টুকা কাহিনী by বুলবুল চৌধুরী

নিড়েনের দরকার ছিল না। শিম দিয়েছে মাচানে, লকলকে ডগা মাচানের দিকে মাথা দিয়েছে মাত্র, ওপরের অংশের নাগাল পেতেও দিন কয় যাবে। তবুও টুকা ভোর ভোর থেকেই নিড়ানি হাতে বসেছে।


ঘাস বলতে ফাঁকা ফাঁকা বাদাইল্লা_একদম মূল থেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তুলে ফেলতে হয়। নইলে আবার গজায়! রোদের তেজে মরে না, কেটে দিলেও গজায়। সে কাজ করছিল ধীর। এক-একটা ঘাসের মেটে রঙ ও চুলের মতো পাতলা শিকড়ও খুঁজে খুঁজে বের করছিল। আর অত ভোরে মায়মুনা মাচানের কাছে, নিমের ছায়ায় যে ভেজা ভেজা পাতকুয়া আছে, সেখানে কলসি ভরতে এসে নিচু হয়েই দাঁত কামড়ে ধরল, হায়া নাই, মানুষডার হায়া নাই। মাগো, একগা তফন পিনলে কি অয়?
বস্তুত টুকা একফালি কাপড়ের লেংটি পরেই নিড়ানি হাতে বসেছিল। খাটো মানুষ, মাথার চুল যথাসম্ভব ছোট করে ছাঁটা। গোলগাল মুখ তেল চকচক করে, ফোলাফাঁপা পেট_টুকার পেট এরকমেরই থাকে, সেরেক চালের ভাত খেলেও, দু'দিন অভুক্ত থাকলেও। যদি আলো-আঁধারিতে সে কোথাও গাঁট মেরে বসে থাকে, তাহলে মানুষ বলে ঠাউর করা যায় না। ঠাউর হয়, কেউ গোবর-পচা বা কোনো আবর্জনা কোদালে কুপিয়ে, পাতিতে বয়ে এনে দু'এক পাতি ফেলে রেখেছে।
কাকগুলো এখন উড়ে যাচ্ছে গৃহস্থ বাড়ির দিকে। পাখিও এই ডাল, সেই ডাল ওড়াউড়ি করে সারারাতের থির থাকা অবস্থাটা কাটিয়ে দূরের দিকে উড়ে যাচ্ছে। টুকা বুঝতে চায় না কোনটা কাক, কোনটা ঘুঘু, বা কখন ঝাঁক ঝাঁক পেঙ্গাপেঙ্গি নামবে খিলান জমিতে। মায়মুনা হয়তো পানি নিতে এসেছিল। রোজই তো আসে। এসব দিয়ে কী হবে তার? চরাচরে যা হবার হোক, সে দুপুর দুপুর নিড়েনটা তুলতে চায়। তারপর টুকা যাবে বেহুলডাঙ্গায়। ওদিকে ফসলের মরশুম আসছে। বেহুলডাঙ্গার দস্তিদার বলেছিল ছমাসের জন্যে পাকাপাকি কথা বলতে। খাবে-দাবে, কাজ যা আছে করবে, মাস কাবারি পয়সা। তা কত ধরবে টুকা? এ অঞ্চলে আশ্বিনে কোনো কাজ থাকে না। বর্ষা সেই যে তিরতির করে বাড়তে থাকে আষাঢ় থেকে, ভাদ্রে এসে ফণা দিয়ে দাঁড়ায়। অনেক সময় পানির বাড়ের সাথে আমন ফসল পেরে ওঠে না। কোনো রকমে, হাইফাই করে একটু যদি তুলতে পারে মাথা তাহলে দাবায় কে? সবুজ, পাতলা ধার ধার ধাঁচের সেই ধানপাতা নতুন ধারের কাঁচির মতো উঠতেই থাকে ওপর দিকে। যদিও আমন ফলে, ফলবে গিয়ে সেই অগ্রহায়ণে। এর আগে কাটা-থোয়া নেই ধানের। জমি বর্ষাতল বলে চাষবাসও নেই। কাজও নেই তাই। অগত্যা টুকা বেহুলডাঙ্গা যাবে।
সে কাজে আরও দ্রুত হয়ে উঠেছিল। এদিকে বৃষ্টিরও নষ্ট মাথা। কখন না জানি নামবে এমনই ঢল যে, জোয়ার সেই বৃষ্টি পেয়ে কাছিমের মতো মাথা, পা বের করে ভিটেবাড়ির দিকে এগিয়ে আসবে।
পূর্ব-পশ্চিমের পালা তুলে টুকা যেই না ঘুরে পশ্চিম-পূর্বের পালা শেষ করছিল, তখন দেখল আইনুল আসছে মাছের রাশ মাথায়। কাছাকাছি হয়ে আইনুল বাঁ হাতে টুকার দিকে আধ-খাওয়া বিড়ি এগিয়ে দিল, টুকা কা, খাও। অবেইলডায় নিড়েন দেও কেরে?
অবেইল কই, ঘাস অইছে, দেহছ না, বাদাইল্লায় কেমুন জোর চাইতাছে?
তোমার যেমুন কাম! আরে, উষী অইছে জোঙ্গলা গাছ। হেমুন নিড়েনের কি আছে?
হ, তয় মার না, হেজাডা মার না, মাস কয় ধইরাই না জ্বালাইতাছে।
আসলেও, সজারুটা মাস দুই থেকে জ্বালাচ্ছে। মাচানের কুমড়ো কাটছে, ঢেঁড়শ গাছের ডগা কাটছে, কলা, বেগুন কাটছে। ইনুচ মোল্লার বাঁশঝাড়ের কড়ুল সব শুইয়ে দিয়েছে সজারুটা। এ বছরের বাঁশ কি আর পাবে ইনুচ?
টুকারও একটা বাঁশঝাড় আছে। সজারুটা এদিকে আসতেও পারে। ভাবনা হয় তার। খোদা না করে...।
পোড়া বিড়ির টুকরো অংশ নিড়েন দেওয়া মাটির নিচে ঢুকিয়ে দিতে দিতে প্রশ্ন করে, কোফাই থাহে হেজারা?
আইনুল রেগে যায়, আমার চেডে জানে। বাঁশ খাইবো, তরহারি খাইবো, বিনাশ অইলে তোমাগো অইবো। আমার তো একখান বাগুন জমি। হেও লাট-পাট কইরা ছাড়ছে কবে। হেজা মারনের ঠেহা অইলো তোমাগো।
আইনুল ছুটতে যাচ্ছিল এরপর। কিন্তু দাঁড়াল। জিজ্ঞেস করল, টুকা কা, কুইচ্ছা খাইবা নিহি?
টুকার ভঙ্গিটা নির্বিকার। অথচ ভেতরে উৎসাহের শিস ঠিকই বেজে যাচ্ছে। অনেক দিন হয় কুইচ্ছা দেখে না, অনেক দিন না। আইনুলের আহ্বান পেয়ে চোখের তারায় ওই রকম লাল রক্তময় কুইচ্ছা মোচড় খায়। মোচড়ের ফলে তার চোখেও রক্ত এসে যায়। তারপর লাল হয়ে যায় সব।
খাইলে যাও, কাইল দাওন পাতছিলাম নলখাড়ির টেহের উত্তর-পশ্চিমে। গাবতলার ছিপডাত দেখবা বাইজ্জা রইছে কুইচ্ছাডা, জ্যাতা, গেলে পাইবা।
আইনুল তারপর ছুটতে থাকে। এই মাছ নিয়ে সে যাবে গঞ্জের বাজারে। বেচবে। তাই তো, সময় কোথায়!
