স্তনদায়িনী by মহাশ্বেতা দেবী

মাসিপিসি বনগাঁ-বাসী বনের মধ্যে ঘর। কখনো মাসি বলল না যে, খই মোয়াটা ধর। যশোদার মাসি কখনো আদর করত, না অনাদর, তা যশোদার মনে পড়ে না। জন্ম থেকেই সে যেন কাঙালিচরণের বউ, হাতে গুণে জেয়ন্তে-মরন্তে কুড়িটা ছেলেমেয়ের মা।


মনেই পড়ে না যশোদার, কবে তার গর্ভে সন্তান ছিল না, মাথা ঘুরত না সকালে, কাঙালির শরীর কুপি-জ্বালা আঁধারে তার শরীরকে ভূ-তাত্তি্বকের মতো ড্রিল করত না। মাতৃত্ব সে সইতে পারে, কি পারে না, সে-হিসেব কোনদিন খতিয়ে দেখতে সময় পায়নি। নিরন্তর মাতৃত্বই ছিল তার বাঁচবার ও অসংখ্য জীবের সংসারকে বাঁচাবার উপায়। যশোদা পেশায় জননী, প্রফেশ্যনাল মাদার। বাবুদের বাড়ির বউ-ঝির মতো এ্যামেচার মা ছিল না যশোদা। এ জীবন পেশাদারদের একচেটিয়া। এ্যামেচার ভিখিরি-পকেটমার-গণিকা এ শহরে পাত পায় না, এ রাজ্যে। এমন কি ফুটপাথ ও পথের নেড়িকুত্তা, ডাস্টবিনলোভী কাক_তারাও নবাগত এ্যামেচাদের ঠাঁই দেয় না, যশোদা মাতৃত্বকে পেশা হিসেবে নিয়েছিল।
সে জন্যে দায়ী হালদারবাবুদের নতুন জামাইয়ের স্টুডিবেকার গাড়ি এবং বাবু-বাড়ির ছোট ছেলের ভরদুপুরে চালক হবার আকাঙ্ক্ষা। আকাঙ্ক্ষাটি ছেলেটির মনে হঠাৎ জেগেছিল। হঠাৎ-হঠাৎ ছেলেটির মনে ও শরীরে যেসব বাতিক চাগাত, তা তৎক্ষণাৎ পরিতৃপ্ত করতে না পারলে ছেলেটি ক্ষান্ত হতো না। হঠাৎ-হঠাৎ বাতিকগুলি ওর দুপুরের নৈঃসঙ্গ্যেই চাগাত এবং বোগদাদের খলিফার মতো ওকে বান্দা খাটাত। এ পর্যন্ত সেকারণে সে যা-যা করেছে, তাতে করে যশোদাকে মাতৃত্বের পেশা নিতে হয়নি।
এক দুপুরে হঠাৎ কামের তাড়নায় ছেলেটি তাদের রাঁধুনিকে আক্রমণ করে ও রাঁধুনিটির পেটে তখন ভরা ভাত, চোরাই মুড়ো ও কচুশাকের ভার ছিল বলে, আলস্যে শরীর মন্থর ছিল বলে, রাঁধুনিটি, 'লঃ, কি করবি কর্'_বলে চিতিয়ে পড়ে থাকে। অতঃপর ছেলেটির ঘাড় থেকে বোগদাদি ভূত নামে এবং সে_'ক্যারেও কইও না মাসি' বলে সানুশোচনা অশ্রু ফেলে। রাঁধুনিটি তাকে, 'ইয়াতে আর কওন-বলনের আছে কি?' বলে সত্বর ঘুমোতে যায়। সে কোনদিনই কিছু বলে দিত না। কেননা তার শরীর ছেলেটিকে আকর্ষণ করেছে জেনে সে যথেষ্ট গর্বিত হয়েছিল। কিন্তু চোরের মন বোঁচকার দিকে। ছেলেটি পাতে অসংগত সংখ্যায় মাছ ও ভাজা দেখে মনে-মনে প্রমাদ গনে। মনে করে, রাঁধুনি তাকে ফাঁসালে সে কেচ্ছায় পড়বে। অতএব আরেক দুপুরে সে বোগদাদি জিহনের তাড়সে মায়ের আংটি চুরি করে, সেটি রাঁধুনির বালিশের ওয়াড়ে ঢোকায় এবং শোর তুলে রাঁধুনিকে তাড়িয়ে ছাড়ে। আরেক দুপুরে সে বাবার ঘর থেকে রেডিও তুলে নিয়ে বেচে দিয়েছিল। দুপুরের সঙ্গে ছেলেটির এহেন আচরণের সংগতি খুঁজে পাওয়া তার মা-বাপের পক্ষেও মুশকিল, কেননা তার পিতা পঞ্জিকা দেখে হরিসালের হালদারদের ঐতিহ্যমতে সন্তানদের গভীর নিশীথে সৃষ্টি করেছিলেন। বস্তুত এ বাড়িতে ফটক পেরলেই ষোড়শ শতক। পঞ্জিকা ও স্ত্রী-গ্রহণ এ বাড়িতে আজো আচরিত। কিন্তু এসব কথা বাই-লেন মাত্র। এ সকল দুপুরে-বাতিকের জন্যে যশোদার মাতৃত্ব পেশা হয়নি।
কোন এক দুপুরে কাঙালিচরণ দোকানের মালিককে দোকানে বসিয়ে কোঁচার আড়ালে চারটি চোরাই সিঙাড়া জিলিপি নিয়ে ঘরে ফিরছিল। প্রত্যহই ফেরে। যশোদা ও সে ভাত খায়। ছানাপোনা তিনটি বিকেলে বাসি সিঙাড়া ও জিলিপি খায়। কাঙালিচরণ ময়রার দোকানে তাড়ু নাড়ে ও সিংহবাহিনীর মন্দিরের যাত্রীদের মধ্যে যারা 'হারায়ে মারায়ে কাশ্যপ গোত্র' হয়নি সে সকল জাত্যভিমানী বামুনদের 'সদ্ব্রাহ্মণের প্রস্তুত লুচি তরকারি' খাওয়ায় লুচি ভেজে। প্রত্যহই সে ময়দাটা-আশটা সরায় ও সংসারে সুসার করে। দুপুর নাগাদ পেটে ভাত পড়লে যশোদার প্রতি তার বাৎসল্যভাব জাগে এবং যশোদার স্ফীত স্তন নিয়ে নাড়াচাড়া করে সে ঘুমিয়ে পড়ে। দুপুর নাগাদ ঘরে ফিরতে ফিরতে কাঙালিচরণ অদূর সুখের কথা ভাবছিল এবং স্ত্রীর সুবর্তুল স্তনের কথা ভেবে সে স্বর্গসুখ পাচ্ছিল। কচি মেয়ে বিয়ে করে তাকে কম খাটিয়ে প্রচুর খাওয়ালে আখেরে দুপুরে সুখ মেলে একথা চিন্তা করে তার নিজেকে দূরদর্শী পুরুষবাচ্চা মনে হচ্ছিল। এহেন সময়ে বাবুদের ছেলে স্টুডিবেকার-সমেত ঘ্যাক করে কাঙালিচরণকে বাঁচিয়ে তার পায়ের পাতা ও গোড়ালির গোছ দুটি চাপা দিল।
নিমেষে লোক জমল। নেহাত বাড়ির সামনে দুর্ঘটনা, নইলে 'রক্তদর্শন করে ছেড়ে দিতুম' বলে নবীন পাণ্ডা চেঁচাতে লাগল। শক্তিস্বরূপিণী মায়ের পাণ্ডা সে, দুপুরে রৌদ্ররসে তেতে থাকে। নবীনের গর্জনে হালদাররা যে-যে বাড়িতে ছিল, সবাই বেরুল। হালদারকর্তা সগর্জনে 'হালা আবুইদা ষাঁড়, তুমি ব্রহ্মহত্যা করবায়?' বলে ছেলেকে পেটাতে থাকলেন। ছোট জামাই তখন স্বীয় স্টুডিবেকার সামান্য আহত দেখে স্বস্তিতে হাঁপ ছাড়লেন এবং এই পয়সায় ধনী, কালচারে পাঁঠা শ্বশুরগোষ্ঠীর চেয়ে তিনি যে শ্রেষ্ঠতর মানুষ, তা প্রমাণের জন্য মিহিন আদ্দির পাঞ্জাবির মতো ফিনফিনে গলায় বললেন, 'লোকটা কি মারা যাবে? হাসপাতালে নিতে হবে না?'_কাঙালির মনিবও ভিড়ের মধ্যে ছিল এবং পথে বিক্ষিপ্ত সিঙাড়া জিলিপি দেখে সে বলতে গিয়েছিল, 'ছিঃ ঠাকুর! তোমার এই কাজ?'_এখন সে জিভ আগলাল এবং বলল 'তাই করুন সার।'_ছোট জামাই ও হালদারকর্তা কাঙালিচরণকে সত্বর হাসপাতালে নিলেন। কর্তার মনে আন্তরিক দুঃখ হল। দ্বিতীয় যুদ্ধের সময়ে, যখন তিনি ছাঁট লোহা বেচে কিনে মিত্রশক্তির ফ্যাসি-বিরোধী সংগ্রামে সহায়তা করছেন_তখন কাঙালিচরণ কিশোর মাত্র। বামুন বলে তাঁর ভক্তিশ্রদ্ধা রক্তের পোকা ও সেই কারণে ভোরে চাটুজ্জেবাবুকে না পেলে ছেলের বয়সী কাঙালিকে প্রণাম করে তার ফাটা পায়ের ধুলো জিবে ঠেকাতেন। কাঙালি ও যশোদা তাঁর বাড়িতে পালেপার্বণে যায়-আসে এবং বউমারা পোয়াতি হলে যশোদাকে কাপড়-সিঁদুর পাঠানো হয়। এখন তিনি কাঙালিকে বললেন, 'কাঙালি! ভাইব না বাপ! আমি থাকতে তোমার কষ্ট অইব না।'_এখনি তাঁর মনে হল, কাঙালির পায়ের পাতা দুটি কিমা হয়ে গেছে, ঠেকা পড়লে আর পায়ের ধুলো নিতে পারবেন না। ভেবে বড় দুঃখ হল তাঁর, এবং 'কি করলে হারামজাদায়' বলে তিনি কেঁদে ফেললেন। হাসপাতালের ডাক্তারকে বললেন 'সবকিছু করেন! টাকার লিগ্যা ভাইব্যেন না।'
কিন্তু ডাক্তারেরা পায়ের পাতা ফিরে দিতে পারলেন না। খুঁতো বামুন হয়ে কাঙালি ফিরে এল। ক্রাচ দুটি হালদারকর্তা করিয়ে দিলেন। ক্রাচ বগলে কাঙালি যেদিন ঘরে ফিরল, সেদিনই সে জানল, হালদার-বাড়ি থেকে প্রত্যহ যশোদার জন্য সিধা এসেছে। নবীন পাণ্ডা-কুলে সেজো। মায়ের ভোগের আড়াই আনার অংশীদার এবং সেই দুঃখে সে নিচু হয়ে থাকত। সিনেমায় রামকৃষ্ণকে কয়েকবার দেখার পর সে অনুপ্রাণিত হয়ে সেই মাতা দেবীকে 'তুই, বেটি, পাগলি' বলে ও শাক্ত-মতে কারণবারি দ্বারা চেতনা নিষিক্ত করে রাখে। সে কাঙালিকে বলল, 'তোর জন্যে বেটির পায়ে ফুল চড়িয়েছিলুম।' খেপি বললে, 'কাঙালির ঘরে আমার অংশ আছে, তার বরাতে ও বেঁচে উঠবে।' কাঙালি একথা যশোদাকে বলতে গিয়ে বলল, 'অ্যাঁ? আমি যখন ছিলাম না, তুই ওই নবনেটার সঙ্গে লটর-পটর কচ্ছিলি?' যশোদা তখনি পৃথিবীর দুই গোলার্ধের মাঝে কাঙালির সন্দেহী মাথাটি চেপে ধরল ও বলল, 'রোজ বাবুদের দুটো ঝি এখেনে শুত আমাকে পাহারা দিতে। নব্নেকে আমি আমল দিই? আমি না তোমার সতী স্ত্রী?'
