হৃদয়নন্দন বনে-জয়নগরের মোয়া বৃত্তান্ত by আলী যাকের

আজকে সকালে লেখার টেবিলে বসে যখন ভাবছি কী বিষয়ে লিখব, তখন হঠাৎই জয়নগরের মোয়ার কথা মনে পড়ে গেল। এই মিষ্টিটি বিশেষ ঋতুতে কলকাতার বাগবাজার এলাকায় প্রায় সব ময়রার দোকানে পাওয়া যায়।
একে কেন যে মোয়া বলে তা আজও আমি জানি না। বোধহয় এই কারণে যে, এর প্রস্তুত প্রণালি অনেকটা মুড়ির মোয়া, চিড়ার মোয়া ইত্যাদির সঙ্গে মিলে যায়। জয়নগরের মোয়া তৈরি হয় খৈ, দুধের ক্ষীর আর নলেন গুড় দিয়ে। অতি উপাদেয় একটি মিষ্টি।
এই জয়নগরের মোয়ার কথা মনে হতেই হঠাৎ করে তারাপদদার চেহারাটা আমার চোখে ভেসে উঠল। তিনি অবশ্য এখন আর আমাদের মাঝে নেই। বছর দুয়েক আগে আমাদের ছেড়ে পরলোকে চলে গেছেন। তারাপদদা, তারাপদ রায় আমাদের টাঙ্গাইলের সন্তান। শেষ নিবাস ছিল কলকাতায়। যদিও তার বাবা, বড় ভাই এবং অন্যান্য কিছু আত্মীয়স্বজন আমৃত্যু টাঙ্গাইলেই থেকে গিয়েছিলেন। তারাপদ রায় স্বনামধন্য কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায় এঁদের সখ্য। অবশ্য তারাপদদার গদ্য তার পদ্যের চেয়ে আমার বেশি ভালো লাগে। তিনি রম্য রচনায় পারদর্শী ছিলেন। কলকাতার নানা দৈনিকে এই রচনাগুলো ছাপা হতো। অবশ্য বেশিরভাগই ছাপা হতো আনন্দবাজার পত্রিকায়। পরে এই লেখাগুলো বই আকারেও প্রকাশিত হয়েছে এবং যথেষ্ট জনপ্রিয়তা পেয়েছে। কাঁঠাল কাঠের পিঁড়ি, কাণ্ডজ্ঞান ইত্যাদি ওইসব লেখা নিয়ে প্রকাশিত বইয়ের নাম। এ রকম একটি বইতে তিনি এই জয়নগরের মোয়ার উল্লেখ করেছিলেন। তাই জয়নগরের মোয়া শব্দটি উচ্চারণ করার সঙ্গে সঙ্গেই তারাপদদার হাস্যোজ্জ্বল শ্রী মুখখানি আমার চোখে ভেসে উঠল। সেই গল্প আপনাদের সঙ্গে ভাগ করে নিতে চাই আজ। অবশ্য বইটি এখন হাতের কাছে নেই বলে হুবহু তুলে দেওয়া গেল না। হয়তো একটু এদিক-ওদিক হতে পারে। তবুও মোদ্দা ঘটনা এ রকম ছিল।
কবি হিসেবে তারাপদদা নিমন্ত্রণ পেতেন ভারতের বিভিন্ন জায়গায়। একবার এ রকম এক নিমন্ত্রণ এলো কলকাতা থেকে বেশ কিছু দূরে এক বাঙালি অধ্যুষিত শহরে, কোনো এক সাহিত্য বাসরে অংশগ্রহণের জন্য। তারাপদদা কলকাতার বাইরে যেতে খুবই ভালোবাসতেন। অতএব, ট্রেনে চেপে তিনি ওই শহরের উদ্দেশে রওনা হলেন। যাওয়ার সময় বাগবাজার হয়ে দুই কেজি জয়নগরের মোয়া একটি কাগজের বাক্সে বেঁধে নিলেন, সেখানে তার কবি বন্ধুদের খাওয়াবেন বলে। বাগবাজার থেকে মোয়া কিনে দমদম স্টেশন থেকে ট্রেনে চাপলেন তিনি। অবশেষে সেই শহরে উপস্থিত হলেন। পরের দিন, যতদূর মনে পড়ে রোববার সকালে, সাহিত্য বাসরে উপস্থিত হলেন। তার হাতে যথারীতি জয়নগরের মোয়ার বাক্সটি নিয়ে। সেখানে পেঁৗছতেই সবাই হৈ হৈ করে তাকে স্বাগত জানাল। তিনি চেয়ারে বসতে যাবেন, এমন সময় কেউ একজন বলল