জাতীয় বাজেট দেশের নাকি দশের বাজেট? by ফারুক মঈনউদ্দীন

বাজেট সম্পর্কে একটা ছড়া লেখা হয়েছে এ রকম: ‘মির্জা নুরুল গনি/ বিরাট বিশাল ধনী/ বাজেট এলেই নতুন করে/ পায় সে হীরার খনি।/ কেটেছে সব ধাঁধা/ নেই কোনো আর বাধা/ নতুন করে চোরাই টাকা/ করবে আবার সাদা।
/ সদানন্দ শীল/ নিবাস চলনবিল/ নামের সাথে তার জীবনের/একটুও নাই মিল।/ সারাটা দিন খেটে/ ভাত জোটে না পেটে/ বোঝেই না সে কী আছে এই/ জমকালো বাজেটে।’
ভালো ছড়া হলে সেটা দিয়ে সমাজ-অর্থনীতির বহু অসংগতি যে সার্থকভাবে ফুটিয়ে তোলা যায়, এটি সে রকমই একটা ছড়া। বাজেটের লক্ষ্য যেমন দেশের অর্থনীতি, তেমনি সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নও। অথচ সদানন্দ শীলের মতো সাধারণ মানুষেরা কখনোই বাজেটের মূল মর্ম বোঝে না, তাদের কাছে বাজেট মানে জিনিসপত্রের দাম বাড়া বা কমা। আমাদের দেশের সংস্কৃতিতে বিভিন্ন মহলের রাজনীতি প্রভাবিত বাজেট বিশ্লেষণের কারণে সাধারণ মানুষেরা নিশ্চিত হতে পারে না তাদের জীবনে বাজেট কেমন এবং কতখানি প্রভাব ফেলতে পারবে, কিংবা বাজেট বিশ্লেষণটি কতটুকু নিরপেক্ষ কিংবা সঠিক।
যে আইন বা বিধানবলে বাজেট বা ‘অর্থ বিল’ যা আইন প্রস্তাব হিসেবে সংসদে উত্থাপন করা হয়, সেই ‘সরকারি অর্থ ও বাজেট ব্যবস্থাপনা আইন ২০০৯’-তে আর্থিক ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে প্রথমেই বলা হয়েছে যে সরকার সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার উন্নতিসাধন এবং বার্ষিক বাজেট ঘাটতি ধারণযোগ্য পর্যায়ে রাখার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। এ ছাড়া এই আইনে বলা আছে, সরকার জনস্বার্থে অর্থ বরাদ্দের ক্ষেত্রে অধিকতর সমতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করবে এবং তার জন্য আঞ্চলিক সমতা ও নারী-পুরুষের সমতা নিশ্চিত করা এবং দারিদ্র্য নিরসনসংক্রান্ত কার্যক্রমে অধিক অর্থ বরাদ্দ দেওয়ার জন্য সুনির্দিষ্টভাবে কার্যব্যবস্থা গ্রহণ করবে। সুতরাং আমাদের প্রচলিত আইনেই বাজেটের মাধ্যমে সমতা, দারিদ্র্য দূরীকরণ এসব উদ্দেশ্য বিবৃত করা আছে।
অথচ বহুল আলোচিত এবং বিতর্কিত কালোটাকা সাদা করার যে প্রক্রিয়াটি ১৯৭৬ সালের বাজেটে প্রথমবারের মতো সংযোজন করার পর থেকে প্রায় প্রতিবছরই চলে আসছে, সেটি এই সমতার মূল দর্শনের বিরোধী। একজন সৎ আয়করদাতাকে তাঁর অর্জিত আয়ের ওপর ১০ থেকে ২৫ শতাংশ পর্যন্ত আয়কর দিতে হয়, অথচ একজন কালোটাকার মালিক ১০ বা ১৫ শতাংশ আয়কর দিলেই তাঁর অবৈধভাবে সঞ্চিত অর্থ বৈধ হয়ে যাবে। এত বড় সামাজিক অবিচার আর কী হতে পারে? এটি এমনকি আমাদের সংবিধানবিরোধীও বটে।
