ম্যান্ডেলার জন্য প্রার্থনা ভূমিকা ও অনুবাদ: আন্দালিব রাশদী

৭১ বছর বয়সে গ্র্যাজুয়েশন
টু দ্য ইউনিভার্সিটি অব সাউথ আফ্রিকা
২২ ডিসেম্বর, ১৯৮৭
নিম্নলিখিত কারণে ল্যাটিন (স্ট্যান্ডার্ড) ওয়ান বিষয় অধ্যয়ন থেকে আমাকে অব্যাহতি দেওয়ার জন্য আবেদন করছি:
আমি যদিও ১৯৩৮ সালে এ বিষয়ে পরীক্ষা দিয়ে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেছি এবং ১৯৪৪ সালে একই বিষয়ে ইউনিভার্সিটি অব উইটওয়াটার্সর্যান্ড থেকে বিশেষ কোর্স অধ্যয়ন করে পরীক্ষায় পাস করেছি, এখন কার্যত সবই ভুলে গিয়েছি। আমাকে যদি ল্যাটিন ওয়ান কোর্সটি করতে বাধ্য করা হয়, একেবারে প্রথম থেকেই শুরু করতে হবে। ৬৯ বছর বয়সে এই দায়িত্ব নেওয়া আমার জন্য বাস্তবিকই অত্যন্ত কষ্টসাধ্য একটি ব্যাপার হয়ে উঠবে। গ্রেপ্তার হওয়ার আগে নয় বছর আমি উকিল হিসেবে আদালতে চর্চা করেছি। আমি যদি আবার ওকালতি পেশায় ফিরে যেতে চাই, সবার আগে ল্যাটিন কোর্সের ডিগ্রির কোনো প্রয়োজনই হবে না। তবে প্রকৃত সত্য হচ্ছে, উকিল কিংবা অ্যাটর্নি হিসেবে ওকালতি চর্চার কোনো ইচ্ছা আমার নেই। আমি যদি ভবিষ্যতে ওকালতি করার কথা ভেবে থাকি, তা-ও কখনো বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না। কারণ, আমি কারাগারে যাবজ্জীবন দণ্ড ভোগ করছি। আপনি যদি অনুগ্রহ করে আমার আবেদন মঞ্জুর করেন, আমি ল্যাটিন ওয়ানের পরিবর্তে ‘আফ্রিকার রাজনীতি’ অধ্যয়নের প্রস্তাব রাখছি।
১৯৮৭ সালে ৬৯ বছর বয়সে ম্যান্ডেলা নতুন উদ্যমে পড়াশোনা শুরু করে ১৯৮৯ সালে ডিগ্রি লাভ করেন। নেলসন ম্যান্ডেলা ১৯৪০ সালে ইউনিভার্সিটি কলেজ অব ফোর্ট হেয়ার থেকে বহিষ্কৃত হওয়ার পর ইউনিভার্সিটি অব সাউথ আফ্রিকাতে নাম লেখান। একই সঙ্গে আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের সভাতেও যোগ দিতে শুরু করেন। ১৯৪৩ সালে ইউনিভার্সিটি অব উইটওয়াটার্সর্যান্ড থেকে বিএ ডিগ্রি লাভ করে এলএলবিতে ভর্তি হন। ৩৬ বছর পর কারাগারে পরীক্ষা দিয়ে এলএলবি ডিগ্রি লাভ করেন।