বস্তুত হালদার বাড়িতে গিয়েও কাঙালি তার প্রজ্বলন্ত সতীত্বমহিমার বহু কথা শুনল। যশোদা মায়ের মন্দিরে হত্যা দিয়েছে, সুবচনীর ব্রত করেছে, চেতলা গিয়ে সিদ্ধবাবার চরণ ধরেছে। অবশেষে সিংহবাহিনী স্বপ্নে ধাইয়ের বেশে বগলে ব্যাগ নিয়ে এসে তাকে বলেছেন, 'ভাবিসনি! তোর সোয়ামি ফিরে আসবে।' কাঙালি কথা শুনে বিশেষ অভিভূত হল। হালদারকর্তা বললেন, 'বুঝলা কাঙালি! হালার অবিশ্বাসীরা কয়, মায়ে স্বপ্ন দিব, তা ধাই সাইজা ক্যান্? আমি কই, তিনি সৃষ্টি করেন মা অইয়া, ধাত্রী অইয়া পালন করে।'
এরপর কাঙালি বলল, 'বাবু! ময়রার দোকানে কাজ করব কী করে আর? কেরাচ নিয়ে তো বসে তাড়ু নাড়তে পারব না। আপনি ভগবান। কত লোককে কতভাবে অন্ন দিচ্ছেন। আমি ভিক্কে চাইনি। এট্টা কাজের ব্যবস্থা করে দিন।'
হালদারবাবু বললেন, 'হ কাঙালি! তোমার লিগ্যা জায়গা দেইখ্যা থুইছি। আমার বারিন্দায় ছাউনি দিয়া এট্টা দোকান কইরা দিমু। সামনে সিংহবাহিনী। যাত্রী আসে, যাত্রী যায়। তুমি মুড়ি-মুড়কি, চিড়া বাতাসার দোকান দাও। অহন বারিতে বিয়া লাগছে। আমার সপ্তম পুত্র, হেই আবাইগার বিয়া। যদ্দিন না দোকান অয় তদ্দিন সিধা যাইবে।'
একথা শুনে কাঙালির মন বর্ষা সমাগমে বাদুলে পোকার মত উড্ডীন হল ও ঘরে ফিরে সে যশোদাকে বলল, 'সেই যে কালিদাসের শোলোক আছে, নেই তাই খাচ্ছ, থাকলে কোথায় পেতে?_আমার কপালে তাই হল রে! বাবু বলছে, ছেলের বিয়ে মিটলে রকে দোকান করে দেবে। যদ্দিন না দিচ্ছে, তদ্দিন সিধে পাঠাবে। ঠ্যাং থাকলে কি এরকমটা হত? সবই মায়ের ইচ্ছে রে!'
ক্রাচ খটখটিয়ে কাঙালি সুসংবাদটি আপামরকে বিতরণ করল। ফলে তার প্রাক্তন মনিব, নবীন পাণ্ডা, ফুলদোকানের কেষ্ট মহান্তি, মায়ের বাঁধা ঢাকি উল্লাস, সকলে বলল, 'আহা! কলি বললে তো হয় না! মায়ের তল্লাটে পাপের মতন, পুণ্যের জয়, এ হতেই হচ্ছে। নইলে কাঙালির পা খোয়া যাবে কেন? আর হালদারকত্তা বা বামুনের মন্যির ভয়ে এত কথা স্বীকার যাবে কেন? সবচে বড় কথা, যশোদাকে বা মা ধাই বেশে দেখা দেবে কেন? সবই মায়ের ইচ্ছে।'
এ ঘোর কলিতে পাঁচের দশকে কাঙালিচরণ পতিতুণ্ডকে ঘিরে দেড়শো বছর আগে স্বপ্নাদেশে প্রাপ্তা দেবী সিংহবাহিনীর ইচ্ছাসকল এভাবে পাক খাচ্ছে, তা দেখে সকলে যথোচিত বিস্মিত হয়। হালদারকর্তার হৃদ্-পরিবর্তন, সেও মায়ের ইচ্ছে। হালদারকর্তা পাত্র না দেখে দয়া করেন না। তিনি স্বাধীন ভারতের বাসিন্দা, যে ভারত মানুষে-মানুষে, রাজ্যে-রাজ্যে, ভাষায়-ভাষায়, রাঢ়ী-বারেন্দ্র-বৈদিকে, উত্তররাঢ়ীকায়স্থ ও দক্ষিণরাঢ়ীকায়স্থে, কাপ-কুলীনে প্রভেদ করে না। কিন্তু তিনি পয়সা করেছেন ব্রিটিশ আমলে যখন ডিভাইড অ্যান্ড রুল ছিল পলিসি। হালদারকর্তার মানসিকতা তখনই গঠিত হয়ে গেছে। ফলে তিনি পাঞ্জাবি-উড়িয়া-বিহারি-গুজরাটি-মারাঠি-মুসলমান, কারুক্কে বিশ্বাস করেন না এবং দুর্গত বিহারি শিশু বা অনাহারে কাতর উড়িয়া ভিখারি দেখলে তাঁর বিয়ালি্লশ ইঞ্চি গোপাল গেঞ্জির নিচে অবস্থিত, চর্বিতে সুরক্ষিত হৃৎপিণ্ডে করুণার ঘামাচি আদপে চুলকোয় না। তিনি হরিসালের সুসন্তান। ফলে পশ্চিমবঙ্গের মাছি দেখলেও তিনি 'আঃ! দ্যাশের মাছি রিষ্টপুষ্ট_ঘটির দ্যাশে হকলডি চিমড়া-চামসা' বলে থাকেন। সেই হালদারকর্তা গাঙ্গেয় কাঙালিচরণকে কেন্দ্র করে করুণাঘন হচ্ছেন, এ দেখে মন্দিরের চারিদিকে সকলেই বিস্মিত হয় এবং কিছুদিন ধরে লোকের মুখে-মুখে এই কথাই ফেরে। হালদারকর্তা এমন ঘোর দেশপ্রেমী যে নাতি, ভাইপো, ভাগ্নেরা দেশনেতাদের জীবনী পাঠ্যপুস্তকে পড়লে কর্মচারীদের বলেন, 'হঃ! ঢাকার পোলা, মইমনসিংহের পোলা, যশুইরা পোলা, ইয়াগর জীবনী পড়ায় ক্যান? হরিসাইলা অইল দধীচির হাড়ে তৈয়ার। ব্যাদ উপনিষদ হরিসাইলার লিখা এ্যাও একদিন প্রকাশ পাইব।' তাঁর কর্মচারীরা তাঁকে এখন বলে, 'আপনার চেইন্জ অফ হার্ট হইত্যাছে, ঘটির লিগ্যা আপনার এই দয়া, ইয়ার পাছে দ্যাখবেন ঈশ্বরের কুন্ বা পার্পাস আছে' কর্তা একথায় হ্লাদিত হন এবং 'ব্রাহ্মণের কি ঘটি-বাঙাল অয়? গলায় উপবীত থাকলে হ্যায় পাইখানায় বইয়া রইলেও মাইন্য দিতে অইব' বলে উচ্চ হাস্য করেন।
চতুর্দিকে এভাবে মায়ের ইচ্ছার প্রভাবে করুণা-মায়ামমতা-দয়ার সুবাতাস বইতে থাকে এবং নবীন পাণ্ডা কয়েকদিন ধরে সিংহবাহিনীর কথা যতবারই ভাবতে যায়, যশোদার উত্তুঙ্গস্তনা, গুরুনিতম্বা শরীর তার চোখে ভাসে এবং মা যশোদাকে যেমন ধাই সেজে স্বপ্ন দিলেন তাকে যশোদা সেজে স্বপ্ন দিচ্ছেন কিনা সেকথা ভেবে তার শরীরে মন্দ উত্তেজনা জাগে। আট-আনার পাণ্ডা তাকে বলে, 'মেয়েছেলের এ রোগ হলে বলে প্যাঁদ রোগ, বেটাছেলের হলে বলে ম্যাদ রোগ। তুই পেচ্ছাপ করার সময়ে কানে শ্বেত অপরাজিতার শেকড় বাঁদ্।'
একথা নবীনের মনে নেয় না। একদিন সে কাঙালিকে বলে, 'মায়ের ছেলে শক্তি নিয়ে র‌্যালা করব না। তবে একটা বুদ্ধি মাথায় এয়েচে। বোষ্টম ভাব নিয়ে র‌্যালা করতে বাধা নেই। তোকে বলি, স্বপ্নে গোপাল পা একখানা। আমার পিসি শ্রীখেত্তর থেকে গোপাল এনিছিল পাতরের, সেটা তোকে দিই। স্বপ্ন পেইছিস বলে পচার দেয়। দেকবি দুদিনে রমরমা হবে, ঝমঝমিয়ে পয়সা পড়বে। পয়সার জন্যে শুরু কর, পরে মনে গোপাল-ভাব আসবে।'
কাঙালি বলে, 'ছি দাদা! ঠাকুর-দেবতা নিয়ে তামাশা করতে আছে?'
