দুই বছর আগেই লক্ষ্য পূরণ

দারিদ্র্য হ্রাসে জাতিসংঘ ঘোষিত সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এমডিজি) হার নির্ধারিত সময়ের দুই বছর আগেই অর্জন করবে বাংলাদেশ। ২০১৫ সালের মধ্যে এমডিজি অর্জনের কথা ছিল। সেই সাফল্য দেখাবে বাংলাদেশ ২০১৩ সালের মধ্যেই।
বিশ্বব্যাংকের ‘দারিদ্র্য মূল্যায়ন প্রতিবেদনে’ এ কথা বলা হয়েছে। রাজধানীর একটি হোটেলে গতকাল বৃহস্পতিবার বিশ্বব্যাংক আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের এ অর্জনকে ‘বিরল’ ও ‘উল্লেখযোগ্য’ বলে আখ্যা দিয়েছে।
বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে দারিদ্র্য ও বৈষম্য দুই-ই কমেছে। বিশ্বব্যাংক গবেষণা প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে ২০০০ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত সময় ধরে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত এক দশকে দারিদ্র্য থেকে বেরিয়ে এসেছে দেশের এক কোটি ৬০ লাখ মানুষ।
দারিদ্র্য হ্রাসের এ রকম একটি ইতিবাচক তথ্য দেওয়ার পাশাপাশি বিশ্বব্যাংক মনে করিয়ে দিয়েছে, এখনো বাংলাদেশের চার কোটি ৭০ লাখ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। এদের মধ্যে আবার দুই কোটি ৬০ লাখ মানুষই চরম দরিদ্র। আর চরম দরিদ্র মানুষগুলো বাস করে গ্রামাঞ্চলে।
গতকালের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত প্রধান অতিথি ছিলেন। বিশেষ অতিথি ছিলেন খাদ্যমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক। পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য শামসুল আলম ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমান ছিলেন নির্ধারিত আলোচক। বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর জোহানেস জাট এতে স্বাগত বক্তব্য দেন। আর প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন সংস্থাটির জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ ইফফাত শরীফ।
বিশ্বব্যাংক বলেছে, এমডিজি অনুযায়ী ২০১৫ সালে বাংলাদেশের দারিদ্র্যের হার নেমে আসার কথা ২৬ দশমিক ৫১ শতাংশে এবং ২০১০ সালে দেশটির দারিদ্র্যের হার ৩১ দশমিক ৫০ শতাংশে। প্রতিবছর যে হারে কমছে, অত্যন্ত রক্ষণশীলভাবে হিসাব করলেও চলতি বছর শেষেই অর্জিত হয়ে যাবে ২০১৫ সালের লক্ষ্যমাত্রা। শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণ দারিদ্র্য হ্রাসে অন্যতম ভূমিকা রেখেছে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। প্রতিবেদন মতে, এক দশকে এই হার ২৫ শতাংশ থেকে বেড়ে ৩৫ শতাংশে উন্নীত হয়েছে।
বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বাংলাদেশে দারিদ্র্য কমছে প্রতিবছর ১ দশমিক ৭ শতাংশ হারে। জনসংখ্যা বৃদ্ধি সত্ত্বেও ১০ বছরে ২৬ শতাংশ দারিদ্র্য কমেছে। ২০০০ সালে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা ছিল যেখানে ছয় কোটি ৭০ লাখ, ২০১০ সালে এসে তা দাঁড়ায় চার কোটি ৭০ লাখ। ২০০৭-০৮ সালের বৈশ্বিক মন্দাও বাংলাদেশের দারিদ্র্য হ্রাসের গতিকে শ্লথ করে দিতে পারেনি।
দশকের প্রথম পাঁচ বছরে ঘরবাড়ি নির্মাণে ইট-সিমেন্টের ব্যবহার ও উপার্জনের জন্য সেবা খাতে মানুষ প্রবেশ করেছে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। দ্বিতীয় পাঁচ বছর সম্পর্কে বলা হয়েছে, আগের পাঁচ বছরের অবস্থা থেকে আরেকটু উন্নতির মাধ্যমে বাংলাদেশে পাকা ঘরবাড়ি নির্মাণ এবং টেলিভিশন ও মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা বেড়েছে।