সাথে সাথেই নিড়ানি ছেড়ে টুকা উঠে দঁাঁড়িয়েছে। নলখাগাড়ির টেকে একবার যাবে সে। কুইচ্ছা মাছটা আনতে হবে। কাজে-কামে গেলে তবেই তো গৃহস্থবাড়ির পাতে মাছ পড়ে। টুকা মাচানের বাইরে আসতেই কপালে বৃষ্টির ফোঁটা লাগল। দেখতে দেখতে যে সূর্য মুখ তুলেছিল তা-ও গেল মেঘের আড়ালে। ঝমঝম বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল সহসাই। হতচকিত টুকা গেল ঘরের দিকে। ভেজা মাথা থেকে দু'হাতে পানি কেচে এসে আকাশের দিকে বাঁ পা তুলে দেখাতে দেখাতে সে চিৎকার করে উঠল, পোংডা দেওয়া, দেহছনে, দেহছনে...।
সে এরকম বসেও আকাশকে পা দেখায়। মায়মুনা রান্নাঘরে বসে দৃশ্যটা দেখে আর স্বামীকে বলে, দেহ, দেহ তোমার ভাইয়ের কাম, দেওয়ার লগে কেমুন কাইজ্জা লাগাইছে।
একুব তা ঠিকই শোনে হয়তো। কিন্তু পর মুহূর্তে কিছু মনে থাকে না।
বৃষ্টি থাকলই। অস্থির টুকা ভিজতে ভিজতে বেরিয়ে গেল নলখাগাড়ির টেকের দিকে। ছিপটা পাতা আছে গাবতলায়। বড়শি গিলে কুইচ্ছাটা মোচড়াচ্ছে_না ছুটলেই নয়।

দুই
ভাত চড়িয়েছে টুকা। ধোঁয়া উঠছে খুব। বৃষ্টি হচ্ছে তুমুল। হাওয়া আরও খারাপ হচ্ছে। ভারী ভারী মেঘখণ্ড জেঁকে বসেছে। এই মেঘ থেকে বৃষ্টি গড়াবেই। দুর্যোগ আক্রান্ত হবেই মানুষ। নতুন চাঁদ ছিল মেঘকুড়োলি। তার মানে ঝড়-তুফান হবে, বৃষ্টি হবে, অন্ধকার হবে এরকম ভেবে টুকা যা যা জানা আছে গালাগাল, এক প্রস্থ, দুই প্রস্থ করে সেরে ফেলেছে। তারপর চুলায় আগুন চড়াবার জন্যে কাঠ গুঁজেছে। দু'মুঠো তুষ ছিটিয়ে কাটাকুটি সারছে এখন সে। দু'পায়ের ফাঁকে ফাঁকে দু'হাঁটুর প্রান্ত দিয়ে হুঁকাটা চেপে ধরে বেদম টানতে টানতে সে ছাই মাখাচ্ছিল কুইচ্ছাটায়। মরেনি মাছটা। জোর খাটাচ্ছিল। পিচ্ছিল বলে ছাইও নিতে হচ্ছিল বেশি বেশি। বড়শি থেকে ছুটিয়ে আনবার সময় মুখ থেকে সেই যে রক্ত বেরোনো শুরু হয়েছে গলা কাটবার সময় তা এখন অধিক ধারায় বইছে। বাইন মাছের মতো লম্বা, অই রকমই গড়ায়-চড়ায়, কাঁটা নেই, নরম মাছ। রঙটা জমাট রক্তের মতোই, আসলে পুরো কুইচ্ছাটাই জমাট রক্ত, চোখ দুটো বাদে। মুখটা বেলে মাছের মতো ভোঁতা। মানুষজন সাধারণত খেতে চায় না। বলে, এই সব যে খায়, তার লাগি হাপ-ব্যাঙও ফরজ।
রক্তটা দেখবে না, দেখবে না কি নরম তেলতেলে, আর স্বাদ যে সেই মাথার তালুতে গিয়ে ঠেকে?
বঁটি দিয়ে মাথা আলগা করার সময় গলগলিয়ে রক্ত এসে হাত ভেজালো, বঁটি ভেজালো, মেঝেতে গড়িয়ে পড়ল ফোঁটায় ফোঁটায়। আত্মতৃপ্তিতে টুকা গালাগাল দিল, ওই হালারা ওই, খাইতে ঘিন করে, না? তরা ঘিনে মরস? এমুন লউ দেখছসনি? দেখছস...?
ভাতের বলক আসার আগে আগেই তার ধোয়ার কাজ শেষ হয়ে গেল। বাটনা নেই। মায়মুনাকে যে ডাকবে তার উপায় কী? এই বৃষ্টি ভেঙে ও আসবে কি না টুকা জানে না। হঠাৎ শূন্যতা বোধ করল সে। আর একবার তামাক সেজে বসল। দুয়াগরির ফাঁক দিয়ে আকাশ দেখতে দেখতে ভাবল, বেহুলাডাঙ্গায় যাওয়া পিছোবে নাকি? ক'দিন থাকবে দুর্যোগ?
চুলো জ্বালাবার খড়িকুটোও ফুরিয়ে এসেছে। টুকা চুলোর ভেতর তুষ ছিটিয়ে জ্বালটা ধরে রাখছিল। পায়ের শব্দে মুখ ফেরাতেই দেখল মায়মুনা তার পেছনে। ভরা শরীরের কালো মেয়ে, জোয়ান মরদের মতো চলে, চোখটাই শুধু কেমন আলো দেয়, তা কালো না আলোময়, না কেমন বলা মুশকিল।
ভিজে কাপড় নিংড়াচ্ছিল ও। টুকা মুখ বাঁকাল, তরে ডাকছে কেডা?
মায়মুনা হেসে শরীর দুলিয়ে কাছে বসতে বসতে বলল, আইলাম। না আইলে বাডনা বাইড্ডা দিত কিডা?
তখন তখনই নরম হয়ে উঠল সে।
মায়মুনা গো, বাডনা বাইড্ডা দিবি?
মায়মুনা টুকার দিকে দু'চোখ তুলে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, কার লগে তোমার কাইজ্জা হুনি? ঘরে কেউ থাকলে না? তয় কারে তহন এমুন বকাঝকাডা করলা?
টুকা আরও নরম হয়ে যায়। এরকম করে তাকে জিজ্ঞেস করত কে একজন, কে না ছিল, কে না বলত, উক্কডা ভইরা দিমু? কামলাত গিয়ে কিদ্দা খাইছো?
আকাশের দিকে দেখাতে দেখাতে টুকা বুঝিয়ে দিতে চায় ঝগড়াটা কার সাথে ছিল। কিন্তু শব্দ করতে পারে না। তার বুকের ভেতরে টুকিনির জন্যে কোথায় যেন দরদ টনটন করে ওঠে। সে অস্ফুটে ডাকে, দে, বৃষ্টি দে। দে, ডুবিয়ে দে। দে বন্যা দে। বৃষ্টি বন্যা মিলে যা, আমি আর পারি না।
তামু খাইবা?
ভাই-বৌয়ের এই প্রশ্নে টুকা অবোলভাবে মাথা নাড়ে।
কী ছান রানবা?