নবীন তাকে, 'তবে মরগা যা!' বলে তাড়া দেয়। পরে দেখা যায়, নবীনের কথা শুনলে কাঙালি ভাল করত। কেন না, হালদারকর্তা হঠাৎ একদিন হার্টফেল করে মরে যান। কাঙালি ও যশোদার মাথায় শেক্ষপীরের ওয়েল্কিন ভেঙে পড়ে।
২.
কাঙালিকে পথে বসিয়ে যান হালদারকর্তা। কাঙালিকে ঘিরে ভায়ামিডিয়া হালদারকর্তা সিংহবাহিনীর যেসব ইচ্ছা প্রকাশ পাচ্ছিল, তা প্রাক্-ভোট রাজনীতিক দল-প্রদত্ত প্রজ্বলন্ত প্রতিশ্রুতির মতো শূন্যে মিলায় ও নিরুদ্দেশ-যাত্রার নায়িকার মতো রহস্যজালের মায়ায় অদেখা হয়। কাঙালি ও যশোদার রঙিন স্বপ্ন-ফানুসটিতে য়ুরোপীয় ডাইনির বডিকিন ফুটকে যায় এবং স্বামী-স্ত্রী আতান্তরে পড়ে। ঘরে গোপাল, নেপাল ও রাধারানী খাবার তরে আখখুটে বায়না ধরে ও মায়ের মুখ খায়। শিশুদের এই 'ওদনের তরে' কান্নাকাটি খুবই স্বাভাবিক। কাঙালিচরণের চরণ খোয়া যাবার পর থেকে ওরা প্রত্যহ হালদার-বাড়ির সিধায় ভালমন্দ খেয়েছে। কাঙালিও 'ভাতের তরে কাতর' হয় এবং মনে গোপাল-ভাব জাগিয়ে যশোদার বুকে মুখ খুঁশতে গিয়ে ধমক খায়। যশোদা একেবারে ভারতীয় রমণী, যে-রমণীর যুক্তি-বুদ্ধি-বিচারহীন স্বামীভক্তি ও সন্তানপ্রেমের কথা, অস্বাভাবিক ত্যাগ-তিতিক্ষার কথা, সতী-সাবিত্রী-সীতা থেকে শুরু করে নিরূপা রায় ও চাঁদ ওসমানি পর্যন্ত সকল ভারতীয় নারী জনমানসে জাগিয়ে রেখেছেন। এহেন স্ত্রীলোককে দেখেই সংসারের ন্যালা-মাক্ড়ারা বোঝে, ভারতে সেই ঐতিহ্য প্রবহমান_বোঝে এদের কথা মনে রেখেই এই সব আপ্তবাক্য রচিত হয়েছে_
স্ত্রীলোকের জান যেন কচ্ছপের প্রায়_
বুক ফাটে ত মুখ ফোটে না_
পুড়বে নারী উড়বে ছাই
তবে নারীর গুণ গাই_
বস্তুত, বর্তমান দুরবস্থার জন্য যশোদার একবারও স্বামীকে দুষতে ইচ্ছে যায় না। শিশুদের তরে যেমন কাঙালির তরেও তেমনি মমতা তার বুকে উছলে ওঠে। পৃথিবী হয়ে গিয়ে ফলে-শস্যে অক্ষম স্বামী ও নাবালক সন্তানদের ক্ষুধা মিটাতে ইচ্ছা যায়। যশোদার এই স্বামীর প্রতি বৎসল ভাবটির কথা জ্ঞানী-মুনিরা লিখে যাননি। তাঁরা প্রকৃতি ও পুরুষ এইভাবে নারী-পুরুষকে ব্যাখ্যা করেছেন। কিন্তু সে তাঁরা করেছেন আদ্যি যুগে_যখন অন্য দেশ থেকে তাঁরা এই পেনিনসুলায় প্রবেশ করলেন। ভারতের মাটির গুণ এমনি, যে এখানে রমণীরা সবাই জননী হয়ে যায় এবং পুরুষরা সবাই গোপাল-ভাবে আপ্লুত থাকে। সকল পুরুষই গোপাল ও সকল রমণী নন্দরানী, এ ভাবটি যাঁরা অস্বীকার করে নানারূপ 'ইন্টার্নাল শী'_'মোনালিসা'_'লা পাসিওনারিয়া'_'সিমন দ্য ব্যোভোআর'_ইত্যাদি পছন্দমতো কারেন্ট পোস্টার পুরনো পোস্টারের ওপরে সাঁটতে চান ও মেয়েদের সে ভাবে দেখতে চান, তাঁরাও এ ভারতের ছানাপোনা। তাই দেখা যায় শিক্ষিত বাবুদের এ সকল অভীপ্সা বাইরের মেয়েছেলেদের জন্যে। ঘরে ঢুকলে তাঁরা বিপ্লবিনীদের মুখে ও ব্যবহারে নন্দরানীকেই চান। প্রসেসটি খুবই জটিল। এটি বুঝেছিলেন বলে শরৎচন্দ্রের নায়িকারা নায়কদের সতত চারটি বেশি করে ভাত খাইয়ে দিতেন। শরৎচন্দ্রের এবং অন্যান্য অনুরূপ লেখকদের লেখার আপাতসরলতা আসলে খুব জটিল এবং সন্ধেবেলা শান্তমনে বেলের পানা খেয়ে চিন্তা করার কথা। পশ্চিমবঙ্গে যাঁরাই লেখাপড়া ও চিন্তাশীলতার কারবার করেন, তাঁদের জীবনে আমাশার প্রভাব অত্যন্ত বেশি এবং সে কারণে বেল ফলটিতে তাঁদের সমধিক গুরুত্ব দেওয়া উচিত। বেলফল-থানকুনি-বাসক-পাতাকে সমধিক গুরুত্ব দিই না বলে আমরা যে কত কি হারাচ্ছি তা নিজেরা বুঝি না।
যা হোক, যশোদার জীবনকথা বলতে বসে বারংবার বাই-লেনে ঢোকার অভ্যেস ঠিক নয়। পাঠকের ধৈর্য কিছু কলকাতার পথঘাটের ফাটল নয় যে দশকে-দশকে বেড়ে চলবে। আসল কথা হল, যশোদা সমধিক ফাঁপরে পড়ল। কর্তার শ্রাদ্ধ চলার কালে তারা লুসেপুসে খেল বটে, কিন্তু সব চুকেবুকে গেলে যশোদা রাধারানীকে বুকে ধরে ও-বাড়িতে গেল। বাসনা, গিনি্নকে বলে-কয়ে তাঁর নিরিমিষ হেঁসেলে রান্নার কাজ চেয়ে নেবে।
গিনি্নর বুকে কর্তার শোক বেজেছিল খুব। কিন্তু উকিলবাবু জানিয়ে গেছেন, কর্তা এই বাড়ির মালিকানা, চালের আড়তের স্বত্ব তাঁকেই দিয়ে গেছেন। তিনি সেই বলে বুক বেঁধে আবার সংসার-সাম্রাজ্যের হাল ধরেছেন। মাছটা-মুড়োটা বলে বড় কষ্ট হয়েছিল। এখন দেখছেন উৎকৃষ্ট গাওয়া ঘি, গাঙ্গুরামের দই-সন্দেশ, ঘন ক্ষীর ও মর্তমান কলা খেয়েও কোনমতে শরীরটা টিকিয়ে রাখা চলে। গিনি্ন জলচৌকি আলো করে বসে আছেন। কোলে এক ছ-মেসে ছেলে, গিনি্নর নাতি। এ পর্যন্ত ছয় ছেলের বিয়ে হয়েছে ও পঞ্জিকায় যেহেতু প্রায় মাসেই স্ত্রী-গ্রহণ অনুমোদিত, সেহেতু গিনি্নর বাড়িতে একতলায় সার-সার আঁতুড়ঘর প্রায়শ ফাঁক যায় না। লেডি ডাক্তার ও সরলা ধাই এ বাড়ি ছাড়া হয় না। গিনি্নর মেয়ে ছয়টি। তারাও দেড় বছরে পোয়াতি। তাই কাঁধা-কানি-ঝিনুক-বোতল-রবারক্লথ-বেবি জন্সন্ পাউডার স্নানের গামলার এপিডেমিক লেগেই থাকে।
গিনি্ন নাতিকে দুধ খাওয়াবার চেষ্টায় জেরবার হচ্ছেন ও যশোদাকে দেখে স্বস্তি পেয়ে যেন বললেন, মা ভগবান হইয়া আসছ! এ্যারে দুধ দাও মা, পা ধরি। মায়ের অসুখ তা এমুন পোলা যে বুতল মুখে ধরে না। যশোদা তখনি ছেলেকে দুধ দিয়ে শান্ত করল। গিনি্নর সনির্বন্ধ অনুরোধে যশোদা রাত ন-টা অবধি ওবাড়িতে থাকল এবং গিনি্নর নাতিকে দফায় দফায় দুধ দিল। তার সংসারের জন্যে রাঁধুনি বামনি ভাত-তরকারি গামলা ভরে দিয়ে এল। ছেলেকে দুধ দিতে দিতেই যশোদা বলল, 'মা! কর্তা তো কত কথাই বলেছিলেন। তিনি নেই তাই সেকথা আর ভাবি না। কিন্তু মা! তোমার বামুন-ছেলের পা দুখানা নেই। আমার জন্য ভাবি না। কিন্তু সোয়ামি-ছেলের কথা ভেবে বলছি যা হয় এট্টা কাজ দাও। নয় তোমার সোমসারে রান্না কাজ দিলে?'