কারাগারের পাণ্ডুলিপি থেকে
মোহ ও মুহমুদগর উভয়ই জীবনের অংশ এবং তা কখনো ফুরোয় না, অন্তহীনভাবে চলতে থাকে। চল্লিশের দশকের শুরুর দিকে যা আমার ভাবনাকে বিশেষভাবে আঘাত করে তা হচ্ছে, প্রত্যাশা ও প্রকৃত অভিজ্ঞতার দ্বন্দ্ব। কলেজে পড়ার সময় আমার বিশ্বাস জন্মেছে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই আমি শীর্ষস্থানে পৌঁছে আমার জনগণের সফল উদ্যোগে নেতৃত্ব দেব। সে সময় ফোর্ট হেয়ারের শিক্ষার্থীদের অধিকাংশের বেলাতেই এই কথাটি সত্য। কিন্তু তাদের অনেকেই লেকচার রুম থেকে সরাসরি নিয়মিত আয় এবং যথেষ্ট প্রভাবশালী অবস্থানের আরামদায়ক চাকরিতে যোগ দিয়েছে। এ কথাও সত্য, বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েটরা বিশেষ করে, শিক্ষার ক্ষেত্রে সমাজের বিশেষ শ্রদ্ধা উপভোগ করে থাকে। আমার অভিজ্ঞতা তাদের চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের। আমি সেই শ্রেণীতে মিশে গেলাম যেখানে উচ্চতর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাই প্রয়োজনীয় নিয়ামক নয়। সেখানে জনসাধারণের সাধারণ জ্ঞান ও অভিজ্ঞতাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কলেজে আমি যা শিখেছি এর কিঞ্চিৎই আমার নতুন পরিবেশের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। বর্ণবাদী নির্যাতন, কালো মানুষের সুযোগের অপর্যাপ্ততা, দৈনন্দিন জীবনে অসংখ্যবার কালো মানুষের অপদস্ত হওয়া—সাধারণ মানের শিক্ষকেরা এসব বিষয় নিয়ে কথা বলতে সংকুচিত থাকত। বর্ণ নিয়ে শাসকের মনে প্রোথিত ধারণার ভূত কেমন করে সরাতে পারব, কেউ আমাকে সে ধারণা দেয়নি। কেউ আমাকে বলেনি এ সম্পর্কে জানতে হলে আমাকে কোন বই পড়তে হবে। আমি যদি সুশৃঙ্খল স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ দিতে চাই, তাহলে আমাকে কোনো রাজনৈতিক দলে যোগ দিতে হবে, তা-ও কেউ বলেনি।
ঘটনাচক্রে আমি এসব শিখেছি এবং ভুলভ্রান্তিও পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে আমাকে শিখতে হয়েছে।

থুথা র্যাঞ্চের কবলে
হেল্ডটাউনে এক যুবকের সঙ্গে আমার বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। আমি যখন জোহানেসবার্গে পৌঁছি, সেই বন্ধুত্ব ফল দিতে শুরু করে। তার নাম জাকারিয়া মোলেট। তার বাবার একটি মুদিখানা ছিল, আর তিনি ছিলেন ওয়েসলিন চার্চের প্রধান স্টুয়ার্ড। আমার টিকে থাকার প্রাণান্তকর চেষ্টা দেখে তিনি আমার দেখভাল করতেন এবং নিশ্চিত হতে চাইতেন যেন আমার প্রয়োজনীয় কিছু জিনিসপত্র তার মুদিখানা থেকে তুলে নিতে পারছি। বিশেষ এক অনুষ্ঠানে জাকারিয়া এসে আমাকে বলল, ‘রাতের বেলা তোমাকে খুব সতর্ক থাকতে হবে, এখানে থুথা র্যাঞ্চ নামের একটি গ্যাং সক্রিয় আছে।’
থুথা মানে হুট করে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া। এরা হচ্ছে গ্যাংস্টার—চোর, ডাকাত, যখন কারও বাড়ি অবরোধ করে সবকিছু উঠিয়ে নিয়ে যায়—থুথা নামটা এসেছে সেখান থেকেই। তিনি বললেন, ‘তুমি যেখানে বসবাস করছ এই গ্যাং এখন সেখানে বেশ তৎপর।’
আমি একটি সিঙ্গল রুমে থাকি, এক রাতে আমি আমার রুমের বাইরে হইচই শুনে জেগে উঠি। জাকারিয়া আমাকে যা বলেছে মনে পড়ল। তারপর মনে হলো তারা নিজেদের মধ্যে কথা-কাটাকাটি শুরু করল। একজন বলল, ‘চল, ভেতরে যাই’, অন্যজন বলল, ‘নারে, এই ব্যাটার মালকড়ি নেই, কিছুই নেই। ছাত্র, পড়াশোনা করে।’
আবার তাদের মধ্যে কথা-কাটাকাটি হলো। তাদের নেতৃস্থানীয় একজন বলল, ‘একে ছেড়ে দে। চল, যাই।’ দরজা ভেঙে যে ভেতরে ঢুকতে চাচ্ছিল, বেশ অসন্তুষ্ট হলো। সে সজোরে দরজায় লাথি মারল, পুরোনো জং ধরা বল্টু লাগানো দরজা ভেঙে পড়ল, কিন্তু তারা কেউই ভেতরে ঢুকল না। পা চালিয়ে অন্যদিকে চলে গেল।
[রিচার্ড স্টেনজেলকে দেওয়া নেলসন ম্যান্ডেলার সাক্ষাৎকার থেকে।]

No comments

Powered by Blogger.