এবার সে একটু জড়িয়ে পেঁচিয়ে যায়। মায়মুনা কুইচ্ছা দেখলে সরে যাবে। কিন্তু লুকানো ছাপানো যাবে না ব্যাপারটা। সে তবুও, এ যেন স্বীকৃত মাছ, এ সবাই খায় এরকম একটা ভাব নিয়ে বলল, কুইচ্ছা আনছি। দোপেজি করমু। পিয়াইজ লইছি। রউন লইছি। ঝালডাও দিমু।
মায়মুনা কিন্তু কিছু বলল না। আর দিনের ঘৃণাটাও দেখা গেল না মুখে। জিজ্ঞেস করল, টুকিনি খাইতনি কুইচ্ছা?
টুকিনি? টুকা মাথা নাড়ায়। আহা! সেই বছরে বর্ষা হয়েছিল, জমি তল হলো তাতে, ভিটেবাড়িতে জল, কারো কারো ঘরেও ঢুকেছে জোয়ার। মানুষজন গাছপালার ডালায় মাচান বেঁধেছে, সরকার রিলিফ দিচ্ছে গঞ্জে।
টুকাও গিয়েছিল রিলিফের আশায়। ফেরার পথে কালীতলার বটগাছের নিচে একটা মেয়েমানুষকে বসে থাকতে দেখল জড়োসড়ো। সন্ধ্যার প্রলেপ নেমেছে চারদিকে। গাছপালাও ঘোমটা-ঢাকা হয়েছে। টুকার ডরভয় চিরদিনই কম। এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, তুমি মানু না গো?
জবাব নেই।
বাড়ি কই? যাইবা কোফাই গো? কইলে আগগাইয়া দিতাম।
অন্ধকারে সে ধরতে পারে না কেমন মেয়েমানুষ, বিয়ে হয়েছে কি হয়নি, ঘরপালানো বউ না বর্ষা ভিটেছাড়া করেছে, কোনটা? কিন্তু ঘোমটা-ঢাকা মেয়েমানুষটা কোনোভাবেই নড়ে না।
ক্ষেপে গেল টুকা। ওর সামনে হাঁটু ফেলে বসতে বসতে খেঁকিয়ে জানতে চাইল, আমার লগে বিয়া বইবি?
ব্যস, নড়েচড়ে উঠল মেয়েমানুষটা। হাতে ছিল কাচের চুড়ি। হাত নাড়তেই তা বেজেও উঠল।
তরাল ঘাটে এসে টুকা ভাইকে ডেকেছিল, পার কর ও, ও-ও-ও ভাইয়ে, পার কর ও...।
ডোঙ্গা নিয়ে ভাই গিয়েছিল তাকে পার করতে। তিলিছমাতি অন্ধকার। জলে, মানুষে, গাছে, মাটিতে, সব একাকার। তা-ও বুঝল, ছোট ভাই একা নয়। সাথে কেউ আছে।
ডোঙ্গায় টুকার সামনে বসল মেয়েমানুষটা। গুটিগুটি, পোঁটলার মতো অবস্থা। মৃদুমন্দ পানির ছলক কেটে কেটে ডোঙ্গা যখন পারাপারের মাঝ-পথে এলো তখন বড় ভাই একুব জিজ্ঞেস করল, লগে কেডা রে?
বউ। লইয়া আইলাম, কালীতলা বটগাছের তলায় বইয়া আছিল।
তখন একুবও বিয়ে করেনি। বড় ভাই দৌড়ে গিয়ে মোন্তার মাকে ডেকে এনেছে। ছোট ভাই কী কাণ্ড যে করল। এখন বউ বরণ তো করতে হয়।
মোন্তার মা কুপির আলোয় বউয়ের মুখ দেখতে দেখতে জিজ্ঞেস করেছিল, কী নাম গো? বাপের নাম কী? কোন ভিডায় ঘর?
সেই অবস্থা, কথা নেই।
টুকাও রেগে গিয়েছিল, বোবানি?
না পেরে পেরে জিজ্ঞেস করতে করতে যখন আর পারা যাচ্ছিল না, তখন মোন্তার মা বলেছিল, থাকদে রে টুকা, তর বউয়ের নাম যহোন নাই, তহোন আয় আমরা নাম দেই টুকিনি।
টুকার বউ সেই থেকে টুকিনি হয়ে গেল। মায়মুনা ভেতরের অত অত ইতিহাস জানে না। একুব তো মাস পাঁচেক আগে প্রথম বউ তালাক দিয়ে মায়মুনাকে আনল তেলচুবানির ঘানিবাড়ি থেকে।
ভাতের পাতিল ইতিমধ্যে নামিয়ে দিয়েছে মায়মুনা। বাটনা পিষছে এবার। টুকা খানিক নড়েচড়ে বসতেই তার দিকে ফিরল। বলল, আইজ নাইলে বাডনা বাডলাম, হগল দিনডাক কেডা আইয়ে? কোন দোষে বউডারে ছাড়লা অহনও বুঝলাম না কিন্তুক?
কালো শরীর মায়মুনার। ভরা যৌবনা। এই মুহূর্তে কণ্ঠও কেমন আর্দ্র মনে হয় টুকার কাছে।
মায়মুনাকে সে কী বলবে নিজের বউয়ের কথা? টুকিনি তাকে শীতকালে ওম দিয়েছে, গরমকালে চুলের বিলির ভেতর দিয়ে ঘুম দিয়েছে, বেঁধে-বেড়ে খাইয়েছে। টুকা কুইচ্ছা খেত, সে জন্য টুকিনি নাক সিঁটকাত না। একই পাতে টুকার সাথে ভাত খেয়েছে ও। কিন্তু দোষ ছিল টুকিনির। কারো বাড়িতে গিয়ে সুযোগ পেলেই, মরিচটা, পেঁয়াজটা সরাত। মালনবাড়ির মোন্তাজ এক ধর মিষ্টি আলু কিনে এনেছিল হাট থেকে। তিন ভাই ভাগাভাগি করতে গিয়ে মাপ দেবার সময় দেখে ধর মেলে না। নিল কে?
টুকিনি গিয়েছিল মোন্তার বউয়ের কাছে পান চাইতে। কাপড় ঝাড়তেই ওর কাছে আলু পাওয়া গেল।
সেই রাতে টুকা কষে মেরেছিল বউকে। ভোররাতে উঠে বাইরে যাবার সময় দেখল টুকিনি তো নেই। ওকে পাওয়া গেল না আর কোথাও। সেই সব কথা কতকালের পুরনোই না।
বাটনা বাটতে বাটতেই মায়মুনা ফিরে ফিরে দেখছিল টুকাকে। বলল, আমি কইলাম কুইচ্ছার ছান রানতাম না। মাগো, এইত্তা মাইন্নে খায়? হঁ, তোমার লাগি টুকিনিই উচিত আছিলো। অহন তোমারে বউ দিবো কেডা? কুইচ্ছা খায় মাইন্নের লগে মাইয়া দিবো কোন বাপে?