'দেখি মা! চিন্তা কইরা দেখি।' গিনি্ন কর্তার মতো বামুন-ভজা নন। তাঁর ছেলের দুপুরে বাই চাগানো দোষে কাঙালির পা গেছে একথা তিনি পুরো মানেন না। নিয়তি কাঙালির, নইলে খটখটে রোদে ফিকফিক করে হেসে-হেসে পথ ধরে সে যাচ্ছিল কেন? তিনি মুগ্ধ ঈর্ষায় যশোদার ম্যামাল প্রোজেকশান দেখেন ও বলেন, 'কামধেনু কইরা তোমায় পাঠাইছিল বিধাতা। বাঁট টানলেই দুধ! আমার ঘরে যেগুলা আনছি তাদের এ্যার সিকিভাগ দুধ-অ বুঠায় নাই!'
যশোদা বলে, 'সে আর বলতে মা! গোপাল ছেড়ে দিল, বয়স হল তিন বছর। এটা তখনো পেটে আসেনি। তাতেও দুধ যেন বান ডাকত। কোত্থেকে আসে মা? খাওয়া নেই, মাখা নেই!'
একথা নিয়ে রাতে মেয়ে মহলে প্রচুর কথা হয় এবং রাতে ব্যাটাছেলেরাও একথা শোনেন। মেজ ছেলে, যাঁর স্ত্রী অসুস্থ এবং যাঁর ছেলে যশোদার দুধ খেল, তিনি সবিশেষ স্ত্রৈণ। অন্য ভায়েদের সঙ্গে তাঁর তফাত হল, ভাইরা পাঁজি দেখে সুদিন পেলেই সপ্রেম বা অপ্রেম বা বিরক্ত মনে বা কারবারে গুণচটের কথা ভাবতে ভাবতে সন্তান সৃজন করেন। মেজ ছেলে একই ফ্রিকোয়েনসিতে স্ত্রীকে গর্ভবতী করেন, কিন্তু তার পেছনে থাকে সুগভীর প্রেম। স্ত্রী বারবার গর্ভবতী হন, সে ভগবানের হাত। কিন্তু সেই সঙ্গে স্ত্রী যাতে সুন্দরী থাকেন, সেজন্যেও মেজছেলে আগ্রহী। ক্রমান্বয়ে গর্ভাধান ও সৌন্দর্যের কমবিনেশন কীভাবে করা যায়, একথা তিনি অনেক ভেবে থাকেন, কিন্তু কূল পান না। মেজ ছেলে আজ স্ত্রীর মুখে যশোদার সারপ্লাস দুধের কথা শুনতে শুনতে হঠাৎ বলেন, 'পাইছি পথ!'
'কিয়ের পথ?'
'এই, তোমার কষ্ট বাঁচাইবার পথ।'
'কেম্তে? আমার কষ্ট যাইব চিতায় ওঠলে। বছর-বিয়ানীর আর শরীল সারে?'
'সারব, সারব, ভগবানের কল হাতে পাইছি! বছর বিয়াইবা, দ্যাহও থাকব।'
স্বামী-স্ত্রী পরামর্শ হল। স্বামী সকালে গিয়ে মায়ের ঘরে ঢুকলেন ও ঘুচুর-ঘুচুর করে কথা কইলেন। গিনি্ন প্রথমটা গাঁইগুঁই করতে লাগলেন, কিন্তু তারপর স্বগতচিন্তা করতে করতে বুঝলেন প্রস্তাবটি লাখ টাকার। বউরা এসেছে, বউরা মা হবে। মা হলে ছেলেকে দুধ খাওয়াবে। যেহেতু যতদিন সম্ভব, ততদিনই মা হবে_সেহেতু ক্রমান্বয়ে দুধ খাওয়ালে চেহারা ঝটকাবে। তখন যদি ছেলেরা বারমুখো হয়, বা বাড়ির ঝিদের ওপর উৎপাত করে, গিনি্ন কিছু বলতে পারবেন না। ঘরে পাচ্ছে না বলে বাইরে যাচ্ছে_হক কথা। তাই যশোদা যদি কচি কাঁচাদের দুধ-মা হয়, তাহলে নিত্য সিধা, পুজোয় পার্বণে কাপড়, মাসান্তে কিছু টাকা দিলেই কাজ হয়। গিনি্নর বাড়িতে আজ চাপড়াষষ্ঠী, কাল সুবচনী, পরশু মঙ্গলচণ্ডী ব্রত লেগেই থাকে। তাতেও যশোদাকে বামুন-এয়ো করা চলবে। তার ছেলের কারণে যশোদার এত খোয়াব, পাপও স্খলন হবে।
যশোদা তাঁর প্রস্তাবে হাতে মন্ত্রিত্ব পেল। নিজের স্তন দুটিকে বড় মহার্ঘ মনে হল তার। রাতে কাঙালিচরণ খনসুড়ি করতে এলে সে বলল, 'দেখ! এখন এর জোরে সংসার টানব। বুঝে শুনে ব্যবহার করবে।' কাঙালিচরণ সে রাতে গাঁইগুঁই করল বটে, কিন্তু সিধাতে চাল-ডাল-তেল-আনাজের বহর দেখে তার মন থেকে গোপাল-ভাবটি নিমেষে চলে গেল। ব্রহ্মা-ভাবে সে উদ্দীপিত হল এবং যশোদাকে বুঝিয়ে বলল, পেটে সন্তান থাকলে তবে তোর বুকে দুধ আসবে। এখন সেকথা ভেবেই তোকে কষ্ট করতে হবে। তুই সতীলক্ষ্মী। নিজেও পোয়াতি হবি, পেটে ছেলে ধরবি, বুকে পালন করবি, এ তো জেনেই মা তোকে ধাইবেশে দেখা দিইছিল।'
যশোদা এ কথার যাথার্থ্য বুঝল ও সাশ্রুচোখে বলল, 'তুমি স্বামী, তুমি গুরু যদি বিস্মরণ হয়ে না-না করি, তুমি সোঙরে দিও। কষ্ট আর কী বল? গিনি্নমা কি তেরটা বিয়োয়নি? গাছের কি ফল ধরতে কষ্ট হয়?'
অতএব সেই নিয়মই বহাল রইল। কাঙালিচরণ পেশাদারি পিতা হল। যশোদা হল প্রফেশনাল মা। বস্তুত যশোদাকে দেখলে এখন সেই সাধকমার্গের গানটির গভীরতা অবিশ্বাসীরও মনে জাগে। গানটি হল_
মা হওয়া কি মুখের কথা?
শুধু প্রসব কল্লে হয় না মাতা।
হালদার-বাড়ির চক্মেলানো উঠোনের চারধারে বড়-বড় ঘরে বার-চোদ্দটি সুলক্ষণা গাভী হামেশা হামেহাল বজায় থাকে। দুজন ভোজপুরী গো-মাতা জ্ঞানে তাদের পরিচর্যা করে। খোল-ভুসি-খড়-ঘাস-গুড় পাহাড় পাহাড় আসে। হালদারগিনি্ন বিশ্বাস করেন, গরু খাবে যত, দুধ দেবে তত। যশোদার জায়গা এ বাড়িতে এখন গো-মাতাদের ওপরে। গিনি্নর ছেলেরা ব্রহ্মাবতার হয়ে প্রজাদের সৃষ্টি করে। যশোদা প্রজা প্রপালিকা। তার দুগ্ধসঞ্চয় যাতে অব্যাহত থাকে সেদিকে হালদারগিনি্ন কড়া নজর রাখলেন। কাঙালিচরণকে ডেকে বললেন, 'হ্যাঁ বামুন ছেলে? দোকানে ত তাড়ু নাড়তা, ঘরে পাকসাকের ভারটা নিয়া অরে আরাম দেও। নিজের দুটো, এখানে তিনটা, পাঁচটারে দুধ দিয়া ঘরে গিয়া পাক-সাক করতে পারে?'
