বাংলাদেশে আলেমদের অন্যায় বিচার ও নির্যাতন বন্ধের দাবি ক্রাইসিস গ্রুপের

বাংলাদেশে আলেমদের অন্যায় বিচার ও নির্যাতন বন্ধের দাবি জানিয়েছে যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংগঠন বাংলাদেশ ক্রাইসিস গ্রুপ।
গতকাল সংগঠনটির ওয়েবসাইটে দেয়া এক যুক্ত বিবৃতিতে এ আহ্বান জানানো হয়। এতে বলা হয়, বাংলাদেশ সরকার তার বিরোধীদের নির্মূলে সম্প্রতি বিচার বিভাগীয় হত্যার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। বিচারের নামে এ প্রহসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানানো হয়।

বিবৃতিতে বলা হয়, ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বাংলাদেশে সৃষ্ট মতবিরোধ নিরসনে ক্ষমতাসীন দলের সমর্থকদের দাবি অনুযায়ী নয়, বরং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের স্বীকৃত একটি পন্থা অনুসরণ করা প্রয়োজন। বিবৃতিতে বলা হয়, ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের’ আওতায় সরকারবিরোধী নেতাদের আটক করে তাদের অভিযুক্ত করেছে। আটক এসব নেতার মধ্যে বেশ কয়েকজন সুপরিচিত ইসলামিব্যক্তিত্ব রয়েছেন। সরকারের চাপের মুখে এই ট্রাইব্যুনাল ইতোমধ্যেই আটক ইসলামি নেতাদের মৃত্যুদণ্ড প্রদান শুরু করেছে। ট্রাইব্যুনালের সমালোচনা করে ইতোমধ্যে বিবৃতি দিয়েছে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ও আইনবিদদের সংগঠন।

বিবৃতিতে বলা হয়, বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন আওয়ামী সরকার ৪২ বছর আগে দেশটির স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ এনেছে আটক নেতাদের বিরুদ্ধে। কিন্তু তারা তাদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ অস্বীকার করে নিজেদের নির্দোষ দাবি করেছেন। ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য জাতিসঙ্ঘের অধীনে একটি নিরপেক্ষ ট্রাইব্যুনাল গঠনের জন্য আমরা দাবি জানাচ্ছি।

জনতার শাসন : বিবৃতিতে আরো বলা হয়, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে সরকার বেশ কয়েকজন বিরোধী নেতাকে নির্মূলের চেষ্টা করছে। সম্প্রতি একজন মন্ত্রী ঘোষণা করেছেন, ১৪ জন বিরোধী নেতাকে ফাঁসি দেয়া হবে এবং কেউই তা বন্ধ করতে পারবে না।

মন্ত্রীর ওই বক্তব্যের পরই সরকারি দলের সমর্থকেরা ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন নেতাদের মৃত্যুদণ্ডের দাবিতে শাহবাগ মোড়ে অবস্থান কর্মসূচি শুরু করে। তারা জনতার শাসন কায়েমের দাবি জানাচ্ছে। কথিত এ গণদাবির কথা উল্লেখ করে (যদিও বিরোধীদেরকে এ ধরনের কর্মসূচি পালনের সুযোগ দেয়া হচ্ছে না) সরকার গত সপ্তাহে আবদুল কাদের মোল্লাকে ট্রাইব্যুনালের দেয়া যাবজ্জীবন কারাদণ্ডকে মৃত্যুদণ্ডে পরিণত করতে ট্রাইব্যুনালের প্রশ্নবিদ্ধ আইনকে সংশোধন করেছে।

বিচারের নামে প্রহসন : আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আসলে কী ধরনের আদালত তা ইতোমধ্যেই উন্মোচিত হয়ে গেছে। এটি আসলে একটি ক্যাঙারু কোর্ট যা বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে কাজ করছে। গত বছর ডিসেম্বর মাসে ইকোনমিস্ট তার এক প্রতিবেদনে রাষ্ট্র, ট্রাইব্যুনালের প্রধান বিচারক (পরে যিনি পদত্যাগ করেন) ও প্রসিকিউশনের মধ্যে আঁতাতের বিষয়টি প্রকাশ করে দেন।

আসামিপক্ষের সাক্ষী ও আইনজীবীদেরকে সব সময় ভয়ভীতির মধ্যে রাখা হয়েছে। এর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ঘটনা হচ্ছে গত বছর ৫ নভেম্বর আসামিপক্ষের গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী সুখরঞ্জন বালিকে ট্রাইব্যুনালের গেট থেকে পুলিশের বিশেষ শাখার লোকজন ধরে নিয়ে যায়। এর পর থেকে তাকে আর দেখা যায়নি এবং অপহরণ করা হয়েছে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে।