টুকা ঘরের চারদিকে দেখে। লেপ-পোছ দেয়া ঘর। মা বেঁচে থাকতে সেই যে ঘর সাজিয়ে দিয়ে গেছে_ঘরের কোণে কোণে শিকা ঝুলছে, কলস ঝুলছে, পাতিল ঝুলছে শিকায়, এর সবই মায়ের হাতের সাজানো। মায়ের খুব লেপ-পোছ দেয়া, ঘর-আঙ্গিনা ছাফ-ছোফা রাখার অভ্যাস ছিল। টুকাও মায়ের মৃত্যুর পর কোনো শিকার বাঁধ খোলেনি, কোনো শিকার কলস বা পাতিল সরায়নি। হুবহু রেখে দিয়েছে। শুধু কলস-পাতিলের চাল, সদাইপত্র বদেলেছে। মূল নড়েনি। টুকিনিও ওগুলো নাড়ায়নি। শুধু দেয়াল মেঝেতে নিত্য নিত্য লেপ-পোছ বদলেছে। এসব দেখতে দেখতে টুকা আনমনে হাসল। চুলোর ভেতর অনর্থক একগাদা তুষ ছিটিয়ে দিয়ে বলল, মায় বাইচ্চা থাকলে বউয়ের কি কাম আছিলো, ঘরডাত এত্তো হাজের লেপ-পোছ দেহছ না, হাজগোছ দেহছ না, বেবাক মায় কইরা থুইয়া গেছে। জব্বর সাইরের আছিলো আমার মায়, জব্বর সিজিলের আর সোন্দর আছিলো...। তুই দেহছ নাই, হালার নায়েবে গাইরত করলো আমাগো। কৌশল কইরা মায়েরে ছাড়ান লওয়াইলো।
মুনা এসব গল্প অনেক শুনেছে স্বামীর মুখে। শাশুড়ি ছিল সুন্দরী। শ্বশুর ছিল অকাজের লোক, কুৎসিত-দর্শন। বউকে ধরে পেটাত রোজ রোজ। প্রতিবেশী ভিড় জমাত দৃশ্য দেখতে। অবস্থা দেখে নায়েব ছাড়ান নিয়ে দিয়েছিল মেয়েলোকটার। এটা কি নায়েবের দোষ?
বাটনা বাটা শেষ করে মায়মুনা হাত ধুয়ে বলে, অহন তাইলে যাই, তোমার ভাইয়ের রান্দন বওয়ান লাগবো। জানো না কোন তাছিরের মানুষ। দেরি দেখলে আবার কুদ পাড়বো।
মায়মুনা বেরিয়ে যেতেই টুকা পাতিল টেনে নিল। চুলা জ্বালল। কুইচ্ছার ছান রাঁধবে এবার।
চুলোয় জ্বাল দিতে দিতে তার চোখ পড়ল ঘরের উত্তর কোনায় কুনো ব্যাঙটা লাফাচ্ছে দেয়ালের দিকে মুখ করে। যেন আরও উঁচুতে উঠতে চায়। সে হঠাৎ ক্ষেপে গেল। ব্যাঙটাকে সে একদিন বাইরে ফেলে এসেছিল। আবার জায়গামতো এসে বসেছে। টুকা লাঠি খুঁজল, হালার ব্যাঙ, রাহছনে, তবে পাইছি, আতুরি-লুদরি দেইহা ছাড়মু...।
কিন্তু উঠে একটা লাঠি খুঁজবার মন হলো না তার।

তিন
আকাশ ঢল ছেড়েছে মাটির পৃথিবীর দিকে। গাছপালা, ঘরবাড়ি, জলা জমি এই বৃষ্টির তোড়ে মারাত্মক জোয়ার-ভাসাই হবে যেন। টুকা শুনছিল মেঘ-গর্জন। বিদ্যুৎ চমকায় কি এক-একবার! আকাশের খ্যাপা নাচন শুরু হতেই কাছে একটা ডাল মড়মড় শব্দে ভেঙে পড়ল। কার না কার ঘর-দোরের চালা উড়ে কই কই যে যাবে কে জানে। মানুষজনের বিপদই দেখি।
কী করবে সে, মায়মুনাকে ডাকবে? বলবে, সাবধানে থাক মায়মুনা। ভাইয়েরে ক'। বিপদ আছে।
হঠাৎ করেই টুকা হতবুদ্ধি হয়ে পড়ে। নিরুপায় ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়ায় সে। ঘরের এই কোণ, ওই কোণে যায়। বান-বাতাস কি চালা উড়িয়ে নেবে? তারপর থির করে নিজেকে। চারদিকে ঘুরে ঘুরে দেখে, ঘরের চালার বাঁধন শক্ত আছে কি না। দড়ির বাঁধ শেষ করে দেওয়া হয়েছিল, বাঁশের পালা বদলেছিল কবে!
কিছুক্ষণের ভেতর বোল পাল্টাল আকাশ। কালো মেঘ ছুটতে ছুটতে উত্তরে গেল। মেঘ-গর্জন থামল। বিদ্যুৎ যা চমকাচ্ছিল তা-ও বড় অলস, অসহায় এখন। গাছগাছালি মৃদু বাতাস দিতে শুরু করল। সূর্য একটু তাকাবে কি? তা তাকাল না, মুখই দেখাল না। শুধু একটা ছটা এলো সূর্যের, আকাশের নীল নীল স্তর পেরিয়ে সেই ছটায় পরিষ্কার হয়ে উঠল চারদিক।
মায়মুনা ছাগলকে পাতা দেবে বলে কাঁঠালের ডাল ভাঙতে এসেছিল। ফেরার পথে টুকার ঘরের দিকে উঁকি দিতে ভুলল না। আগ বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, কী করতাছো?
তামু খাই।
টুকা হুঁকা দেখাল।
মায়মুনা বিদ্যুতের অলস, অসহায় অবস্থার মতো একটু হাসল, কামলা যাইবা কবে?
দিনডা ভালা গেলে কওন যায় না, কাইল বিয়ানেই রওয়ানা হইয়া যামু বেহুলডাঙ্গা। কদ্দুরা বছনে মায়মুনা। কথা কই।
অইছে, আমার কাম নাই? চুপি মাইরাও আমার ঘরডা দেহ কোনো সোময়ে? ক্যান, আওয়াজ পাও নাই? তোমার ভাইয়ে কাইল রাইতে কেমুন মুঙ্গইরা পিডা করছে আমারে। আর অহন তুমি কও বইতাম? মরদ? হের কিছু করতে পারলা না কোনোদিন? কত্ত দেখলাম পুরুষ।
কেরে মারছে?
বুঝতারো না?
টুকা মুখ হাঁ করে রেখে মাথা নাড়ে।
তোমার ভাইয়েরে তয় জিগাইও।
মায়মুনা কাঁঠালের পাতা ভরা বুকের সাথে জাপটে ধরে চলে গেল।
টুকার আজ যা হচ্ছে তা যেন কখনও হয়নি। বুক উদোম হচ্ছে। লেংটি পরা টুকার মতো হয়ে যাচ্ছে টুকা। মাথার চুল ছোট করে ছাঁটা, পেটটা ফোলা-ফাঁপা, তেল কুচকুটে কালো টুকা। কামলা খাটে বাড়ি বাড়ি, কান্দা কয়েক জমি আছে, শিমটা, কুমড়োটা ফলায়। বাঁশ ঝাড়টায় বছরে বিক্রি ওঠায় একবার। ঘর আছে, ঘর আগলাবার মানুষ নেই তার।
মায়ের কথা টুকার মনে হয়। বাবার শরীরে ছিল পাঁঠার গন্ধ। টুকা বাবার শরীর পেয়েছে। নোলক পরা, ঘোমটা ঢাকা, লাল শাড়িতে মা, পাতলা আঙুলের মা, আর কী রক্ত ছলকের ছিল যে। টুকার আদর ছিল, টুহা রে!
