদের লোক' বলে চিৎকার করতে থাকে। তাঁরা ঘটনাটি আমার অফিসকে (রেলওয়েকে) জানাতে নিষেধ করেন। কিন্তু রেল পুলিশকে জানিয়ে আমি আমার দায়িত্ব পালন করেছি। ১০-১৫ মিনিটি পর এঁদের তিনজন বাকি দুজনকে ধরে নিয়ে গাড়ি করে চলে যান।'
রেলক্রসিংয়ের পূর্ব পাশেই বস্তিঘর বানিয়ে কাঠের ব্যবসা করেন সাগর। কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, অনেক ক্ষণ কথা বলেছিল পাঁচ-ছয়জন। বার বার রেললাইনের এপাশ ও-পাশে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। কখনো বসে, কখনো দাঁড়িয়ে কথা চলছিল। সব সময় টাকা-পয়সা নিয়ে কথাবার্তা চলছিল তাদের। অগ্নিবীণা যাওয়ার পর দেখি এদেরই একজনের কোমরের ওপরের এক অংশ এক জায়গায়। নিচের অংশ আরেক জায়গায় পড়ে রয়েছে। পুলিশ এসে লাশ নেওয়ার আগে তারা চলে যায়।
সেলিম নামের আরেক দোকানি বলেন, 'রেলক্রসিংয়ের পশ্চিম পাশে একটা গাড়ি ছিল। ঘটনার পর বাকিরা সবাই চলে যায়।' সেলিম আরো বলেন, 'শুনছি কে যেন ২৭ কোটি টাকা পাইত হই দেনদরবার চলতি ছিল।'
ঢাকা রেলওয়ে থানার ওসি আবদুল মজিদ কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমরা নবীর লাশটি মালিবাগ রেলক্রসিংয়ের কাছ থেকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের হাসপাতাল মর্গে পাঠিয়েছি। রেললাইনের ওপর লাশ পাওয়ার কারণে আমরা মৃত্যুটি দুর্ঘটনাজনিত বলে ধারণা করছি। পরিবারের পক্ষ থেকেও কোনো অভিযোগ দেওয়া হয়নি। তাই একটি অপমৃত্যু মামলা করা হয়েছে।' পরিবার অভিযোগ দিলে মামলা গ্রহণ করা হবে বলেও জানান তিনি।
এই ঘটনার প্রাথমিক তদন্ত কর্মকর্তা, কমলাপুর রেলওয়ে থানার এ এস আই সিরাজুল ইসলাম জানান, ঘটনাটি আত্মহত্যা নাকি তাঁকে কেউ ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছেন, তা সম্পর্কে তাৎক্ষণিক কিছু জানা যায়নি। নবীর বাবার নাম মৃত হারুনুর রশিদ। তাঁর গ্রামের বাড়ি ব্রাহ্মবাড়িয়ার নবীনগরের ধরাভাঙ্গায়। বর্তমানে বনশ্রী এফ ব্লকের ৪নং রোডের ১৮নং বাড়িতে বসবাস করতেন।
গতকাল সকালে নবীর বনশ্রীর বাড়িতে গেলে দারোয়ান হারুনুর রশীদ কালের কণ্ঠকে বলেন, 'প্রতিদিনই র‌্যাবের লোকজন সকালে এসে নবী সাহেবকে নিয়ে যেতেন। রাতে পৌঁছে দিতেন।' নবীর গ্রিন বাংলা অফিস বনশ্রীর ই ব্লকের ৩ নম্বর রোডের ১ নম্বর বাড়ির দোতলায়। গতকাল সেখানে গিয়ে অফিসের দরজায় তালা ঝুলতে দেখা গেছে। এই ভবনের নিচ তলায় লেডি অ্যান্ড কেডি নামের একটি পোশাকের দোকন। দোকানি জুয়েল জানান, নবী সাহেবকে প্রতিদিন পাহারা দেওয়ার জন্য র‌্যাবের লোকজন বসে থাকত। তারা বলেছে, নবীর কাছে অনেক মানুষ টাকা পাবে। যাতে পালিয়ে যেতে না পারে, আবার কেউ মেরে ফেলতে না পারে সে জন্যই পাহারা দেন তারা। জুয়েল আরো বলেন, গত এক সপ্তাহ ধরে এই অফিসে প্রচুর লোকজন আসত। গত দুদিন তো ভিড় লেগেছিল।
এক সময়ে নবী উল্যাহর সহযোগী প্লেসমেন্ট শেয়ার ব্যবসায়ি নিজাম উদ্দিন মোবাইলে কালের কণ্ঠকে বলেন, 'নবীকে র‌্যাব ২৪ ঘণ্টা পাহারায় রাখত। নবীর কাছে আমার পাওনা ছিল ১৬ লাখ টাকা। সে টাকা পাওয়ার আর কোনো সম্ভাবনা নেই। তিনি জানান গত দেড় বছর ধরে নবী পাবলিকের টাকা ফেরত দেয়নি।'
ডিএসইর ব্রোকার সদস্য সাদ সিকিউরিটিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক দেলোয়ার হোসেন বলেন, 'নবীর কাছে আমার আট কোটি টাকা পাওনা রয়েছে।' বুধবার রাতে নবীর মৃত্যু সংবাদ শুনে আঁতকে ওঠেন শেয়ার ব্যবসায়ী সোলাইমান রুবেল। কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, 'নবীর কাছে আমার ১১০০ কোটি টাকা আটকা ছিল। এখন তো সব শেষ।'