আন্তর্জাতিক নিন্দা : আন্তর্জাতিক সুশীলসমাজের সংগঠনগুলো শুরু থেকেই বলে আসছে যে, আন্তর্জাতিক রীতিনীতির প্রতি কোনো রকম শ্রদ্ধা না দেখিয়ে এই বিচারকার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। বাংলাদেশ সরকার নিজেকে গণতন্ত্রের কাঠামোয় একটি ধর্মনিরপেক্ষ উদার সরকার হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু এই সরকারের কার্যক্রমে উদারতার কোনো স্থান নেই।

যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধাপরাধসংক্রান্ত রাষ্ট্রদূত স্টিফেন র‌্যাপ, ব্রিটিশ পার্লামেন্টের মানবাধিকারবিষয়ক গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান লর্ড অ্যাভেবুরি, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, জাতিসঙ্ঘ মানবাধিকার কমিশনসহ বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন, ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ট্র্যানজিশনাল জাস্টিস, ইন্টারন্যাশনাল বার অ্যাসোসিয়েশন, যুক্তরাজ্য বার অ্যাসোসিয়েশনসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের আইন ও বিধিবিধান নিয়ে ইতোমধ্যে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।

নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় লেখা এক মতামত কলামে আইনজীবী জন কামেগ লিখেছেন, ‘সার্বজনীন ন্যায়বিচার ও জবাবদিহিতার আদর্শকে কিভাবে অপব্যবহার করা যায় তার ভয়াবহ সতর্কবার্তা দিচ্ছে এই ট্রাইব্যুনাল।

গত বছর তুরস্কের প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ গুল বাংলাদেশের প্রেসিডেন্টের কাছে লেখা এক চিঠিতে অধ্যাপক গোলাম আযমসহ অন্য ইসলামি ব্যক্তিত্বদের মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের জন্য বাংলাদেশের প্রতি আহবান জানান।

ট্রাইব্যুনাল বাতিলের আহবান : বিবৃতিতে বলা হয়, রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত এই প্রহসনের বিচারের সমর্থকেরা যুক্তি দেখান যে, ১৯৭১ সালের যুদ্ধের নির্যাতিতরা বিচার পাওয়ার দাবি রাখে। কিন্তু আমরা মনে করি এই বিচার হওয়া উচিত ন্যায্য ও সুষ্ঠু পন্থায় যা বর্তমানে অনুপস্থিত। যদি যথার্থপ্রক্রিয়া অনুসরণ না করে অধ্যাপক গোলাম আযম, মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী, মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মতো ইসলামি ব্যক্তিত্বদের বর্তমান বিচারের এই পুরো প্রক্রিয়াটিই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং সুস্পষ্ট স্বার্থ হাসিলের জন্যই এটা করা হচ্ছে। আমরা জাতিসঙ্ঘ ও আন্তর্জাতিক সমাজের প্রতি আহ্বান জানাই আর বিলম্ব না করে এই বিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর জন্য।

বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেছেন আনাস আলতিকরিতি ব্রিটিশ মুসলিম ইনিশিয়েটিভ, ওয়ার্ল্ড মুসলিম সলিডারিটি কমিটি, সেভ বাংলাদেশ, ইউকে ইসলামিক মিশন, ওয়ালিদ সাফুর-সিরিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিটি, ইসলামিক ফোরাম অব ইউরোপ, ফুয়াদ নাহদি- রেডিক্যাল মিডল ওয়ে, জমিয়ত উলামা সাউথ আফ্রিকা, ড. ওমর আল হামদুন মুসলিম অ্যাসোসিয়েশন অব ব্রিটেন, ফেডারেশন অব ইসলামিক অর্গানাইজেশনস ইন ইউরোপ, ইসমাঈল প্যাটেল-ফ্রেন্ডস অব আল আকসা, পাকিস্তান ইয়ুথ অ্যান্ড কমিউনিটি অ্যাসোসিয়েশন, ড. দাউদ আবদুল্লাহ-মিডল ইস্ট মনিটর, ইন্দোনেশিয়ান টাস্ক ফোর্স ফর বাংলাদেশ, মজিদ আলজির প্যালেস্টিনিয়ান রিটার্ন সেন্টার, ইয়ং মুসলিম অর্গানাইজেশন ইউকে, রোহিঙ্গা মাইনরিটি ক্রাইসিস গ্রুপ, মুসলিম ডাইরেকটরি ইউকে, মালয়েশিয়ান টাস্কফোর্স ফর বাংলাদেশ, দাওয়াতুল ইসলাম ইউকে অ্যান্ড আয়ার, প্যালেস্টিনিয়ান ফোরাম ইন ব্রিটেন, ব্রিটিশ সলিডারিটি ফর সিরিয়া, মুসলিম ইয়ুথ অব মালয়েশিয়া, ওমর আলী ফেডারেশন অব স্টুডেন্টস ইসলামিক সোসাইটিস, শ্রীলঙ্কা ইসলামিক ফোরাম-ইউকে, মাসুদ শাহজারাহ-ইসলামিক হিউম্যান রাইটস কমিশন, ড. আহমদ আলি বাসিক-সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড স্টাডিজ সারায়েভো-বসনিয়া, মুসলিমাত ইউকে।

No comments

Powered by Blogger.