তার পরও এবার আবাসন খাতে কালোটাকা বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়ার প্রস্তাবের পক্ষে-বিপক্ষে কথা বলা হচ্ছে। এক পক্ষ বলছে আবাসন খাত চাঙা হবে, অন্য পক্ষ এর বিরোধিতা করে বলছে আবাসন খাতে মূল্যস্ফীতি দেখা দেবে। কিন্তু মূল প্রস্তাবটিই যেখানে বৈষম্যপূর্ণ, সেখানে পক্ষে-বিপক্ষে বলার আর অবকাশ থাকে না। যদিও বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী নিজেই বলেছেন, অপ্রদর্শিত আয়কে বিনিয়োগে ব্যবহার করার জন্য এ দেশে বহুবার নানা ধরনের সুবিধা প্রদান করা হয়েছে। কিন্তু তাতে কখনো তেমন ফল পাওয়া যায়নি। তাঁর এমন স্বীকারোক্তির পর কেবল আবাসন খাতের জন্য এই সুযোগ দেওয়াটি যে মহলবিশেষের চাপে পড়ে দিতে হয়েছে, সেটি আর অপ্রচ্ছন্ন থাকে না।
এবারের বাজেটে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও যোগাযোগ খাতে সরবরাহ সীমাবদ্ধতা দূরীকরণে গৃহীত পদক্ষেপসমূহের বাস্তবায়নের মাধ্যমে অবকাঠামোগত ঘাটতি আরও কমিয়ে আনার শর্ত সাপেক্ষে এবং এশীয় দেশসমূহের সঙ্গে সংগতি রেখে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার নির্ধারণ করা হয়েছে ৭.২ শতাংশ। অথচ বাজেট বক্তৃতায় আগের এক জায়গায় বলা হয়েছে যে গত চার বছরে আমাদের জিডিপির গড় প্রবৃদ্ধি ছিল ৬.২ শতাংশ। আবার বক্তৃতার অন্য জায়গায় বলা হয়েছে এ বছরের (২০১২-১৩) জিডিপি প্রবৃদ্ধি কোনো অবস্থাতেই পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় কম হবে না। অর্থমন্ত্রীর নিজ ধারণায় বর্তমান অর্থবছরে অর্থাৎ ২০১২-১৩ বছরে প্রবৃদ্ধি দাঁড়াবে ৬.৩ থেকে ৬.৮ শতাংশের মধ্যে। তারপর আবার পৃষ্ঠা ১৭, ৩২ নং অনুচ্ছেদে বলা হচ্ছে: ‘আমরা দেখেছি, যে বছর সংসদীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, সে বছর প্রবৃদ্ধির হার পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় অনেক কমে যায়। সারণি-৭ থেকে দেখা যাবে নির্বাচনী বছরে প্রবৃদ্ধির হার ২.৬ থেকে ০.৩ শতাংশ কমে যায়।’ প্রস্তাবিত বাজেটের কালসীমাও নির্বাচনী বছরেই, তাহলে ৭.২ শতাংশ প্রবৃদ্ধির হার কীভাবে নির্ধারিত হচ্ছে? অর্থমন্ত্রীর হিসাব এবং অনুমান অনুযায়ী প্রবৃদ্ধির হার ৬.৩ থেকে কম ছাড়া বেশি হবে না। তাহলে এটা কি এ রকম যে স্বপ্নে যদি খেতেই হয়, তাহলে ভাতের বদলে পোলাও খাওয়াই ভালো?