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের হাসপাতাল মর্গে লাশ নিতে এসেছিলেন নবীর ভাই জাহাঙ্গীর আলম। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, 'নবী শেয়ার ব্যবসা করতেন। এর বেশি কিছু জানি না।'
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের হাসপাতাল মর্গে ময়নাতদন্তের দায়িত্বে থাকা ফরেনসিক বিভাগের চিকিৎসক মোহাম্মদ হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, 'নবীর শরীর দুই খণ্ড হয়ে গেছে। মাথায় ও হাত-পায়ে থেতলানো জখম আছে। ময়নাতদন্ত ও মৃত্যুর কারণে সম্পর্কে আগে থেকে কিছু বলা যাবে না।' নবীর মৃত্যু সংবাদ শুনে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে এসেছিলেন বিনিয়োগকারী পারভেজ। তিনি বলেন, 'আমার ১২ লাখ টাকা আটকে গেছে নবীর কাছে। সে ছিল শেয়ার ব্যবসায়ীদের ডন।'
জানা গেছে, নবীর দেনার অভিযোগের ব্যাপারে র‌্যাব-১-এর পরিপ্রেক্ষিতে মেজর মোস্তাক ঘটনার তদন্ত করছিলেন। মেজর মোস্তাকের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তাঁকে মুঠোফোনে পাওয়া যায়নি। নজরদারিতে রাখা এবং মৃত্যুরহস্য নিয়ে র‌্যাব-১-এর বক্তব্য জানতে যোগাযোগ করা হলে অপারেশন অফিসার এএসপি মোরশেদ বলেন, 'তাঁর বিরুদ্ধে আমাদের কাছে অভিযোগ ছিল। এর বেশি আমি কিছু বলতে পারি না। আপনি মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক স্যারের সঙ্গে কথা বলেন।'
রাতে র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক উইং কমান্ডার এ টি এম হাবিবুর রহমান বলেন, 'কারো বিরুদ্ধে মামলা না থাকলে তাকে নজরদারিতে রাখার কথা নয়। খোঁজ নিয়ে দেখছি।'
গ্রামের বাড়িতে : গতকাল রাত সোয়া ৮টায় নবী উল্যাহ নবীর লাশ তাঁর গ্রামের বাড়িতে এসে পৌঁছলে হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। নবী উল্যাহর গ্রামের বাড়িতে একটি টিনশেড ঘর। ভেতরে তেমন কোনো আসবাব নেই। নবীর বাবা মো. হারুনূর রশিদ ছিলেন একজন সার্ভেয়ার। নবীর একটি মেয়ে আছে। চাকরির সুবাদে অনেক আগেই তাঁরা গ্রামের বাড়ি ছেড়ে গাজীপুরের কালিয়াকৈরে চলে যান। কথা বলে জানা যায়, নবীনগর উপজেলার সলিমগঞ্জ ইউনিয়নের লোকজন তাঁকে খুব একটা চেনেন না।
প্রতিবেশী শামসুল হক (৩৫) বলেন, 'গত দুই বছর জানতে পারি আমাদের গ্রামে একজন টাকাওয়ালা লোক আছে। এরপর শুনি কেউ কোনো উন্নয়নের জন্য গেলে খালি হাতে ফেরান না। কিন্তু গ্রামে ওনাকে কখনো আসতে দেখিনি।'
নবী উল্যাহর বিমাতা ভাই মো. জাহাঙ্গীর কালের কণ্ঠকে জানান, তাঁর ভাই আত্মহত্যা করেছেন বলেই মনে হচ্ছে। বুধবার বিকেলে এক বন্ধুর মাধ্যমে মোবাইল ফোনে তিনি খবর পান তাঁর ভাই ট্রেনে কাটা পড়েছে। ওই দিন সকালে নবী উল্যাহ বাড়ি থেকে বের হয়ে আর অফিসে যাননি।
নবী উল্যাহর উদ্ধৃতি দিয়ে তাঁর খালাতো ভাই কিশোরগঞ্জের মিঠামইন গ্রামের মো. আবদুল মালেক বলেন, তাঁর ভাই অন্তত তিন হাজার কোটি টাকার শেয়ারের মালিক ছিলেন। এ ছাড়া ঢাকার রামপুরা, মতিঝিল, মাদারটেকে বেশ কয়েকটি বাড়ি ছিল তাঁর। ফুফাতো ভাই মো. জাহাঙ্গীর মিয়া বলেন, 'নবী উল্যাহ এর আগে অন্তত দুবার জেল খাটে। তাঁর বাড়ির নীচে সব সময় পাহারা থাকত। কালিয়াকৈরের বাড়িটি তাঁর বন্ধুরা নিয়ে গেছে। অন্যান্য কয়েকটি বাড়িও নিয়ে গেছে একটি চক্র। কিছুদিন আগে নারায়ণগঞ্জের বাড়িটি শ্বশুর-শাশুড়ির নামে লিখে দেন নবী। বিষয়টি জানার পর ওই বাড়িটি দিতেও তাঁর ওপর চাপ প্রয়োগ করা হয়।'

No comments

Powered by Blogger.