যে, আজ আমাদের মধ্যে ভারতের সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দলের এক গুরুত্বপূর্ণ পদাসীন ব্যক্তিত্ব রয়েছেন, যিনি ঘটনাচক্রে কবিতাও লেখেন। তারাপদদা মনে করেছিলেন যে, তিনি জয়নগরের মোয়ার বাক্সটি তার কোনো বন্ধুর হাতে তুলে দেবেন। কিন্তু এমন গুরুত্বপূর্ণ এক লোক ওই আসরে থাকায় তারই হাতে তিনি বাক্সটি তুলে দিলেন। সেই রাজনীতিবিদ আহ্লাদে আটখানা হয়ে তারাপদদাকে জিজ্ঞেস করলেন, এতে কী আছে। জবাবে তারাপদদা বিনীতভাবে বললেন, 'এতে করে কিছু জয়নগরের মোয়া নিয়ে এসেছি। খেতে অতি উপাদেয়।' সেই ভদ্রলোক বললেন, 'ও, জনগণের মোয়া? তাহলে তো খেতেই হয়!' তারপর তারাপদদা লিখেছেন যে, জনগণের সেই নেতা জনগণের দুই কেজি মোয়ার দেড় কেজি এক বসায় সাবড়ে দিলেন। কিছু মোয়া পড়ে রইল অন্য কবিদের জন্য। এই গল্পটি কতবার যে পড়েছি, তার কোনো ইয়ত্তা নেই। যতবারই পড়ি, মনে হয় নতুন করে পড়ছি বুঝি। জনগণের মোয়া_ এই বিষয়টি বোধহয় সব দেশের সব রাজনীতিবিদের অতি প্রিয় একটি খাদ্য। এভাবেই বোধ করি জনগণ স্বয়ং মোয়ায় পরিণত হয়ে যায়।
গতকাল অর্থাৎ ১৯ জুন আমাদের দেশের প্রথিতযশা অভিনেত্রী ফেরদৌসী মজুমদারের জন্মদিন উপলক্ষে তার কাজের ওপর একটি সচিত্র স্মারক অ্যালবাম প্রকাশ করা হয়েছিল। এ উপলক্ষে এক সংবর্ধনার আয়োজন করা হয় বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীর জাতীয় মিলনায়তনে। ফেরদৌসী মজুমদারের সঙ্গে আমি একাধিক নাটকে অভিনয় করেছি। মঞ্চে তার সঙ্গে অভিনয় করেছি সৈয়দ শামসুল হক অনূদিত উইলিয়াম শেকসপিয়রের দুটি বিখ্যাত নাটক ম্যাকবেথ এবং টেমপেস্টে। ম্যাকবেথে তিনি ছিলেন লেডি ম্যাকবেথ এবং আমি ম্যাকবেথ। টেমপেস্টে তিনি এরিয়েল এবং আমি প্রসপেরো। এ ছাড়াও টেলিভিশনে অনেক নাটকে দু'জনে একসঙ্গে অভিনয় করেছি। আমি মনে করি, তিনি এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের মঞ্চে সবচেয়ে সফল অভিনেত্রী। ফেরদৌসীর ওপরে বলতে গিয়ে কোনো কোনো বক্তা বললেন যে, একজন মানুষ শিল্পী হয়ে ওঠে তখনই, যখন তার সঙ্গে জনগণের একটি সেতুবন্ধ তৈরি হয়। ওই অনুষ্ঠানে বসেও তারাপদদার জয়নগরের মোয়া আবারও মনে পড়ে গেল। যখন আমার বলার পালা এলো, তখন ফেরদৌসীকে অভিনন্দন জানানোর পর আমি আরও কিছু কথা বলেছিলাম। আমি বলেছিলাম, একজন মানুষ শিল্পী হয়ে ওঠেন শিল্পকর্মের প্রতি তার নিরবচ্ছিন্ন ভালোবাসা এবং নিরলস পরিশ্রমের মাধ্যমে তার কর্মের উপস্থাপনের দ্বারা। তিনি সফল হয়ে ওঠেন তখনই, যখন তার কৃত শিল্পকর্ম সত্যকে ছুঁয়ে যায়, অধিষ্ঠিত করে তার কৃতকর্মকে সাফল্যের স্বর্ণশিখরে এবং এই কাজের মাধ্যমেই রচিত হয় সেতুবন্ধ, তার নিজস্ব পদ্ধতিতে, সেসব মানুষের সঙ্গে যারা শিল্পীর কাজের সঙ্গে পরিচিত