মায়ের কোলে মাথা রেখে টুকা ঘুম যেত। তার মামাবাড়ি আরিন্দাপুল। টেক জঙ্গলের জায়গা, আম-কাঁঠালের জায়গা, মুলি বাঁশের জায়গা। বৈশাখে টুকা আর মা যেত মামাবাড়ি। দুধে, আমে, কাঁঠালে টুকা হাপুস-হুপুস।
বেঁচে থাকতে মা কতদিন ছেলেকে টেনে নিয়েছে কোলে। মাথার চুলে হাত বুলোতে বুলোতে প্রশ্ন করে, টুহা রে, আরিন্দার পুল যাবি? ল, পলাই, তর বাপে জব্বর হুয়র। আমারে খালি পিডায়।
এখনো অদৃশ্য হতে মায়ের সে ডাক মাঝে মাঝে আসতে শোনা যায়। বাবা ছিল গঞ্জের পাটঘরের ওজনদার। মাকে বাবা মারত কেন? মা এক-একদিন টুকাকে পিঠের কাপড় তুলে দেখাত। কুচবরণ মা, রক্তের চলাচল সবখানে_ফাঁকে ফাঁকে টানা টানা লাঠির ঘা। তা হুঁকার গজের মতো কালো কালো আর কী নির্মম।
টুকার গা শিউরে ওঠে। জ্বরগ্রস্ত রোগীর মতো সে যেন প্রলাপ বকে, মাগো, ওমা। আরিন্দাপুলে কবে না জানি তোমার লগে শেষ ঘুরনডা দিলাম? তারপরে তুমিও নাই, মামারেও কি আর দেখলাম?
টুকা নুয়ে আসে। তারপর যেন কাটা মুরগির মতো, কাটা গরুর মতো স্থির চোখের হয়ে যায় সে।
সন্ধ্যা আসে আলতো পায়ে, মা যেমন বোল্লা খড়ম পায়ে শব্দ না করে ঘর থেকে ঘরে যেত_অই রকম শব্দ না করে এগোতে এগোতে সন্ধ্যাটা তার চোখ-মন ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে গেল।
মা থাকলে এই হাইনজায় বাতি দিত। ঝকঝকে তেলের কুপিটা শিষ দিয়ে আলো ছড়াত।
টুকিনিও গেল। মা তো এত পিটুনি খেয়েও যেতে চায়নি। তালাক দিতে রাজি না হওয়াতে সেবারে নায়েব বাবাকে লোক লাগিয়ে খুব মার দিল। বাবার কাছ থেকে মায়ের তালাক নেয়া হলো তার কদিন পরপরই।
কবেকার না কবেকার ঘটনা। আরিন্দাপুলের পথও মনে নেই টুকার। সেই যে কবে গিয়েছিল বাগাডুলির বৈষ্ণবপাড়া, বৈষ্ণব-বৈষ্ণবীর গান, তারও পরে খেয়া পারাপার_তারও পর?
বড় একা জীবন তার। মা নেই। বউটাও পালিয়ে গেল। সে বিড়বিড় প্রশ্ন তোলে, মায়মুনা গো, মায়মুনা, আরিন্দার পুলডা কোফাই, কইতে পারস? ভুইলা গেছি। ভাইয়েরে জিগা দেহি। পথ ভুল করছি মোনে লাগে। হেই কবে গেছিলাম মা'র লগে।
অস্পষ্ট অন্ধকার, ব্যাঙের ডাক, বাতাসের একটু নাড়া_সব, সব কিছুর মধ্যে টুকা অবলীলায় ঢুকে যেতে যেতে শুনল কেউ যেন তাকে ডাকছে।
কেডারে? কেডা, আমারে ডাহছ কেডা?
সে উঠতে পারে না, দাঁড়াতে পারে না। আবারও সেই ডাক, টুকা কা, ও টুকা কা, যাইবা নি?
আইনুল আইছস?
আরে দেখছনি কেমুন গুঁড়ি গুঁড়ি মেঘ। লও যাই। নলখাগাড়িত বহুতগুলান দাওন পাতছি। এমুন দিনে মাছে তো লারগোর পাইছে, ধরবোও জবর। ঘরে বইয়া বইয়া কি অইবো? উঠবানি তয় একবার?
যাইতে কস?
হ। যাইবানি? গেলে কয়ডা মাছ দিতাম পারি। কুইচ্ছাডা স্বাদ অইছিলনি? গেলে হেও পাইতে পারো। মাছ গিলতে গিয়া ছিপে কুইচ্ছা আটকায় এক-দুইডা।
আইনুল রে?
কও।
তর ছিপে জাগুর ধরে না?
হঁ? রাইতে রাইতে এক-দুইডা কি না পাই আর?
পাইলে আমারে একগা দিছ। সুরা খাইতে জব্বর স্বাদ।
টুকা বলল, ঠিক, কিন্তু সে চাইছিল একটা কুইচ্ছা যদি দাওনের বড়শিতে আটকায়। আর একটা কুইচ্ছা। তাহলে সেটাও রাঁধবে সে। বৃষ্টি থাকুক। আর এদিন দেরি করে দস্তিদারের বাড়ি গেলেই-বা কী? মাস কাবারির কাজটা ছুটবে না তাতে। সে জবাব দেয়, তুই যা। আমি ঘরের হাডর ভাইঙ্গা বেশি রাইতে মেলা দিমু।
আইনুল চলে গেল। সে এখন গিয়া ছিপ-বড়শিতে আধার দেবে। টুকা সাথে গেলে কথাও শোনা হতো, মাছও তোলা হতো। নলখাগাড়ির অত বড় টেকটার চারদিকে থৈ থৈ পানি আর মাছে টাবুস-টুবুস উয়াস সবখানে।
চুলো জ্বলে। ইতিমধ্যে টুকা হুঁকা খায় দুবার। তারপর খাওয়া-দাওয়া সারল। কুপি নিভাল। ঘরের ঝাঁপ বন্ধ করে কোঁচ হাতে বাইরে বেরিয়ে আকাশ দেখল। নক্ষত্র আছে, একফালি চাঁদ আছে, তা-ও বেজায় একদিকে। ডুবে যাবে যখন তখন, নয়তো হালকা মেঘেরই ছাউনি হবে চাঁদের গায়ে।
ঝাঁপ বন্ধ করে বাইরে বেরোতেই শুনল ভাই-বৌ-এর গলা। ঝগড়া চলছে ঘরে। আজব মেয়ে। একুব যত রাগ দেখাচ্ছে তার চাইতেও বেশি মায়মুনা হি হি হাসছে, তোমার বাপ না মায়েরে ধইরা পিডাইত? পিডাইবা, আমারেনি হেই রহম ধইরা ধইরা পিডাইবা?
একুবেরও চওড়া গলা, ঘানির ঝি গে, তর কপালডাত জবর ফের দেখতাছি। আমার ভাত বুজি তর কপালে নেই। হোনস নাই, বেদপীর লাগি আগের বউ আমি তালাক দিছি। তর কপালেও আমি হেমুন দাগ দেহি।
কেরে গো, মারবানি আবারো? মার। আবার মার। তবুও তালাক দিও না। পিঠডা জব্বর কালা। মাইরের দাগ বইলেও না কালায় কালায় মিলাইতে পারমু।
একুব রাগে চিৎকার করে, ছেনিডা কই, ওই আমার ছেনিডা কই?