কাঙালিচরণের জ্ঞাননেত্র এভাবে খুলে গেল এবং নিচে এসে ভোজপুরীদ্বয় তাকে খৈনি দিয়ে বলল, 'মা জি ত ঠিকহি বলেছে। হামরা গৌ মাতার ইতনা সেবা করি_তা তুর বহু তো জগৎমাতা আছে।'
এরপর থেকে কাঙালিচরণ বাড়ির রান্নার ভার তুলে নিল হাতে। ছেলেমেয়েদের করে তুলল কাজের সাগরেদ। ক্রমে সে থোড়ঘণ্ট, কলাই ডাল, মাছের অম্বল রাঁধতে বড়ই সেয়ানা হল এবং সিংহবাহিনীর প্রসাদী পাঁঠার মাথার মুড়িঘণ্ট রেঁধে নবীনকে খাইয়ে-খাইয়ে সেই দুর্দান্ত গেঁজেল মাতালকে নিজের বশীভূত করে ফেলল। ফলে নবীন কাঙালিকে নকুলেশ্বর শিবের মন্দিরে ঢুকিয়ে দিল। যশোদা প্রত্যহ রাঁধা ভাতব্যঞ্জন খেয়ে পি. ডব্ল্যু. অফিসারের ব্যাঙ্ক-অ্যাকাউন্টের মতো ফুলে ফেঁপে উঠল। তার ওপর গিনি্নমা তাকে দুধ-উঠনো করে দিলেন। পোয়াতি হলে তার জন্যে আচার-ঝালনাড়ু-মোরব্বা পাঠাতে থাকলেন।
এই ভাবে অবিশ্বাসীদেরও প্রত্যয় জন্মাল, যশোদাকে সিংহবাহিনী এই কারণেই বগলে ব্যাগ নিয়ে ধাই হয়ে দেখা দিয়েছিলেন। নইলে নিরন্তর গর্ভধারণ, সন্তান-প্রসব, অপরের ছানাপোনাকে গাভীর মতো অকাতরে দুগ্ধদান কে কবে শুনেছে বা দেখেছে? নবীনের মন থেকেও মন্দ ভাব চলে গেল। পাঁঠার মাথা, কারণবারি, গাঁজা, এহেন উগ্র জিনিস খেয়েও তার শরীর আর তাতল না। মনে আপনা হতেই ভক্তিভাব এল। যশোদাকে সে দেখা হতেই 'মা! মা! মাগো!' বলে ডাকতে থাকল। চতুর্দিকে সিংহবাহিনীর মাহাত্ম্য বিষয়ে বিশ্বাস পুনর্জাগ্রত হল এবং অঞ্চলটির বাতাসে দেবীমাহা@ে@@@্যর ইলেক্ট্রিফাইং প্রভাব বইতে থাকল।
যশোদা বিষয়ে সকলের ভক্তিভাব এমন প্রখর হল যে বিয়ে-সাধ-অন্নপ্রাশন-পইতেয় সকলে তাকে ডেকে প্রধানা এয়োর সম্মান দিতে থাকল। যশোদার ছেলে বলে নেপাল-গোপাল-নোনো-বোঁচা-পটল ইত্যাদিকে সবাই সেই চোখে দেখতে থাকল, এবং যে যেমনটি বড় হল, পইতে নিয়ে মন্দিরে যাত্রী ধরে আনতে থাকল, রাধারানী, আলতারানী, পদ্মরানী, ইত্যাদি মেয়েদের জন্যে কাঙালিকে বর খুঁজতে হল না। নবীন আশ্চর্য তৎপরতায় মেয়েদের বর জুটিয়ে দিল ও সতী মায়ের সতী কন্যারা যে যার শিবের ঘর করতে গেল।
হালদার-বাড়িতে যশোদার আদর বেড়ে গেল। স্বামীরা খুশি, কেন না এখন আর তাদের পাঁজি উলটোতে দেখলে বউদের হাঁটুতে ঠকঠকি লাগে না। তাঁদের গোপালরা যশোদার স্তন্যে লালিত হচ্ছে বলে তাঁরা যথেচ্ছ গোপাল হতে পারেন বিছানায়। বউদের 'না' বলবার মুখ রইল না। বউরা খুশি। কেন না দেহের ডোলটি ভাল থাকল। তারা যথেচ্ছ মেম কাটের জামা ও বডিস পরতে পারল। হোলনাইট সিনেমা দেখে শিবরাত্তির করার সময়ে ছেলেকে দুধ দিতে হল না। এ সবই সম্ভব হল যশোদার জন্যে। ফলে যশোদার মুখ খুলল এবং শিশুদের নিরন্তর স্তন দিতে দিতে গিনি্নর ঘরে বসে সে ফুট কাটতে থাকল, 'মেয়েছেলে বিয়োবে, তার জন্যে ওষুধ রে, বেলাড্ডপেসার দেখা রে, ডাক্তার দেখানো রে। আদিখ্যেতা! এই তো আমি! বছর-বিউনি হইছি। তাতে কি শরীর টস্কাচ্ছে, না দুধ কমছে? কি ঘেন্না মা! শুনছি না কি ইঞ্জিশান দিয়ে সব শুকিয়ে ফেলেছে। এমন কথাও শুনিনি কখনো!'
হালদার-বাড়ির ছেলেদের মধ্যে যারা কিশোর, তাদের বাপ-জ্যেঠাকাকারা গোঁফ গজাতেই ঝিদের আওয়াজ দিত। দুধ-মার দুধে তারাও মানুষ, তাই দুধ-মার বন্ধু ঝি-রাঁধুনিকে তারা এখন মাতৃভাবে দেখতে থাকল এবং মেয়ে ইস্কুলের চারপাশে হাঁটাহাঁটি শুরু করল। ঝিয়েরা বলল, 'যশি! ভগবতী হয়ে এইছিলি তুই! তো' হতে বাড়ির হাওয়া পালটাল।
ছোট ছেলে যখন একদিন উঁবু হয়ে বসে যশোদার দুগ্ধদান দেখছে তখন যশোদা বলল, 'তুমি বাছা আমার লক্ষ্মী! বামুনের ঠ্যাং খুঁতো করেছিলে বলে তো এতসব হল? বল দেখি কার ইচ্ছেয় হল?'
ছোট হালদার বলল, 'সিংহবাহিনীর ইচ্ছে!'
তার জানতে ইচ্ছে হয়েছিল, ঠ্যাং নেই, তবু কাঙালিচরণ ব্রহ্মা হয় কি উপায়ে? কথাটা ঠাকুরদেবতার দিকে চলে গেল বলে, সেও প্রশ্নটি ভুলে গেল।
সবই সিংহবাহিনীর ইচ্ছে!
৩.
পঞ্চাশের দশকে কাঙালির ঠ্যাং কাটা যায়, আমাদের কাহিনী এই সময়ে পেঁৗছেছে। পঁচিশ বছরে, থুড়ি তিরিশ বছরে, যশোদা কুড়ি বার আঁতুড়ে ঢুকেছে। শেষের দিকের মাতৃত্বগুলো বেফয়দা যায়, কেন না, কেমন করে যেন হালদার-বাড়িতে নতুন হাওয়া ঢুকে পড়ল। ওই পঁচিশ না তিরিশ বছরের গণ্ডগোলটুকু সেরে নিই। কাহিনী যখন শুরু হয় তখনি যশোদা তিন ছেলের মা ছিল। তারপর তার সতেরবার সন্তান সম্ভাবনা হয়। হালদার গিনি্নও মরে গেলেন। তাঁর বড় ইচ্ছে ছিল, তাঁর শাশুড়ির যেমনটি হয়েছিল, তেমনটি বউদের কারো হোক। কুড়িটি সন্তান হলে আবার স্বামী-স্ত্রীর বিয়ে হবার নিয়ম ছিল বংশে। কিন্তু বউমারা বারো তেরো-চৌদ্দতে ক্ষান্ত দিল। দুর্বুদ্ধিবশত তারা স্বামীদের বোঝাতে সক্ষম হল এবং হাসপাতালে গিয়ে ব্যবস্থা করে এল। সে সবই নতুন হাওয়ার কুফলে ঘটল। কোন যুগেই জ্ঞানী পুরুষ বাড়িতে নতুন হাওয়া ঢুকতে দেন না। দিদিমার কাছে শুনেছি জনৈক ভদ্রলোক তাঁর বাড়িতে এসে 'শনিবারের চিঠি' পড়ে যেতেন। কদাচ ঘরে বইটি ঢোকাতেন না। বলতেন, 'বউ-মা বোন যে ওই কাগজ পড়বে, সেই বলবে আমি নারী! মা নই, বোন নই, বউ নই।' ফলে কী ঘটবে, তা জিজ্ঞেস করলে বলতেন, 'চটি পরে ভাত রাঁধবে।' নতুন হাওয়ার প্রকোপে অন্দরে অশান্তি হয়, এ চিরকালের নিয়ম।
হালদার-বাড়িতে চিরকাল ষোড়শ শতক চলছিল। কিন্তু সহসা বাড়িতে মেম্বর সংখ্যা অগণিত হল বলে ছেলেরা যে-যার মতো নতুন বাড়ি বানিয়ে সটকে পড়তে থাকল। সবচেয়ে আপত্তির কথা, মাতৃত্ব বিষয়ে গিনি্নর নাতবউরা একেবারে উলটো হাওয়া খেয়ে ঘরে ঢুকল। বৃথাই গিনি্ন বললেন, চালের অভাব, টাকার অভাব নেই। কর্তার বড় সাধ ছিল হালদারদের দিয়ে অর্ধেক কলকাতা ভরে ফেলেন। নাতবউরা নারাজ। তারা বুড়ির দাবড়ি অগ্রাহ্য করে স্বামীদের নিয়ে কর্মস্থলে ছুটল। এরই মধ্যে সিংহবাহিনীর মন্দিরের পাণ্ডাদের মধ্যে বিষম কলহ হওয়াতে কে বা কাহারা যেন দেবীর মূর্তি ঘুরিয়ে দিল। মা মুখ ফিরিয়েছেন একথা শুনে গিনি্নর বুক ভেঙে গেল এবং মনোদুঃখে ভরা জ্যৈষ্ঠে অসংগত পরিমাণে কাঁঠাল খেয়ে দাস্তবমি হয়ে তিনি মরে গেলেন।

৪.
গিনি্ন মরেই খালাস পেলেন, কিন্তু জ্যান্ত থাকার জ্বালা মরণ হতে বেশি গিনি্নর মৃত্যুতে যশোদার আন্তরিক দুঃখ হল। বয়স্ক মানুষ পাড়ায় মরলে বাসিনীর মতো সুবিন্যাসে কেউ কাঁদতে পারে না, বাসিনী এ বাড়ির পুরনো ঝি। কিন্তু যশোদার ভাতের থালাটি গিনি্নর সঙ্গে বিসর্জন গেল, তাই যশোদা আরো সুবিন্যাসে কেঁদে সকলকে অবাক করে দিল।
বাসিনী কাঁদল, 'অ ভাগ্যিমানী মা, মাথার চুড়োটি খসতে কত্তা হয়ে সকলেরে যে আগলে রেকেছিলে মা! কার পাপে চলে গেলে মা গো! ওগো, আমি যে বন্নু, অত ক্যাঁটাল খেওনি, তা মোর কতা যে মোটে নিলে না গো মা!'
