বিশ্বব্যাংকের জলবায়ু প্রতিবেদন- প্রতিকার বিশ্বসম্প্রদায়ের হাতেই

বুধবার প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের জলবায়ু বিষয়ক প্রতিবেদনে বাংলাদেশকে সবচেয়ে দুর্যোগপ্রবণ অঞ্চল ঘোষণা করায় আমরা উদ্বিগ্ন হলেও বিস্মিত নই। এ দেশের বিজ্ঞানী, বিশেষজ্ঞ ও নীতিনির্ধারকরা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ফোরামে বৈশ্বিক এই দুর্যোগে
আমাদের নাজুকতার ব্যাপারে যে আশঙ্কা প্রকাশ করে আসছেন, এই প্রতিবেদন তারই সর্বশেষ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। আমাদের মনে আছে, ঝুঁকি বিশ্লেষণ সংক্রান্ত বিশেষায়িত ব্রিটিশ প্রতিষ্ঠান ম্যাপলক্রফট প্রণীত এবং জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক আন্তঃসরকার প্যানেল বা আইপিসিসি পর্যালোচিত ২০১১ সালের অক্টোবরে প্রকাশিত প্রতিবেদনের কথা। ওই প্রতিবেদনে জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত বিপন্নতার সূচকে বাংলাদেশ সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকা দেশ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিল। একই সময়ে আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা অ্যাকশন এইড প্রকাশিত একটি গবেষণা প্রতিবেদনেও জলবায়ু পরিবর্তন ও ক্ষুধা মোকাবেলায় বাংলাদেশ পঞ্চম বিপন্ন দেশ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিল। বস্তুত গত কয়েক বছর ধরে বৈশ্বিক এই বিপদ সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ফোরামে আমরা এ বিষয়েই বিশ্ব নেতৃবৃন্দের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করে আসছি। এই ইস্যুতে বাংলাদেশে তৎপর বিভিন্ন বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা আরও আগে থেকে বলে আসছিল যে, শুধু ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে নয়, জনসংখ্যার ঘনত্বও বাংলাদেশকে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে। অবশ্য সরকার ও বিশেষজ্ঞ মহল থেকে বরাবর অনুৎসাহিত করা হয়েছে যে, 'সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ' দাবি করা বিপন্ন অন্যান্য দেশের সঙ্গে অনাকাঙ্ক্ষিত প্রতিযোগিতা তৈরি হতে পারে। এমন দাবি বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণের দায়ও বর্তাতে পারে আমাদের ওপর। বিশ্বব্যাংকসহ বিভিন্ন বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠানের এসব প্রতিবেদনের পর বিষয়টি নিয়ে আর বিতর্কের অবকাশ থাকবে না। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় বিভিন্ন আন্তর্জাতিক উদ্যোগ ও তহবিলেও বাংলাদেশের দাবি বিশেষভাবে বিবেচিত হবে, আশা করা যায়। বিশ্বব্যাংকের এই প্রতিবেদনে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, তিন থেকে পাঁচ বছর পরপর বাংলাদেশের দুই-তৃতীয়াংশ এলাকা প্লাবিত হবে। এতে ফসলের ক্ষতি হওয়ার পাশাপাশি দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আবাসও বিনষ্ট হবে। তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশের এত বেশি ক্ষয়ক্ষতির দায় যে বাংলাদেশের নয়, ভোগবাদী উন্নত বিশ্বের এবং জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবেলায় তাদেরকেই অগ্রণী ভূমিকা নিতে হবে_ এসব প্রতিবেদন উদৃব্দত করে সেই দাবি এখন জোরালো করতে হবে। আমরা জানি, বন্যা ও ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলায় বাংলাদেশের রয়েছে দীর্ঘ অভিজ্ঞতা ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবেলায়ও বাংলাদেশের নীতিগত প্রস্তুতি বিশ্বে উচ্চপ্রশংসিত। উন্নত ও স্বল্পোন্নত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশই প্রথম নাপা (ন্যাশনাল অ্যাডাপটেশন প্রোগ্রাম অব অ্যাকশন) এবং ক্লাইমেট চেঞ্জ স্ট্র্যাটেজি পেপার তৈরি করতে পেরেছে। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় যে বিপুল ব্যবহারিক ও কারিগরি আয়োজন জরুরি, তা আমরা কোথায় পাব? এ ক্ষেত্রে উপযুক্ত প্রযুক্তি ও পর্যাপ্ত অর্থ নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে উন্নত বিশ্বকে। একই সঙ্গে নিজেদের সামর্থ্যও কাজে লাগনোর বিকল্প নেই। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশ যে ঝুঁকির মুখে পড়েছে, তাতে আমাদের ভূমিকা বা দায় যত কমই থাকুক, অন্যের ভরসায় থাকাটাও বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক হতে পারে না। সে ক্ষেত্রে ইতিমধ্যেই নিজস্ব অর্থায়নে গৃহীত প্রকল্পগুলো দক্ষতা ও স্বচ্ছতার সঙ্গে পরিচালনার মাধ্যমে বিশ্বের কাছে আমাদের সামর্থ্য ও আন্তরিকতা প্রমাণ করতে পারি। প্রমাণ করতে পারি যে, বৈশ্বিক এই দুর্যোগ মোকাবেলায় এখন প্রয়োজন কেবল বিশ্বসম্প্রদায়ের আর্থিক ও প্রযুক্তিগত সহযোগিতা।

No comments

Powered by Blogger.