কিন্তু মায়মুনা তাতেও টলে না। হাসতে হাসতে বারবার গড়াগড়ি যায়।
বাড়িতে এলে ভাই আর ভাই বউয়ের এমন ধারা ঝগড়া টুকা অনেকই শুনেছে। তার চাইতে বড় আকর্ষণ তার আইনুলের কাছে। সেখানে গেলে একটা কুইচ্ছা পেতে পারে। তখন ঘরের ঝাঁপ আটকে বাইরে বেরোয়। শিমের মাচান ডাইনে ফেলে টুকা পশ্চিমে এগোয়। নায়েববাড়ির পুকুরপাড়ে পেঁৗছে দেখে নায়েবের ঘোড়া আগলা চরে বেড়াচ্ছে। টুকারে দেখে মুখ তুলে দেখল। অন্ধকারে অত ভালো করে দেখা যায় না।
ঘোড়াটা যেন আস্তে আস্তে ঘাড়ের কেশর ফোলাচ্ছিল, পা চালাচালি করছিল, যত না উঁচু এমনিতে তার চাইতেও খাড়া হয়ে দাঁড়াচ্ছিল। টুকা ভয়ে ভয়ে পাশ কাটালো।
খেয়াল আছে, এক বছর দত্তবাড়ির ধানের জমি রুয়ে দিতে গিয়ে টুকা আলে বসে জিরোচ্ছিল। সেই সময়ে নায়েব ঘোড়া চড়ে কোত্থেকে তার সামনে এসে হাঁক দিয়েছিল, টুকা, সর, দেহস না ক্ষেতে পানি? ঘোড়াডারে কি ভিজতে কস?
সে গা করেনি, বসেই রয়েছে।
নায়েব হঙ্কার দেয়, সরবি? নাইলে তর উপর দিয়ে ঘোড়া ছুডামু।
মা'কে তো নায়েবই ছাড়ান দিয়ে নিল। সেই কথা মনে হতেই খুন চড়ে গেল মাথায়। ভাবল, যাবে তো যাও, ঘুরপথে যাও। টুকা উঠবে না। টুকা তোমার চাহর না, তোমার বাড়ির কামলাও না। বাবার কালে তোমার নায়েবি আছিলো, খাজনা তুলতা তুমি। দিন বদলাইছে। জমিদারি নাই অহন। খাজনা তোলে সরকার।
হারামির ছাও পথ থেনে উডবি? না ঘোড়া দাবড়ামু তর উপর দিয়া? আরে, তর বাপে যে এত্ত খারাপ হেও মান্যিগণ্যি করছে আমারে।
আর তখন চোখের পলকেই কাজটা হল, লাগাম ধরে টানতেই ঘোড়া পিছপা হল, তারপরই ছুটে এসে ঘোড়াটা টুকাকে ডিঙাল। নায়েব চেয়েছিল হাতের চাবুক দিয়ে টুকাকে এক ঘা দেয়। কিন্তু লাগেনি। লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে বাতাসে তা ঘা খেয়ে স্যাৎ করে দীর্ঘ একটা শব্দ উঠেছে শুধু।
কোঁচটা বাছ মতো ধরেছে সে। সুযোগ কি ঘটবে না একবার? তাহলে শালার নায়েবের কলজে বরাবর কোঁচের চবি্বশটা শলা ঢুকিয়ে দিতে পারত টুকা। হাতের রগ টনটন করছে যেন। কোঁচটা হাতে ধরাই আছে। শক্ত মুঠিতে_যেন মাছ আছে ধান জমিনের ফাঁকে ফাঁকে, ছুটছে, ছোটাচ্ছে, গাঁথতে পারে না টুকা, নাগাল পায় না। নায়েবও কি সেই রকম তার হাতের বাইরে বাইরে থেকে যাবে? এই ব্যর্থতায় তার তখন কান্না পায়। বিড়বিড় বকে, মারে তুমি ছাড়ান নিয়া দিলা নায়েব? তুমি এইডা কেমুন কাম করলা? অনাথ বানাইলা পোলা। মাইনষে মাইনষের এই রহম গাইরত করে?
একবার দাঁড়ায় টুকা, নলখাগাড়ি তো উত্তরে নয়, দক্ষিণমুখো সড়ক ধরে ধরে যেতে হয়। সে তখন ফিরল। গাবতলায় গিয়ে আস্তে আস্তে ডাকল, আইনুলরে।
তারপর মনে হল ডাকটা টুকা নিজেই শুনতে পায়নি। আইনুল বোধহয় ঘুরে ঘুুরে ছিপ থেকে মাছ খুলছে। চারদিকে মাছের কাড়াকাড়ি টাবুস-টুবুস শব্দ_উয়াস দিচ্ছে মাছ, পানির তলা ছেড়ে একদম কিনার-কানারে চলে এসেছে, পোকামাকড়, পচা-ময়লা আর নানা বর্ণের আধারের খোঁজ করতে। আইনুল যে ঘুরে ঘুরে ছিপে আধার দিচ্ছে, খুলছে, পানিতে উঠছে-নামছে, ছপছপ শব্দেই সে বুঝতে পারল। ডাকল, আইনুল, কোফাই রে তুই?
উ-উ-উ। টুকা কা, গাবতলা ছাইড়া কানিডাত আইয়ো।
আইনুলের কাছাকাছি হতে সে বলল, আইছো, খুব ভালা করছ। কইছিলাম না, জোড়া কেমুন পরছে দেখছোনি? মেঘের ডাক হুনলেও মাছের উজানি। তুমি আইতে আইতে রাশডা ভইরা ফালাইছি।
দিছছ্রে মজা মাইরা। দে তর লগে রাশডা ধরি, তুই মাছ খোয়াইয়া থো, আধারের পোডলাডা দে আমার ফাই। ল দেহি, তুই যে কস, কেমুন মাছ ঘুইরা ঘুইরা দেহি।
প্রায় প্রত্যেকটা ছিপেরই বড়শি গিলছিল মাছ_পাবদা, টেংরা, টাকি, শিং, জাগুর, গোলাইয়া বড়শি গিলে পানির ওপর খুব তড়পাচ্ছিল। কোনো কোনো দাওনের সুতাও কাটছিল মাছ। আইনুল কথা না বলে আধার গাঁথে, মাছ খোলে। কিন্তু টুকা খুঁজছিল কুইচ্ছা। একটা কুইচ্ছা কি বড়শি গিলবে না? ঘুরে যাওয়ার সাথে সাথে মাছের রাশডা ভারি হয়ে উঠছিল আস্তে আস্তে।
আইনুল রে, আমি দুইডা জাগুর নিমু।
নিওনে।
আইনুলের সোজা হবার সময় নেই। একবার দাওনের এ প্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত, আবার ও প্রান্ত সেরে এ প্রান্ত_এরকম ঘোরাঘুরি। হঠাৎ আইনুল লাফ দিয়ে কয়েক পা সরে গেল।
কী রে?
হাপ বাজছে, দোরা হাপ, দেহনি, হালারডা কেমুন প্যাচাইতাছে!