হয়েছে। আমরা বলে থাকি, মঞ্চ হলো সমাজের 'দর্পণ'। অর্থাৎ সমাজে যা নিত্যই ঘটছে, সেটার প্রতিফলন আমরা দেখতে পাই মঞ্চের ওপর। অতএব, সমাজে যদি অনভিপ্রেত কিছু ঘটে থাকে, সেটাও প্রতিবিম্বিত হবে মঞ্চের দর্পণে_ এটাই স্বাভাবিক। এই কাজটি একজন শিল্পী যখন সুচারুরূপে করতে পারবেন, তখনই তিনি হয়ে উঠবেন সফল শিল্পী। ফেরদৌসী মজুমদার বিলক্ষণ এমন কাজই করেন তার নিজস্ব ক্ষেত্রে। তার সবচেয়ে বড় গুণ হলো যে, তিনি কখনও শিল্পকর্মকে বাহন করে কোনো গোষ্ঠী বা দলের নেতৃত্ব নেওয়ার কথা চিন্তা করেননি। বরং তিনি যে ক্ষেত্রটি বেছে নিয়েছেন, সেখানে সর্বোৎকৃষ্ট কাজটি আমাদের উপহার দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। এই কারণেই তিনি আমাদের সবার শ্রদ্ধাভাজন এক শিল্পী।
আমরা এমনই এক দুর্ভাগা দেশ, যার জন্মের কিছুদিন পর থেকেই একের পর এক আগ্রাসন আমাদের ভিত্তিমূলে আঘাত করেছে। আমরা আমাদের সহস্র বছরের ঐতিহ্য থেকে পাওয়া সব মূল্যবোধকে নিজ বাসভূমে পরবাসী করার চেষ্টায় ব্রতী হয়েছি। ফলে এ পর্যন্ত খুব সামান্য সময় পেয়েছি আমরা গুছিয়ে বসে সৃজনশীল কাজে আত্মনিবেদন করার। সবসময়ই কিছু না কিছু রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের ভার আমাদের বহন করতে হয়েছে। 'কিছু না কিছু' শব্দ নিচয় বোধহয় ভুলে উচ্চারণ করলাম এখানে। মাঝে মধ্যে আমরা রাজনীতিবিদদের চেয়েও বেশি রাজনীতির ধারক এবং বাহক হয়ে উঠেছি। ফলে না আমরা শিল্পী হয়েছি, না রাজনীতিবিদ। আমার দেখা মতে, ফেরদৌসী কতিপয়ের একজন, যিনি তার নিজের কাজ দিয়ে মানুষের হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন।
এইটিই সৃজনশীল শিল্পকর্মের সঙ্গে সম্পৃক্ত আমাদের গভীরভাবে ভাবতে হবে যে, কতদূর এসে রাজনীতি থেকে সংস্কৃতিকে আমরা আলাদা করতে পারব। অবশ্য যে আঘাত এসেছে অদূর এবং সুদূর অতীতে আমাদের জাতিসত্তার ওপরে, আমার শাশ্বত মূল্যবোধের ওপরে, আমাদের স্বাধীন চেতনার ওপরে, সেই প্রেক্ষাপটে হয়তো এই কাজটি বড় সহজ হবে না। তবে কি ম্যাকবেথের ভাষাতেই আমরা উচ্চারণ করব সেই সংলাপ, যা একজন শিল্পীর অন্তর থেকে উৎসারিত হাহাকার কেবল : 'এতদূর রক্তের নদীতে নেমে যদি ছেড়ে দিই সাঁতার, তীরে ফেরাও তো বড় কষ্টকর।' আমি মনে করি সৃজনশীল শিল্পকর্ম কি সাহিত্যের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কোনো ব্যক্তি হতাশাগ্রস্ত হয়ে তাদের সৃষ্টি থেকে দূরে সরে যাবেন না। যতই ক্লান্তিকর হোক তাদের কাজ। যত আঘাতই আসুক তাদের ওপরে, প্রত্যাঘাত তারা করবেনই, তাদের নিজেদের সৃষ্টি দিয়ে। এত সহজে তারা জয়নগরের মোয়া হতে রাজি নন।


আলী যাকের
সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব

No comments

Powered by Blogger.