যশোদা বাসিনীকে দম নিতে সুযোগ দিল ও সেই বিরতিতে কেঁদে উঠল, 'কেন রইবে মাগো! ভাগ্যিমানী তুমি, পাপের সংসারে রইবে কেন বল গো মা! সিংহাসন পাতা ছিল তা যে তুলে ফেললে গো বউ দিয়া। গাচ যখন বলে ফল ধরবনি, সে যে পাপ গো। অত পাপ কি তুমি সইতে পার মাগো। তা বাদে সিংহবাহিনী যে মুখ ফেরালে গো মা। বুঝিছিলে পুণ্যের পুরী পাপের পুরী হয়ে গেল, এ পুরীতে কি তুমি বাস কত্তে পার? কত্তা চলে যেতে তোমারো যে মন চলে গিইছিল গো মা। শরীলটা সংসারের দিকে চেয়ে ধরে রেখেছিলে বই তো নয়। অ বউদিরা। আলতা দিয়ে পায়ের ছাপ উটিয়ে রাখ গো! ও পায়ের ছাপ ঘরে রইলে লক্ষ্মী বাঁদা থাকবে গো! সকালে উঠে ওতে মাতা ঠেকালে ঘরে রোগ দুঃখ ঢুকবে না গো!'
শব-দেহের পেছন-পেছন যশোদা কেঁদে-কেঁদে শ্মশানে গেল ও ফিরে এসে বলল, 'স্বচক্ষে দেখুন সগ্গ থেকে রথ নেমে এসে চিতার বুক থেকে গিনি্নমাকে নিয়ে ওপর পানে চলে গেল।'
গিনি্নর শ্রাদ্ধশান্তি চুকে গেলে বড় বউ যশোদাকে বললেন, 'বামুন দিদি সংসারে তো ভাঙন ধরল। মেজ সেজ বেলেঘাটার বাড়িতে উইঠা যাইত্যাছে। রাঙা আর নতুন যাইত্যাছে মানিকতলা-বাগমারি। ছোট যাইব গিয়া আমাগো দক্ষিণেশ্বরের বাড়ি।'
'এখানে কে থাকবে?'
'আমিই থাকুম। তবে গিয়া নিচতলা ভাড়া দিব হ্যায়। অহন সংসার গুটাইতে অইব। তোমার দুগ্ধে সবারে পাল্ছ, নিত্য সিধা গেচে। হ্যায় সন্তান দুধ ছারছে, তবুও আট বছর মা সিধা পাঠাইছে। উনি যা মন লয় তাই করছে। পোলারা কথা কয় নাই। কিন্তু অহন তো আর পারবাম না।'
'আমার কি হবে বড় বউদি?'
'তুমি যদি আমার সংসারে পাক-সাক কর, তোমার প্যাট চলব। কিন্তু ঘরের হকলডির কী করবা?'
'কী করব?'
'তুমিই কও। জেয়ন্তে তুমি বার সন্তানের মা! মাইয়াগুলান্ বিয়া অইয়া গিছে। পুলারা ত শুনি যাত্রী ডাকে, মন্দিরের ভোগ খায়, চাতালে পইড়া থাকে। বামুনও ত শুনি নকুলেশ্বর মন্দির ভালই জমাইছে। তোমার অভাব কিসের?'
যশোদা চোখ মুছে বলল, 'দেখি! বামুনকে বলি।'
কাঙালিচরণের মন্দিরে এখন খুবই রমরমা। কাঙালি বলল, 'আমার মন্দিরে তুই কী করবি?'
'নব্নের বোনঝি কী করে?'
সে মন্দিরের সোম্সার দেখে, রাঁধে-বাড়ে। তুই ঘরেই রাঁধিস না কদ্দিন, মন্দিরের উঠনো তুই ঠেলতে পারিস?'
'ওবাড়ির সিধে উঠে গেল। সে কতা মাথায় ঢুকল ড্যাকরার? খাবে কী?'
নবীন বলল, 'সে তোকে ভাবতে হবে না।'
'এ্যাদ্দিন ভাবিয়াছিলে কেন? মন্দিরে খুব দু পয়সা হচ্ছে, তাই না? সব জমিয়েছ আর আমার গতর জল করা ভাত খেয়েছ বসে বসে।'
'বসে বসে রাঁধত কে?'
যশোদা হাত নেড়ে বলল 'বেটাছেলে এনে দেয়, মেয়েছেলে রাঁধে-বাড়ে। আমার কপালে সকলই উলটো হইছিল। আমার ভাত খেয়েছ যখন, তখন আমাকে ভাত দেবে এখন। ন্যায্য কথা।'
কাঙালি ফস্ করে বলল, 'কোত্থেকে ভাত যোগাড় করলি? হালদার-বাড়ি তোর কপালে জুটত? আমার ঠ্যাং কাটা গেল বলেই না তোর কপালে ওবাড়ির দোর খুলল? কত্তা তো আমাকেই সব দেবেথোবে বলিছিল। সব ভুলে বসে আছিস মাগি?'
'তুমি মাগি না আমি মাগি? বউয়ের গতরে খায়, সে আবার বেটাছেলে!'
একথা থেকে দুজনের তুমুল কলহ বেধে গেল। দুজনে দুজনকে শাপশাপান্ত করল। অবশেষে কাঙালি বলল, 'তোর মুখ আর দেখব না, যাঃ!'
'না দেখলে না দেখবে।'
যশোদাও রেগে ঘর ছেড়ে বেরল। ইতিমধ্যে পাণ্ডাদের শরিকে-শরিকে সাট হয়েছে, ঠাকুরের মুখ ফেরাতে হয়, নইলে সমূহ সর্বনাশ। সে জন্যে মন্দিরে মহা ধুমধামে প্রায়শ্চিত্ত পুজো হচ্ছে। যশোদা সেখানে হত্যা দিতে গেল। দুঃখে তার প্রৌঢ়, দুগ্ধহীন, স্থূল বুক দুটি ফেটে যাচ্ছে। সিংহবাহিনী তার দুঃখ বুঝে পথ বাতলে দিল।
তিন দিন যশোদা চাতালে পড়ে থাকল। নতুন হাওয়া সম্ভবত সিংহবাহিনীও খেয়েছেন। তিনি মোটেই স্বপ্নে দেখা দিলেন না। উপরন্তু তিন দিন উপোসী থেকে কাঁপতে-কাঁপতে উঠে যশোদা যখন ঘরে গেল, ছোট ছেলে বলে গেল, 'বাপ মন্দিরে থাকবে। আমাকে আর নবাকে বলেছে তোরা ঘণ্টা বাজাবি, রোজ পেসাদ পাবি, পয়সা পাবি।'
'বটে! তা বাপ কোথা!'
'শুয়ে আছে। গোলাপি মাসি বাবার পিঠের ঘামাচি গেলে দিচ্চে। বলল, তোরা পয়সা দিয়ে ল্যাবেঞ্চুস খেগে যা! আমরা তাই তোকে বলতে এনু।'
যশোদা বুঝল, হালদার-বাড়িই নয়, কাঙালির কাছেও তার দরকার ফুরিয়েছে। জলবাতাসা খেয়ে সে নবীনকে নালিশ করতে গেল। নবীনই সিংহবাহিনীর প্রতিমা হিঁচকে বিমুখ করেছিল ও অন্য পাণ্ডাদের সঙ্গে বাসন্তী পূজা, জগদ্ধাত্রী পূজা ও শারদ দুর্গাপূজার বিশেষ রোজগার বিষয়ে ফয়সালা হবার পর পুনর্বার প্রতিমাকে হিঁচড়ে মুখ ফিরিয়ে সে ব্যথিত নড়ায় পাকি মদ মালিশ করে গাঁজা টেনে বসেছিল এবং স্থানীয় ভোটের ক্যান্ডিডেটের উদ্দেশে বলেছিল, 'পুজো দিলি নে তো? মায়ের মাহাত্ম্য আবার ফিরেছে। এবার দেখে নেব কেমন করে জিতিস!'
মন্দিরের আওতায় থাকলে এ দশকেও কী কী অলৌকিক ঘটনা ঘটে, নবীনই তার প্রমাণ। দেবীর মুখ সে নিজেই ফিরিয়েছিল এবং নিজেই বিশ্বাস করেছিল পাণ্ডারা ভোট-চাই দলসকলের মতো জোট বাঁধছে না বলে মা বিমুখ হয়েছেন। এখন মার মুখ ফেরাবার পর তার আবার ধারণা জন্মাল, মা নিজে ফিরেছেন।
যশোদা বলল, 'কী বকছ?'
নবীন বলল, 'মায়ের মাহা@ে@@@্যর কথা কইছি।'
যশোদা বলল, 'নিজে ঠাকুরের মুখ ঘুরিয়েছিলে তা জানি না ভেবেছ?'
নবীন বলল, 'চুপ কর যশি। ঠাকুর শক্তি দিলে বুদ্ধি দিলে, তবে না আমা হতে কাজটি হল?'
'তোমাদের হাতে পড়ে মায়ের মাহাত্ম্য গেল!'
'মাহাত্ম্য গেল! গেলে পরে পাখা ঘুরছে, পাখার নিচে বসে আছিস, তা হল কী করে? চাতালের ছাতে ইলেটিরি পাখা এর আগে ঘুরেছে?'
'তা তো হল। এখন আমার কপাল পোড়ালে কেন, তাই কও দিকি? আমি তোমার কী করিছি?'
'কেন? ক্যাঙালি তো মরেনি?'
'মরবে কেন? মরার বাড়া হয়েছে।'
'কী হল?'
যশোদা চোখ মুছে ভারী গলায় বলল, 'এতগুলো পেটে ধরিছি, সেই বলে বাবুদের বাড়ি বাঁধাধরা দুধ-মা ছিলাম। জান তো সবই। কোনদিন কুপথে হাঁটিনি।'
'আই ব্বাস্! তুই হলি গে মায়ের অংশ।'
'মা তো ভোগেরাগে রইল। অংশ যে অন্ন বিনে মরতে বসেছে। হালদারবাড়ি তো হাত ওঠালে।'
'তুই বা ক্যাঙালির সঙ্গে ঝগড়া করতে গেলি কেন? বেটাছেলে ভাতের খোঁটা সয়?'
'তুমি বা তোমার বোনঝিকে হোথা গছালে কেন?'