মাছ গিলেছে বড়শি! সেই মাছ গিলেছে ঢোঁড়া সাপ। ফেঁসেছে। আইনুল ছেনি তুলে সেটা কুপিয়ে টুকরো টুকরো করল, ল আহিরি খাওন খাইয়া লইছস।
মাঝরাতের অনেক আগে মাছ চলাফেরা কমাল। ভোররাতে আবার খিদে হবে, খাওয়া-দাওয়া শেষে বেলা উঠবার সাথে সাথে কিনার-কানার ছেড়ে মাছ নামবে জলায়। সেই সময়টুকুতে একটু বিশ্রাম নেবার জন্যে আইনুল হাত-মুখ ধুয়ে নিল। বলল, টুকা কা, এডডু ঘুমাইবানি? এই রাইতে মাছ বড়ি কম গিলবো। গতরডাও তো ছাড়ন লাগে কদ্দুর। লও। গাবতলায় বিছান পাথছি গো কাহা। এক লগে হুইয়া থাকি দুইজনে।
নারে, ঘরডা খালি, যাওন লাগে।
যাইবা। তাইলে লও যাই। বিড়ি তো খাইয়া যাইবা একডা।
ফেরার মুখে আইনুল জোর করেই দুটো জাগুর দিল, গোলাইয়া, পাবদা দিল টুকাকে। বলল, খাইও, কবে না কোফাই কামলা যাওগা।
নিজের খালুইয়ে মাছ ভরে নিয়ে খালুই কোঁচের কাঠিতে আটকে বাড়িমুখো হয় টুকা। গাবতলা পেরিয়ে ছনজমি। তারপর খিলান পাটজমি কয়েকটা। এখানেও বর্ষা চোয়ানো পানি উঠেছে। কবে না হাঁটু অবধি আসে কে জানে। খিলান জমির পর হাওড়া গাছ কয়েকটা, ঘাস। টুকা চমকে উঠল, ঘোড়া না, নায়েবের ঘোড়া চরে বেড়াচ্ছে?
আইনুল আছে নলখাগাড়ির শেষ মাথায়? হয়তো এতক্ষণে গাবতলায় বিছানায় গা ছেড়ে চোখ বুজেছে ছেলেটা। এদিককার কোনো খবরই জানছে না। টুকা মাছগুলো পায়ের কাছে মাটিতে খুলে রাখল দ্রুত। একটা হাওড়া গাছের ডালায় উঠে বসে কোঁচ বাগিয়ে ধরল সে। ঘোড়াটা ঘাস খাচ্ছে। দেরি না করে সে ডাকে, আয়, লারে আয় লারে আয় দেহি চান। তুই না আমার উপর দিয়ে লাফাইয়া গেছিলি হেইদিন।
ঘোড়া ঘাস খেতে খেতে নিজের নিয়মে হাওড়া গাছের কাছে আসে। দেরি না করে সবটুকু শক্তি দিয়ে টুকা ঘোড়ার পেট বরাবর কোঁচের প্রথম ঘাইটা দিল। ঘোড়া চিঁ-হিঁ-হিঁ ডেকে উঠল একবার।
কোঁচ খুলে এনে আর একবার।
টুকা গাছ থেকে যখন নামল ঘোড়াটা তখন আর দাপাচ্ছিল না।

চার
একুবের একটা লগগ্া অসুখ আছে। নাভির কাছ থেকে কাঁচির মতো কিছু একটা হেঁচড়ে হেঁচড়ে বুক পর্যন্ত ওঠে, আবার নামে। চাঁদের পূর্ণতায় অসুখটা দেখা দেয়, ফালি চাঁদের বেলায়ও। বেহুলডাঙ্গায় যাবে বলে টুকা কাপড় বেঁধেছিল গামছাতে। আর এই সময় মায়মুনা ছেনির পোঁচের মতো ধারালো চিৎকার দিল, আল্লাগো, তোমরা মানুষডারে বাঁচাও!
আজ একুবের মুখে ফেনা উঠছিল। মায়মুনা কলসির পানি হাতে তুলে তুলে একুবের তালু ভিজিয়ে দিচ্ছিল। দৌড়ে গিয়ে টুকা দুপী কবিরাজকে ডেকে আনল। এক-একবার একুব যায় যায়। মায়মুনা কাঁদতে বসে কলসির পইড্ডায় ঠেস দিয়ে।
বিকেলবেলা লোকটা একটু ভালো হল। তবে আর দিনের মতো উঠে বসল না। কাহিল হয়ে শুয়ে থাকল। এ বেলা আর বেরোব কী? টুকা নিজের ঘরের দাওয়ায় বসে শিম মাচানটার দিকে দেখে। রোদ পেয়েছে মাটি। ভেজা মাটি শুকোচ্ছে।
মায়মুনা একবার টুকার কাছে গেল। বলল, তোমার ভাইয়ের অসুখডা যাওন থামাইল দেখতাছি।
হঁ গো, নিয়ত আছিল আইজ বেহুলডাঙ্গা মেলা দিমু। পারলাম কই?
থাক। আইজ আর তোমার যাইয়া কোনো কাম নাই। রানতে যাইও না কইলাম। আমাগো চুলায় তোমার দুগগা ভাত দিমুনে। খাও-লও। হের পরে যাও।
মায়মুনা গো!
কও।
আমার উসি টালডার ফাই নজর রাহিস, কোন্ সমে না কোন্ সোমে ছাগল-গরুয়ে মুখে দেয়। নিড়েনডাও শেষ করতাম পারলাম না। যহন তহন মেঘ। মাডি যুইত দিলে না নিড়ানি দেয় মাইনষে?
টুকা যদি শিম মাচানের নিড়েনটা উঠিয়ে যেতে পারত। মায়মুনা থাকতে গরু-ছাগলে মুখ দেবে না। সেটুকু দেখশোন ভাইবউ করে। টুকা বলল, দেখবা কাইল বিয়ানে বেইল উডনের আগে আগে বেহুলডাঙ্গা মেলা আমি।
টুকা দেখে মায়মুনা যাচ্ছে। কুয়োর কাছে কলসি রাখা ছিল। এক কলসি পানি তুলল মায়মুনা।
দিনটা উঠেছিল কি, সকালবেলার সূর্যটাই ছিল গোঁয়ারের মতো। সাঁই সাঁই করে তেজ দিতে দিতে মাঝ আকাশে যে উঠল, একটু আনত হল না। দুপুরের পর নুয়ে এলো ঠিক, তবে যেন ঘুমের দিকে যাবে বলেই। রাত শেষ হয়েই আবার উঠতে হবে তেজে, পেঁৗছতে হবে মাঝ আকাশে।
শিম মাচানের আল ধরে উত্তর-পাড়ার ধনুবাড়ির গরুগুলো খেদিয়ে দিচ্ছে নতুন মাইসকা। টুকা সাবধান করে, দেহিস রে, আমার টালডাত যেমন মুখ না দেয়।
সূর্য নামে নিচের দিকে। কোনো লোক চলাচল নেই এখন। গরু-ছাগল ঘরে ফিরছে। গামলায় গরম পানি করে তাতে খুদকুঁড়ো ছেড়ে গরু-ছাগলকে পানি দেখান হবে। গোয়ালে যাবে গরু-ছাগল।
সন্ধ্যার সাথে সাথেই মানুষজন এসব সেরে ফেলে মশার ধোঁয়া দিতে বসে। টুকার সন্ধ্যাবেলাটা দারুণ দুর্বিষহ। ঘরে টিকটিকি আছে। যতক্ষণ কুপি জ্বালান থাকে, ততক্ষণ দেখা যায় টিকটিকি পোকামাকড়ের দিকে তাক হয়ে আছে। দেখে কুনো ব্যাঙটা লাফ দেয়। কোথায় উঠতে চায় ব্যাঙ? টুকিনি থাকতে এগুলো দেখতে পেত না সে। এই যে হিম হিম করে নীরবতা আস্তে আস্তে জাঁকিয়ে বসে, তা-ও হত না। একটু একটু আচ্ছন্ন হয়ে শুয়ে থাকে টুকা। ঘুম না, জাগরণ না। তখনই মনে হয় কে যেন ডাকে, বলে, উঁক্কা খাইবেন?
টুকিনির গলা না?