দেশের মুষ্টিমেয় যে কয়েকটি খাত সঠিকভাবে দেশের প্রবৃদ্ধিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করছে তার মধ্যে কৃষি খাত অন্যতম। কৃষি উপকরণ, নাকি কৃষিজাত পণ্যের মূল্য সমর্থন—কোনটি অধিকতর শ্রেয়, তা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও দেশের কৃষি উৎপাদনে এই ভর্তুকির আপাত বিকল্প নেই। ২০১২-১৩ অর্থবছরে কৃষি ভর্তুকির জন্য নয় হাজার ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ থাকলেও সংশোধিত বাজেটে আরও তিন হাজার কোটি টাকা বাড়াতে হয়েছে। অথচ প্রস্তাবিত বাজেটে এবারেও বাজেটে রাখা হয়েছে নয় হাজার কোটি টাকার সংস্থান। এই হ্রাসকৃত বরাদ্দের কোনো ব্যাখ্যা দেওয়া না হলেও কৃষিমন্ত্রী পরবর্তী সময়ে বলেছেন যে চলতি বছর বকেয়া ভর্তুকি পরিশোধ করার জন্যই বাড়তি অর্থ দিতে হয়েছে, সুতরাং প্রস্তাবিত বাজেটে ভর্তুকির জন্য সংস্থান কম হবে না।
পর্যটনশিল্পের উন্নয়নের জন্য সরঞ্জামের ওপর শুল্ক হ্রাস করার প্রস্তাবটি ইতিবাচক। কিন্তু দেশের পর্যটন আকর্ষণগুলোর প্রয়োজনীয় সংস্কার, দখলমুক্তি, অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং পর্যটন এলাকার আইনশৃঙ্খলা উন্নয়ন নিশ্চিত না করলে কেবল শুল্ক হ্রাসের মাধ্যমে পর্যটনশিল্পের কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন ঘটার সম্ভাবনা ক্ষীণ, বরং এই শুল্ক রেয়াতের অপব্যবহার ঘটতে পারে।
যোগাযোগ ও অবকাঠামো খাতে গৃহীত ব্যবস্থার পরিকল্পনা হিসেবে ঢাকা-চট্টগ্রাম, নবীনগর-ডিইপিজেড-চন্দ্রা, জয়দেবপুর-ময়মনসিংহ, জয়দেবপুর-এলেঙ্গা প্রভৃতি হাইওয়েকে চার লেনে রূপান্তর করার প্রক্রিয়া এবং প্রস্তাবের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু হাইওয়ে নির্মাণের পাশাপাশি হাইওয়ের পূর্ণ ব্যবহারের জন্য যথার্থ পরিবেশ তৈরি করার জন্য যে উদ্যোগ প্রয়োজন, তার ব্যবস্থা না করলে কেবল চার লেন সড়ক থেকে কোনো সুফল পাওয়া যাবে না। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে মহিপাল এবং কুমিল্লার পদুয়ার বাজারসহ বহু বাইপাস নির্মাণ করা হলেও সেগুলো দোকানপাট এবং অবৈধ বাসস্ট্যান্ডে আবার দখল হয়ে গেছে সড়ক বিভাগের অবহেলা, প্রশ্রয় এবং দুর্নীতির কারণে। যদিও নিরাপদ সড়কের নামে ২০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে, কিন্তু সেটি কী কায়দায় খরচ হবে, তা ব্যাখ্যা করা হয়নি। মহাসড়কের গা ঘেঁষে গড়ে ওঠা অবৈধ হাটবাজার উচ্ছেদ করা, এমনকি গাড়িচালকদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণও নিরাপদ সড়ক ব্যবস্থার অংশ হওয়া উচিত। বাংলাদেশে দুর্ঘটনায় প্রতিদিন ঝরে যাচ্ছে বহু প্রাণ, এই জীবনক্ষয় রোধে একটি সমন্বিত পরিকল্পনা তৈরি করা উচিত দ্রুত।