বিশ্বব্যাংকের মতে, ২০০০ থেকে ২০০৫ সালের মধ্যে দেশের পূর্বাঞ্চল অর্থাৎ ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেটের দ্রুত উন্নতি হয়েছে। কিন্তু রাজশাহী, খুলনা ও বরিশাল ছিল পিছিয়ে। এরপর ২০০৫ থেকে ২০১০ সালে দারিদ্র্য হ্রাসের পদক্ষেপে কাঠামোগত পরিবর্তন এসেছে। এই সময়ে দেশের পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোতে দারিদ্র্যের হার বেশি কমেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ২ শতাংশ সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী কর্মসূূচিতে ব্যয় করা হয়। অথচ এ কর্মসূচির সুবিধা পৌঁছায় মোট দরিদ্র জনগোষ্ঠীর এক-তৃতীয়াংশের কাছে।
অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্যে বাংলাদেশে বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর জোহানেস জাট বলেন, নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও বাংলাদেশে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সংখ্যা কমেছে এক কোটি ৬০ লাখ। পাশাপাশি বৈষম্যও কমেছে। এটি এক বিরল ও উল্লেখযোগ্য অর্জন।
জোহানেস জাট আরও বলেন, দারিদ্র্য হ্রাসে বাংলাদেশ অত্যন্ত ভালো করছে এটা ঠিক, তবে কার্যকরভাবে দারিদ্র্য হ্রাস করতে বাংলাদেশের উচিত হবে সমন্বিত বহুখাতবিশিষ্ট কার্যক্রম হাতে নেওয়া। দরকার কৃষি উৎপাদনে বিনিয়োগ এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে উৎপাদনশীল ও সেবা খাতে আরও মনোযোগ দেওয়া।
অর্থমন্ত্রী বলেন, দারিদ্র্য হ্রাসে গত এক দশকের সাফল্যের পেছনে রয়েছে সরকারের দারিদ্র্য বিমোচনের নানা পদক্ষেপ। তিনি বলেন, গত চার বছরে এশিয়া ও আফ্রিকার কিছু দেশ উন্নয়নে যথেষ্ট দক্ষতা দেখিয়েছে। এই সময়ে বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যেও ৬ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি ধরে রেখেছে এশিয়ার ১৪টি দেশ এবং আফ্রিকার ১০টি দেশ। বাংলাদেশও এর মধ্যে রয়েছে, যা অত্যন্ত আনন্দদায়ক।
‘বিশ্বব্যাংকের এই সমীক্ষা অত্যন্ত খুশির সমীক্ষা’—এ কথা উল্লেখ করে অর্থমন্ত্রী বলেন, সংস্থাটি শুধু টাকাপয়সা দিয়ে নয়, নানা সমীক্ষা করেও বাংলাদেশকে সহযোগিতা করে। প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘১৫ কোটি মানুষের এ দেশের প্রতিটি বিষয় নির্ধারিত হয় রাজধানী ঢাকা থেকে। এটা অসম্ভব, দুর্নীতিপরায়ণ ও অদক্ষ এক চিন্তা। দেশের সার্বিক উন্নয়নের জন্যই তাই অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে চিন্তা করতে হবে প্রশাসনকে কীভাবে স্থানীয় পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া যায়।’
বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টরের কথার সূত্র ধরে অর্থমন্ত্রী কৃষি তথা মৎস্য ও প্রাণিজ খাতে উন্নয়নের প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে বলে মন্তব্য করেন।
খাদ্যমন্ত্রী বলেন, নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে সরকার দারিদ্র্যের হার কমিয়ে আনার ব্যাপারে ব্যাপক ভূমিকা পালন করেছে। এ ক্ষেত্রে সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী কর্মসূচির নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তা ছাড়া রয়েছে কারিগরি শিক্ষা। খাদ্যমন্ত্রী আরও বলেন, উন্নত দেশগুলো আজ বাংলাদেশের সাফল্যের নানা দৃষ্টান্ত তুলে ধরছে, এটি অবশ্যই অহংকারের বিষয়।
ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, এক দশকে দারিদ্র্য কমেছে ঠিক, কিন্তু যথেষ্ট আয় না থাকা বা ক্রয়ক্ষমতা কম থাকায় মানুষ পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ থেকে বঞ্চিত। সুতরাং, আগামী দশকের মূল লক্ষ্য হবে পুষ্টি গ্রহণ। শহুরে দারিদ্র্য বাড়ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, তাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও বাসস্থানের বন্দোবস্তে মনোযোগী হতে হবে আগামী দিনে।
পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য শামসুল আলম বলেন, দারিদ্র্য হ্রাসে বাংলাদেশের ১০ বছরের সাফল্য—এক অভাবনীয় সাফল্য। বিশ্বব্যাংকের সমীক্ষাকে তাই সাধুবাদ জানান তিনি।

No comments

Powered by Blogger.