চমকে উঠে বসল টুকা। তারপর বুঝল, ভুল শোনা। ওদিক থেকে মায়মুনা ডাকছে, খাইয়া যাও।
সে কুয়োর কাছে যায়। নিমগাছের পশ্চিমে শিম মাচানের আলে কী যেন হাঁটছে-ফিরছে। সে চোখে-মুখে পানির ঝাপটা দেয় ঘন ঘন। শিয়াল না তো? না মালন-বাড়ির কুত্তা? কৌতূহল ভর এগোয় খানিক। গা শিউ শিউ করে উঠল সাথে সাথে। ঘোড়ার বাচ্চা না? নায়েবের ছাড়া আর কার? ঘোড়া যে মরল, সেই খোঁজ হয়েছে কি নায়েবের? এতক্ষণে খবর কি আর না হয়? টুকা দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিল না।
ঘোড়ার বাচ্চা এগোয়। মায়ের মতো অত উঁচু না, অত টগবগে না। টুকা মনে মনে ডাকে, আয়, আয়...।
বড় ঘোড়াকেও টুকা এভাবেই ডেকেছিল। তারপরই কোঁচটা গিয়ে গাঁথল। ঘোড়ার কি দোষ গো? বসে বসেই, পা তুকে তুকে টুকা এগোয়, আয়, আয়_তর মায়ে কই? দুধ খাবি ক্যামনে? আয়, আয়...। আমারও মা নাই রে। নায়েবে ছাড়ান লইয়া দিছে। হেয় যে কি কাম্ডা করছে, জীব অইয়া বুঝবি কেমনে?
তারপর বাচ্চাটা আটকা পড়ল টুকার গামছায়। সেটাকে টেনে টেনে সে গেল নায়েবের বাড়ির দিকে। কুঞ্জলতার গেট। পেরিয়ে বৈঠকখানা। নায়েব বসে ছিল বারান্দায়, অন্ধকারে। ঘরে বাতি জ্বলছে।
ফুল-টুল ফুটেছে বাগানে। গন্ধটা টুকার ভালো লাগে। ভাতের গরম ভাপের মতো না, তবে ওরকমই যেন কিছুটা। বা আরও সুন্দর ও মিষ্টি গন্ধই সেটা। কতকাল কতকাল পরে সে এই বাড়িতে এলো।
নায়েব হাঁকল, কেডা?
সেই আগের গলা নেই, ভেঙে এসেছে। হাঁসফাঁস করে।
টুকা বলল, আমি অ-ই। ঘোড়ার ছাওডা...। মা তো নাই। খালি ঘুরে, খালি ঘুরে হেইতে লইয়া আইসলাম।
অ। আয়! ঘোড়াডা গাঁইয়াইয়া মারছে কে দেহি? ছাওডারে লইয়া কি করি অহোন? বাইন্দা থুইলে দড়ি ছিঁড়তে চায়। ছাইড়া দিলে কই কই যায়গা। বুঝি তো মায়ের লাগি খালি পাক পারে। মা ছাড়া ছাও, কী যে করি!
টুকা সর্বান্তকরণে একবার কাঁপে। মায়ের সন্ধান তো সে-ও কম করে না। সেই জবাব কী? বুঝতেই পারে না কখন বাচ্চাটার গলায় দেয়া গামছা তার হাত ফস্কে যায়। সে বোধহয় বলতে চাইল, যাই গো! যাই!
কিন্তু পারল না।
অন্ধকারে ভেতরে ভেতরে টুকার অত কী ঘটল নায়েব তার কিছুই দেখতে পারল না। বারান্দার কাছাকাছি হল টুকা। কোত্থেকে আসে নির্দেশ_তা-ও না, তবুও ঘটতে থাকে এসব। নায়েব নিজের মনে বলে যায়, আমার গাইরতডা করল কেডা? মাইনষে মাইনষে কাইজা লাগতে পারে। হের লাগি ক ঘোড়া মারনের কী কাম, অবলা জানোয়ারডায় কী বুঝে? হেইডা কার কইলজাত গাঁই দিল, কার জমিডাত দহল দিল হুনি? ঘাস খাইতে গেছে, হেও তো আমার জমিন।
নায়েব বসে ছিল ডেকচেয়ারে। মুখ দেখা যায় না ভালো। চেয়ারের কাপড়ের সাথে মিলেমিশে আছে। কিন্তু কণ্ঠটা খুব ভেজা ভেজা। কুয়াশাতেই এ রকম ভেজে ঘাস, মাটি। তারপর নড়তে পারে না, মাথা তুলতে পারে না ঠাণ্ডায় ঠাণ্ডায়।
টুকা বারান্দার গজারীর পালা ধরে সামলে নেয় নিজেকে। একবার বাতাস এলো। পুকুর পেরিয়ে, গাছপালার শরীর ছুঁয়ে ছুঁয়ে বাতাস এলো। কিন্তু বাতাসটায় কী জার জার! কী শীত-শীত! টুকার কাঁপুনিটা বাড়তে থাকে। মাথায় যেন কেউ চাষ দিচ্ছে, মাটিতে যুত নেই, তবুও লাঙ্গল দাবিয়ে হালের গরুকে পেটাচ্ছে চাষি। গরুও পারে না, শক্ত মুঠিতে চাষিও ধরে রাখতে পারে না লাঙ্গল। সে না চাইলেও নিজের ধরা পড়া কণ্ঠ শুনতে পেল, ঘোড়াডারে আমি অই গাঁই দিছিলাম, আমি অই,...।
নায়েব বোধহয় শোনেনি। না শুনলেই হয় ভালো। বাতাসের জার জার ছোঁয়াটা কাটে না। পুকুরের কোনায় কোনায় ব্যাঙ ডাকে, ম্যাঘ দেও, ম্যাঘ দেও। কত দেবে বৃষ্টি? বেহুলডাঙ্গা যাবে সে। আবার বৃষ্টি! একবার ব্যাঙ ডাকা বন্ধ হল। মুহূর্ত কয়েক। একটা কু-পাখি ডাকল বুক ছেদ করে।
তখনই যেন মেঘ গর্জন হল। অপরাধীকে পেয়ে চেয়ারের ভেতর থেকে ত্বরিত বেরিয়ে আসে নায়েব। ঘোড়াটাও কোথায় চিঁহি ডেকে উঠল। টুকা উৎকর্ণ থাকে_নলখাগাড়ির টেকে কোঁচের ঘাই খাওয়া সেই চিৎকার না?
পর মুহূর্তেই নায়েবের জোর লাথি খেয়ে ছিটকে পড়ল মানুষটা।
ফুলের গন্ধ আছে বাগানে। মাটিতে হাঁটু গেড়ে উপুড় হয়ে পড়ে থাকে টুকা। কনুইয়ে শরীরের ভর। সেটুকুও এলোমেলো হয়ে যায় হঠাৎ।
শীত আসে কোত্থেকে? এখন তো শীতের সময় না। ঠকঠক কাঁপুনিতে সে ঘোলা দেখে সব। মায় জবর ছাপ-ছোফা থাকত। ঘরডাত্ লেপ-পোছ করত। ঘরের কোনায় কুনো ব্যাঙটা আছে। বাইরে ফেলে দিয়ে এসেছিল সে। আবার ফিরে এসেছে।
টুকা উঠতে চাইল। পারল না। শুনতে চাইল। শুনল না। ফালি চাঁদ ছিল আকাশে। তা-ও কি আছে?

No comments

Powered by Blogger.