'সে ঠাকুরের লীলে হয়ে গেল। গোলাপি যেয়ে মন্দিরে ধন্না দিত। তা ক্রেমে-ক্রেমে ক্যাঙালি বুঝল ও হচ্ছে ঠাকুরের ভৈরব আর গোলাপি ওর ভৈরবী।'
'ভৈরবী! খ্যাংরা মেরে ওর হাত হতে সোয়ামি ছাড়িয়ে আনতে পারি এখনি।'
নবীন বলল, 'নাঃ! সে আর হতে হচ্চে না। ক্যাঙালি পুরুষ ছেলে, ওর আর তোতে মন ওঠে? তা বাদে গোলাপির ভাইটে সাক্ষাৎ গুণ্ডা, সে হোথা যেয়ে পাওরা দিচ্ছে। আমাকেই গেট আউট করে দিলে। আমি যদি দশ ছিলিম টানি, সে টানে বিশ ছিলিম। ক্যাঁকালে লাথি মেরে দিলে। যেয়েছিলাম তোর কথা বলতে। ক্যাঙালি বললে, ওর কতা আমায় বল না। ভাতার চেনে না, বাবু-বাড়ি চেনে। বাবু-বাড়ি ওর ইষ্টিদেবতা, সেথা থাক গা।'
'তাই যাব!'
বলে সংসারের অবিচারে পাগল-শাগল যশোদা ঘরে ফিরল। কিন্তু শূন্য ঘরে মন টেকে না। দুধ খাক না খাক, কোলের কাছে একটা ছেলে না থাকলে ঘুম আসে না। মা হওয়া বড় ভীষণ নেশা। সে নেশা দুধ শুকোলেও কাটে না। অগত্যা মান খুইয়ে যশোদা হালদারনীর কাছে গেল বলল, 'রাঁধব বাড়ব, মাইনে দেবে দিও, না দেবে না দিও। হেথা থাকতে দিতে হবে। মিনসে নিজের মন্দিরে থাকতেছে। ছেলেগুলো কী বেইমান মা! সেথা গিয়ে জুটেছে। কার তরে ঘর আটকে রাখব মা?'
'তা থাকো। তুমি ছেলেদের দুধ দিছ, তায় বামুন। তা থাক। কিন্তু দিদি, থাকতে তোমার কষ্ট হইব। ওই বাসিনীদের লগে এক ঘরে থাকবা। ক্যারো লগে ঝগড়াবিবাদ কইর না। বাবুর মাথা গরম। তায় সেজ পুলা বুম্বে গিয়া সেই দেশী মেয়ে বিয়া বসছে বইলা ম্যাজাজ মন্দ। ক্যাচাকেচি হইলে তাই চটব।'
সন্তান হবার ক্ষমতাই যশোদার লক্ষ্মী ছিল। সেটি খতম হতেই তার কপালে এত, এত দুর্গতি ঘটল। পাড়ার মায়ের ভক্তবাড়িগুলির শ্রদ্ধেয়া দুগ্ধবতী সতীসাধ্বী যশোদার এখন পড়তির সময়। মানুষের স্বভাবধর্ম হল উঠতির কালে অসংগত অহমিকা হয় এবং পড়তির কালে 'অবস্থা বুঝে নিনু হয়ে থাকি'_এ সারেণ্ডার আসে না মনে। ফলে মানুষ তুচ্ছ জিনিস নিয়ে আগের দাপে দামড়াতে যায় ও ব্যাঙের লাথি খায়।
যশোদার কপালেও তাই হল। বাসিনীরা তার পা ধোয়া জল খেত। এখন বাসিনী অক্লেশে বলল, 'তুমি তোমার বাসন মেজে নেবে। তুমি কী মনিব, যে তোমার এঁটো বাসন মাজব? তুমিও মনিবের চাকর, আমিও।'
'জানিস আমি কে?'_বলে গর্জে উঠতে যশোদা বড় বউয়ের মুখ শুনল, 'এই লিগাই আমার ডর ছিল খুব। মায়ে অরে মাথায় উঠাইয়া দিয়া গেছে। দেখ বামুন দিদি! ডাইকা আনি নাই, সাইধা আসছ, অশান্তি কইর না।'
যশোদা বুঝল, এখন আর তার টু কথাটিও কেউ শুনবে না। মুখ বুজে সে রাঁধল বাড়ল, এবং বিকেলে মন্দিরের চাতালে কাঁদতে বসল। মন খুলে কাঁদতেও পারল না। নকুলেশ্বর মন্দির থেকে আরতির বাজনা শুনে ও চোখ মুছে উঠে এল। মনে মনে বলল, 'এবার দয়া কর মা! শেষে কি টিনের বাটি হাতে পথে বসতে হবে? তাই চাও?'
হালদার-বাড়ি ভাত রেঁধে আর মায়ের কাছে মনোদুঃখ নিবেদন করে দিন কাটতে পারত। কিন্তু যশোদার কপালে তা সইল না। যশোদার দেহ যেন এলে পড়ল। কোন কিছুতে ভাল লাগে না, যশোদা বোঝে না। মাথার ভেতর বিভ্রম সব। রাঁধতে বসলে মনে হয় এ বাড়ির দুধ-মা। কস্তাপেড়ে শাড়ি পরে সে সিধে নিয়ে ঘরে যাচ্ছে। স্তন দুটি বড় শূন্য লাগে, যেন বরবাদ। স্তন বৃন্তে শিশুর মুখ নেই, এ তার জীবনে ঘটবে বলে ভাবেনি।
খুব অন্যমনস্ক হয়ে গেল যশি। ভাত তরকারি প্রায় সবই বেড়ে দেয়, নিজে খেতে ভুলে যায়। মাঝে-মাঝে নকুলেশ্বর শিবের উদ্দেশে বলে, 'মা না পারে, তুমিই আমায় সরিয়ে নাও। আর পারি না।'
শেষে বড় বউয়ের ছেলেরাই বলল, 'মা! দুধ-মার শরীর কি অসুস্থ? কেমন যেন হইয়া গেছে?'
বড় বউ বলল, দেখি!'
বড়বাবু বলল, 'দেখ! বামুনের মাইয়া, কিছু অইলে আমাগো পাপ অইব।'
বড় বউ জিজ্ঞেস করতে গেল। ভাত চড়িয়ে যশোদা রান্নাঘরেই আঁচল পেতে শুয়েছিল। বড় বউ তার আদুড় গা দেখে বলল, 'বামুন দিদি! তোমার বাঁও মাইয়ের উপরটা লাল মতো দেখায় ক্যান? ইশ! দগদগা লাল!'
'কি জানি। ভেতরে যেন পাতর ঠেলে উঠেচে। বড় শক্ত, ঢিল পারা।'
'কি অইল?'
'কী জানি? এতগুলোকে দুধ দিইছি, তাতেই হয়ত অমন ধারা হল?'
'ধুর! ঠুনকা হয়, মাইঠোস হয় দুগ্ধ থাকলে। তোমার তো কুলেরটা দশ বছইরা।'
'সেটা নেই গো! তার উপরেরটা আছে। সেটা তো আঁতুড়ে গেছে। গেছে, ভাল গেছে! পাপের সংসার।'
'রও কাল ডাক্তার আইব নাতিরে দেখতে। তারে জিগামু। আমি য্যান্ ভাল দেখি না।'
যশোদা চোখ বুজে বলল, 'যেন, পাতরের মাই গো, পাতর পোরা। আগে শক্ত গুলিটা সরত নড়ত, এখন আর নড়ে না, সরে না।'
'ডাক্তাররে দেখামু।'
'না বউদিদি, বেটাছেলে ডাক্তারের কাছে আমি গা আদুড় করতে পারব না।'
রাতে ডাক্তার আসতে ছেলেকে সামনে রেখে বড় বউ জিজ্ঞেস করল। বলল, 'ব্যথা নাই, জ্বালা নাই কিন্তু হ্যায় জানি আলাইয়া পড়ত্যাছে।'
ডাক্তার বললেন, 'জেনে আসুন দিকি, কুঁচকে গেছে না কি নিপ্ল, বগলের নিচটা বিচিফোলা মতো কিনা!'
বিচিফোলা শুনে বড় বউয়ের মনে হল, ছিঃ! কি অসভ্য! তারপর সরজমিনে তদন্ত সেরে এসে বললেন, 'কয়, অনেকদিন ধইরাই আপনে যা যা বললেন তা হয়েছে।'
'বয়স কত।'
'বড় ছেলের বয়স ধল্লে পরে পঞ্চান্ন হবে।'
ডাক্তার বললেন, 'ওষুধ দেব।'
বেরিয়ে গিয়ে বড়বাবুকে বললেন, 'আপনার কুকের ব্রেস্টে কি হয়েছে শুনলাম। আমার মনে হয় ক্যানসার হাসপাতালে নিয়ে দেখান ভাল। চোখে দেখিনি। তবে যা শুনলাম, তাতে ম্যামারি গ্ল্যান্ডে ক্যানসার হতে পারে।'
বড়বাবু ষোড়শ শতকে সেদিন অব্দি ছিলেন। অতি ইদানীং তিনি বিংশ শতকে এসেছেন। তেরটি সন্তানের মধ্যে মেয়েদের বিয়ে দিয়েছেন এবং ছেলেরা যে যার পথে মতে বড় হচ্ছে, বড় হয়েছে। কিন্তু এখনো তাঁর মগজের বুদ্ধি-কোষ অষ্টাদশ এবং প্রাক্-রেনেসাঁস উনিশ শতকীয় অজ্ঞানের অন্ধকারে ঢাকা। আজও তিনি বসন্তের টিকা নেন না ও বলেন, 'বসন্ত হয় ছুডলোকের। আমার টিকা লইতে লাগব না। উচ্চ বংশ, দেবদ্বিজে ভক্তিমান বংশে ও রোগ হয় না।'
ক্যানসার শুনে তিনি উড়িয়ে দিলেন ও বললেন, 'হঃ। হইলেই হইল ক্যানসার। অতই সোজা। কী শুনতে কী শুনছেন, যান, মলম দিলেই সারব। আপনের কথায় আমি বামুনের মাইয়ারে হাসপাতালে পাঠাইতে পারুম না।'
যশোদাও শুনেমেলে বলল, 'হাসপাতালে যেতে পারবনি বাপু। তার চে আমায় মত্তে বল। ছেলে বিয়োতে হাসপাতালে গেলুম না এখন যাব? হাসপাতালে গিছল বলে তো মড়িপোড়া ঠ্যাং দুটো খুঁতো করে ফিরে এল।'
বড় বউ বলল, 'সিদ্ধমলম আইনা দেই লাগাও। সিদ্ধমলমে ঠিক আরাম হইব। গুপ্ত ফোঁড়া মুখ লইয়া ফাটব।'
সিদ্ধমলমে কোনই কাজ হল না এবং ক্রমে যশোদা খাওয়া দাওয়া ছেড়ে হীনবল হল। বাঁ দিকে আঁচল রাখতে পারে না। কখনো মনে হয় জ্বালা, কখনো মনে হয় ব্যথা। অবশেষে চামড়া ফেটে ফেটে ঘা দেখা দিল। যশোদা বিছানা নিল।
ভাবগতিক দেখে বড়বাবুর ভয় হল, বুঝি তার ভিটেতে বামুন মরে। যশোদার ছেলেদের ডেকে সে ধমকে বলল, 'মা হয়, এতদিন খাওয়াইছে, এখন হ্যায় যে অসুখে মরে। তোরা নিয়া যা! হকলডি থাকতে হ্যায় কায়েতের ভিটায় মরব?'
