মুনাফার নামে ডাকাতি! by রাজীব আহমেদ

কয়েকটি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের যে দাম হওয়া উচিত, তার চেয়ে অনেক বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে বাজারে। আমদানি খরচের সঙ্গে পণ্যের কর, বিভিন্ন ধরনের খরচ ও তিন পর্যায়ের মুনাফা যোগ করে বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশনের দ্রব্যমূল্য মনিটরিং সেল যে কাঙ্ক্ষিত দাম ঠিক করেছে,
এর সঙ্গে বাজারদরের ফারাক অনেক। ব্যবসায়ীরা ডাল ও বিভিন্ন মসলাজাতীয় পণ্যে অতিরিক্ত মুনাফা করছেন। সবচেয়ে বেশি মুনাফা করা হচ্ছে খুচরা পর্যায়ে, যেখানে সরকারের নিয়ন্ত্রণ সবচেয়ে দুর্বল।
ট্যারিফ কমিশনের হিসাবে, মসুর ডালের প্রতি কেজির গড় আমদানি মূল্য ৫৭ টাকা ৮১ পয়সা। এর সঙ্গে সব খরচ যোগ করে খুচরা দোকানে বিক্রি হওয়ার কথা গড়ে ৬৬ টাকা ৮৬ পয়সা দরে।
কিন্তু বাজারে যে ধরনের আমদানি করা মসুর ডাল পাওয়া যায়, তার দাম ৮৫ থেকে শুরু করে ১৩০ টাকা পর্যন্ত। গড় দাম কেজিপ্রতি ১০৭ টাকা। ফলে মসুর ডালে বাড়তি মুনাফা করা হচ্ছে কেজিপ্রতি প্রায় ৪০ টাকা।
এভাবে রমজানের পণ্য ছোলা, মসলাজাতীয় পণ্য রসুন, আদা, জিরাসহ বেশ কয়েকটি পণ্যের অতিরিক্ত মুনাফার তথ্য মিলেছে ট্যারিফ কমিশনের হিসাবে। ১ মে থেকে ৪ জুন পর্যন্ত আমদানি হওয়া বিভিন্ন পণ্যের দামের ওপর ভিত্তি করে হিসাবটি তৈরি করা হয়েছে।
পণ্যের দাম এভাবে বেশি নেওয়া হলেও সরকারের নজরদারি খুবই দুর্বল। পণ্যের আমদানি পর্যায়, পাইকারি পর্যায় ও খুচরা পর্যায়ে কোন ব্যবসায়ী কত শতাংশ মুনাফা করছেন, কোন পর্যায়ে কত দাম বাড়ছে, কোনো পর্যায়ে পণ্য মজুদ করে দাম বাড়ানোর চেষ্টা করা হচ্ছে কি না- তা দেখতে কার্যকর মনিটরিং নেই।
ট্যারিফ কমিশনের ওই প্রতিবেদন সম্পর্কে জানতে চাইলে বাণিজ্যসচিব মাহবুব আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, 'প্রতিবেদনটি আমরা পরীক্ষা করে দেখছি। পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করে এ বিষয়ে কোনো কিছু বলা সম্ভব নয়।'
ট্যারিফ কমিশনের হিসাবে দেখা যায়, এবারের রমজান উপলক্ষে মে থেকে জুনের প্রথম চার দিন পর্যন্ত যেসব ছোলা আমদানি করা হয়েছে, তার আমদানি মূল্য ছিল প্রতি টনে ৫৮৭ ডলার থেকে শুরু করে ৬৯৬ ডলার পর্যন্ত। এতে প্রতি কেজি ছোলার গড় দাম পড়েছে ৫২ টাকা ৩৩ পয়সা। এর সঙ্গে প্রতি টনে এক হাজার ৫০০ টাকা পরিবহন খরচ, ১৫ শতাংশ হারে ব্যাংকের ঋণের সুদ, ১ শতাংশ প্রসেস লস, আমদানিকারকের ২ শতাংশ মুনাফা, পাইকারি বিক্রেতার পরিবহন খরচ ও মুনাফা ৬ শতাংশ এবং খুচরা বিক্রেতার পরিবহন খরচ ও মুনাফা বাবদ ১৫ শতাংশ রেখে গড় দাম দাঁড়ায় প্রতি কেজি ৫৮ টাকা ৭৯ পয়সা।
মনিটরিং সেল মনে করে, বাজারে এ দামেই বিক্রি হওয়া উচিত। কিন্তু বাজারে প্রতি কেজি আমদানি করা ছোলা ৬৫ থেকে ৭৫ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। ফলে প্রতি কেজি ছোলায় অতিরিক্ত মুনাফা করা হচ্ছে ১১ টাকা ২১ পয়সা।
সরকারি প্রতিষ্ঠান ট্রেডিং করপোরশেন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) এবারের রমজানে ছোলা কেজিপ্রতি ৬০ টাকা ও মসুর ডাল ৭০ টাকা দরে বিক্রি করবে।
বাংলাদেশ পাইকারি ডাল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি শফি মাহমুদ কালের কণ্ঠকে বলেন, তাঁরা গতকাল বৃহস্পতিবার ভালো মানের ছোলা বিক্রি করেছেন প্রতি কেজি ৫৪ টাকা দরে। এসব ছোলার আমদানি খরচ ৫৬-৫৭ টাকা পড়েছে। কিন্তু সরবরাহ বেশি হয়ে যাওয়ায় আমদানিকারকদের লোকসান হচ্ছে। আড়তে ছোট দানার মসুর ডাল বিক্রি হচ্ছে ৯৫-৯৬ টাকা কেজি দরে; যা খুচরা বাজারে কিনতে কেজিপ্রতি ১২৫-১৩০ টাকা লাগছে।