বাজেটে ৩০০ কোটি ডলারের বিদেশি অর্থায়নের পরিকল্পনা রয়েছে, কিন্তু অস্থিতিশীল পরিস্থিতির আশঙ্কাযুক্ত নির্বাচনী বছরে এই বিপুল পরিমাণ বিদেশি অর্থায়ন জোগাড় করা আদৌ সম্ভব হবে কি না, সেটি প্রশ্নসাপেক্ষ। তার ওপর বিদ্যুৎ, জ্বালানি এবং পরিবহন খাতের অদক্ষতা দূর না করলে শুধু বিদেশি নয়, দেশি বিনিয়োগকারীরাও এগিয়ে আসবেন না। জরুরি ব্যবস্থা হিসেবে স্থাপিত কুইক রেন্টাল পাওয়ার প্ল্যান্টগুলো নিয়ে নতুন করে চিন্তা করার সময় এসেছে। কারণ, দ্রুততম সময়ে বিদ্যুতের ব্যবস্থা করার জন্য প্রচুর ভর্তুকি দিয়ে স্বল্পমূল্যে সরবরাহের যে মডেলটি করা হয়েছিল, তা দীর্ঘ সময় ধরে চালিয়ে যাওয়ার আর্থিক সক্ষমতা দেশের অর্থনীতির নেই। বাজেট দলিলে ৫৪টি নতুন বিদুৎকেন্দ্র স্থাপন করে বাড়তি ৩৮৪৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সংযোজনের কথা বলা হলেও কুইক রেন্টাল কেন্দ্রগুলো সম্পর্কে একটি কথাও বলা হয়নি কোথাও। সুতরাং এই বোঝাগুলো থেকে মুক্ত হওয়ার কোনো আশু পরিকল্পনা সরকারের আছে বলে প্রতীয়মান হয় না।
প্রস্তাবিত বাজেটে তিন লাখ নতুন করদাতা শনাক্ত করে করদাতার সংখ্যা বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। অথচ আমাদের আয়কর প্রশাসনের সহজাত দুর্বলতা উত্তরণ এবং কর ফাঁকি রোধে দক্ষতা ও বিশ্বস্ততা নিশ্চিতকরণের কোনো উদ্যোগ বা পরিকল্পনা পাওয়া যায় না। নতুন করদাতা শনাক্ত করার পাশাপাশি বছরের পর বছর ধরে কর ফাঁকি দিয়ে আসা নামমাত্র করদাতাদের ফাঁকি রোধ করার ব্যবস্থা করলে রাজস্ব বৃদ্ধির পাশাপাশি সৎ করদাতারা উৎসাহিত বোধ করবেন।
বাজেটকে নিছক একটি আর্থিক দলিল বলে মনে হলেও এটির মধ্যে থাকে সরকারের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য এবং কৌশল। সুতরাং সিংহভাগ জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য এবং রাজস্বনীতিতে সহনক্ষম একটি বাজেট প্রণয়ন করা সব রাজনৈতিক সরকারের উদ্দেশ্য। আমাদের মতো সীমিত সম্পদের দেশে সরকারের আয় বৃদ্ধি করে উন্নয়ন ব্যয় মেটানো, আবার বেশি করারোপ না করে জনগণকে সন্তুষ্ট রাখা—এই দুয়ের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা কঠিন একটা কাজ। সুতরাং একটি বাজেট যদি জনতুষ্টি কিংবা নির্বাচনী বাজেট হয়েও থাকে, তাতে ক্ষতি নেই। কারণ, সরকারের কাজই জনগণকে তুষ্ট রেখে নির্বাচনী বৈতরণি পার হওয়া। কেবল লক্ষ রাখতে হবে, এই দুই উদ্দেশ্য সাধন করতে গিয়ে যাতে দেশ এবং অর্থনীতির কোনো সুদূরপ্রসারী ক্ষতি সাধিত না হয়।
ফারুক মঈনউদ্দীন: ব্যাংকবিষয়ক বিশ্লেষক।
fmainuddin@hotmail.com

No comments

Powered by Blogger.