খুচরা বাজারে দাম এত বেশি কেন জানতে চাইলে শফি মাহমুদ বলেন, খুচরা বিক্রেতারা এক কেজি ছোলায় ১৫-২০ টাকা লাভ করেন। এর কারণ তাঁদের এক বস্তা (৫০ কেজি) ছোলা বিক্রি করতে বেশ কয়েক দিন লেগে যায়। পাইকারি বিক্রেতারা এক বস্তায় ২০-২৫ টাকা লাভ করতে পারলেই খুশি থাকেন। অবশ্য তিনি পাইকারি পর্যায় থেকে খুচরা পর্যায়ে দামের ফারাক খুঁজতে সরকারকে মনিটর করার পরামর্শ দেন।
মসলাজাতীয় পণ্যের মধ্যে সংসারে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হয় পেঁয়াজ। দেশের চাহিদা মেটাতে ভারত থেকে প্রচুর পেঁয়াজ আমদানিও হয়। এই আমদানি করা পেঁয়াজে প্রতি কেজিতে ১০ টাকা ৬৭ পয়সা অতিরিক্ত মুনাফা করেন ব্যবসায়ীরা। প্রতি কেজি পেঁয়াজের গড় আমদানি মূল্য ১৬ টাকা ৫০ পয়সা। মোট কর ভার ৫ শতাংশ, ২ শতাংশ প্রসেস লস, ৩ শতাংশ হারে আমদানিকারকের মুনাফা ছাড়া অন্যান্য খরচের হিসাব ধরা হয়েছে ছোলার মতো হারে। সব খরচ যোগ করে প্রতি কেজিতে গড় দাম দাঁড়িয়েছে ১৮ টাকা ৩৩ পয়সা।
কিন্তু বাজারে আমদানি করা পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ২৮-৩০ টাকা দরে। ফলে প্রতি কেজিতে ১০ টাকার বেশি অতিরিক্ত মুনাফা করছেন ব্যবসায়ীরা।
পেঁয়াজের মতো রসুনের কর ভারও ৫ শতাংশ। পেঁয়াজের মতো একই হারে খরচ হিসাব করে দেখা গেছে, প্রতি কেজি রসুনের দাম হওয়া উচিত গড়ে ৬৮ টাকা ৪০ পয়সা। কিন্তু বাজারে চীন থেকে আমদানি করা রসুন ৯০ থেকে ১০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। ফলে রসুনে অতিরিক্ত মুনাফা হচ্ছে গড়ে ২৬ টাকা ৬০ পয়সা। একইভাবে খরচ হিসাব করে আমদানি করা আদার কাঙ্ক্ষিত বাজারদর হওয়া উচিত গড়ে ৫৪ টাকা ৩৩ পয়সা। কিন্তু বিক্রি হচ্ছে কেজিপ্রতি ৮০-৯০ টাকা দরে। প্রতি কেজিতে অতিরিক্ত মুনাফা ২৬ টাকা ৬৭ পয়সা।
ট্যারিফ কমিশনের প্রতিবেদনে খেজুর, জিরা, এলাচি ও দারুচিনির আমদানি খরচ এবং কাঙ্ক্ষিত বাজারমূল্যের হিসাবও করা হয়েছে। এতে দেখা যায়, প্রতি কেজি খেজুর গড়ে প্রায় ৫৮ টাকা, জিরা ২৬৬ টাকা, এলাচি ৬৫৯ টাকা ও দারুচিনি ১৫১ টাকা দরে বিক্রি হওয়ার কথা। কিন্তু বাজারে খেজুর সর্বনিম্ন ৮০ টাকা, এলাচি এক হাজার ১০০ থেকে এক হাজার ৫০০ টাকা, জিরা ৩৮০ থেকে ৫৬০ টাকা ও দারুচিনি ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।
আমদানিকারক ও পাইকারি বিক্রেতারা বলছেন, অতিরিক্ত মুনাফা করা হচ্ছে খুচরা পর্যায়ে। আড়তে পণ্য কমিশনে বিক্রি করা হয়। আমদানিকারকও প্রতিযোগিতার কারণে খুব বেশি মুনাফা করতে পারেন না। কিন্তু খুচরা বিক্রেতারা একটি নির্দিষ্ট হারে সব সময় মুনাফা করেন। তাঁদের মুনাফার হারও অনেক বেশি। খুচরা দোকানে ক্রেতাদের রসিদ দিতে বাধ্য করতে বেশ কয়েকবার নির্দেশনা দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। কিন্তু সেই নির্দেশনা কাজে আসেনি।
ভোক্তা অধিকার সংগঠন ভলান্টারি কনজ্যুমার ট্রেনিং অ্যান্ড অ্যাওয়ারনেস সোসাইটির (ভোক্তা) নির্বাহী পরিচালক খলিলুর রহমান বলেন, ট্যারিফ কমিশন যে হিসাব করেছে, তা নিয়ে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনা করে কিছুটা কমবেশি করে একটি দাম ঠিক করা যেতে পারে, যে দামে বিক্রি না করলে বিক্রেতাদের জরিমানা দিতে হবে। অত্যাবশ্যকীয় পণ্য বিপণন আইনের মাধ্যমে সরকার সেই ক্ষমতাও পেয়েছে।
খলিলুর রহমান বলেন, খুচরা দাম কার্যকর করতে সব পর্যায়ে নজরদারির ব্যবস্থা করতে হবে। সব পর্যায়ে স্বচ্ছতার জন্য রসিদ প্রদান বাধ্যতামূলক করা প্রয়োজন। কিন্তু এমন কোনো কার্যকর সংস্থা নেই, যারা এসব বিষয়ে নজরদারি করতে পারে।

No comments

Powered by Blogger.