কাঙালি একথা শুনে বড়ই কাঁদল ও যশোদার প্রায়ান্ধকার ঘরে এসে বলল, 'বউ! তুই সতীলক্ষ্মী! তোকে হেনস্তা করার পর দু বছরের মধ্যে মন্দিরের বাসন চুরি হল, আমার পিঠে ফোঁড়া হয়ে ভুগলাম, গোলাপি হারামজাদি ন্যাপলাকে ভুলিয়ে বাঙ্ ভেঙে সব্বস্ব নিয়ে তারকেশ্বরে দোকান দিলে। চ, তোরে আমি মাথায় করে রাখব।'
যশোদা বলল, 'বাতিটা জ্বাল।'
কাঙালি বাতি জ্বালল।
যশোদা অনাবৃত ও ঘা-বিজবিজে বাম স্তন দেখিয়ে বলল, 'ঘা দেখেছ? ঘায়ের গন্ধ কেমন জান? এখন নিয়ে যেয়ে কী করবে? নিতে বা এলে কেন?'
'বাবু ডাকলে।'
'বাবু তবে রাখতে চাইছে না।'_যশোদা নিঃশ্বাস ফেলল, ও বলল, 'আমারে দিয়ে কোন সুসার হবেনি জান? নিয়ে যেয়ে করবে বা কী?'
'তা হোক, কাল নে যাব। আজ ঘর পষ্কের করে রাখি। কাল নিয্যাস নে যাব।'
'ছেলেরা ভাল আচে? মাঝেমধ্যে নবলে আর গৌরটা আসত, তাও আসে না।'
'সব বেটা সাত্থপর। আমার ইয়েতে জন্ম তো? আমার মতোই অমানুষ।'
'কাল আসবে?'
'আসব_আসব_আসব।'
যশোদা সহসা হাসল। সে হাসি বড়ই বুকে দাগা-দেওয়া ও প্রাচীন স্মৃতির কথা মনে-পড়ান।
যশোদা বলল, 'হ্যাঁ গো মনে আচে?'
'কী মনে থাকবে বউ?'
'এই মাই নিয়ে তুমি কত সোহাগ কত্তে? নইলে তোমার ঘুম হতো না? কোল খালি হতো না, এটা বোঁটা ছাড়ে তো ওটা ধরে, তায় বাবুর বাড়ির ছেলেগুলো! কি করে পাত্তাম, তাই ভাবি!'
'সব মনে আছে বউ!'
কাঙালির এ কথাটি এ মুহূর্তে সত্য। যশোদার ক্লিষ্ট, শীর্ণ, কাতর চেহারা দেখে কাঙালির স্বার্থপর দেহ ও প্রবৃত্তি এবং উদরসর্বস্ব চেতনাও অতীত স্মরণে মমতাকাতর হল। সে যশোদার হাতটি ধরল ও বলল, 'তোর জ্বর?'
'জ্বর তো হয়ই। আমি ভাবি ঘায়ের তাড়সে?'
'এমন পচা গন্ধ কোত্থেকে আসছে?'
'এই ঘা হতে।' যশোদা চোখ বুজে বলল।
তারপর বলল, 'তুমি বরং সনি্নসী ডাক্তারকে দেখিও। তিনি হোমোপাথি দিয়ে গোপালের টাইফয়েড সারিয়েছিল।'
'ডাকব। কালই নে যাব তোকে!'
কাঙালি চলে গেল। সে যে বেরিয়ে গেল, ক্রাচের খটখট শব্দ যশোদা শুনতে পেল না। চোখ বুজে, কাঙালি ঘরে আছে জ্ঞানে নিস্তেজে বলল, 'দুধ দিলে মা হয়, স_ব মিছে কতা। না নেপাল-গোপালরা দেখে, না বাবুর ছেলেরা উঁকি মেরে এট্টা কতা শুধোয়।'
ঘা-গুলি শত মুখে, শত চোখে যশোদাকে ব্যঙ্গ করতে থাকল। যশোদা চোখ মেলে বলল, 'শুনচ?'
তারপরই সে বুঝল কাঙালি চলে গেছে।
রাতেই সে বাসিনীকে দিয়ে লাইফবয় সাবান আনাল ও ভোর হতে সাবান নিয়ে নাইতে গেল। গন্ধ, কী দুর্গন্ধ। বেড়াল-কুকুর ডাস্টবিনে পচলে এমন গন্ধ হয়। যশোদা চিরকাল, বাবুদের ছেলেরা স্তনবৃন্ত মুখে দেবে বলে কত যত্নে তেলে-সাবানে স্তন দুটি মার্জনা করেছে। সেই স্তন তার এমন বেইমানি করল কেন? সাবানের ঝাঁঝে চামড়া জ্বলে ওঠে। যশোদা তবু সাবান দিয়ে স্নান করে এল। মাথা ঝিমঝিম করে, সব যেন আঁধার আঁধার। যশোদার শরীরে আগুন, মাথায় আগুন। কালো মেঝেটি বড় ঠাণ্ডা। যশোদা আঁচল বিছিয়ে শুল। স্তনের ভার সে দাঁড়িয়ে সইতে পারছিল না।
সেই যে শুল যশোদা, জ্বরে অজ্ঞান ও বিবশ। কাঙালি ঠিক সময়েই এল; কিন্তু যশোদাকে দেখে সে বুদ্ধি হারিয়ে ফেলল। অবশেষে নবীন এসে ধমকে বলল, 'এরা কি মানুষ? সবগুলো ছেলেকে দুধ দিয়া বাঁচাল, তা এট্টা ডাক্তার ডাকে না? হরি ডাক্তারকে ডেকে আনছি!'
হরি ডাক্তার দেখেই বললেন, 'হাসপাতাল।'
এমন রুগি হাসপাতালে নেয় না। কিন্তু বড়বাবুর চেষ্টায় ও সুপারিশে যশোদা হাসপাতালে ভর্তি হল।
'কি হয়েছে? অ ডাক্তারবাবু, কি হয়েছে'_কাঙালি বালকের মতো কেঁদে জিজ্ঞেস করল।
'ক্যানসার।'
'মাইয়ে ক্যানসার হয়?'
'নইলে হল কি করে?'
'নিজের কুড়িটা, বাবুদের বাড়ির তিরিশটা ছেলে_খুব দুধ ছিল ডাক্তারবাবু_'
'কি বললে? কতজনকে ফিড করেছে?'
'তা পঞ্চাশ জনা তো হবে।'
'প_ঞ্চা_শ_জ_ন?'
'হ্যাঁ বাবু!'
'ওর কুড়িটা সন্তান হয়েছে?'
'হ্যাঁ বাবু।'
'গড্!'
'বাবু!'
'কি?'
'এত মাই খাওয়াত বলেই কি_?'
'তা বলা যায় না ক্যানসার কেন হয়, তা বলা যায় না। তবে বুকের দুধ যারা অতিরিক্ত খাওয়ায়_আগে বোঝ নি? একদিনে তো এমনটা হয়নি?'
'আমার কাছে ছিল না বাবু। ঝগড়া করে_'
'বুঝেছি!'
'কেমন দেখছেন?' ভাল হবে তো?
'ভাল হবে! কদিন থাকে সেই দেখ। এনেছ তো শেষ অবস্থায়। এ অবস্থা থেকে কেউ বাঁচে না।'
কাঙালি কাঁদতে কাঁদতে চলে এল। বিকেলে, কাঙালির কান্নাকাটিতে বিপর্যস্ত হয়ে বড়বাবুর মেজছেলে ডাক্তারের কাছে গেল। যশোদার জন্যে তার সামান্যই উৎকণ্ঠা ছিল, কিন্তু বাবা হুড়কো দিলেন_সে বাবার টাকার ওপর নির্ভর করে।
ডাক্তার তাকে সব বুঝিয়ে বললেন। একদিনে হয়নি, বহুদিন ধরে হয়েছে। কেন হয়েছে? তা কেউই বলতে পারে না। বুকের ক্যানসার কিভাবে বোঝা যাবে? স্তনের ওপর দিকে ভেতরে শক্ত গুলি, সেটা সরানো চলে। তারপর ক্রমে ভেতরের গুলি শক্ত ও বড় ও জমাট চাপের মতো হল। চামড়া কমলারঙা হওয়া প্রত্যাশিত, যেমন প্রত্যাশিত স্তনবৃন্তের সংকোচন। বগলের নিচে গ্ল্যান্ডটি আওরে উঠতে পারে। আল্সারেশন, অর্থাৎ ঘা যখন হল, তখন বলা চলে শেষ অবস্থা। জ্বর? সেটা দ্বিতীয় পর্যায়ে পড়বে গুরুত্বের দিক থেকে। শরীরে ঘা জাতীয় কিছু থাকলে জ্বর হতেই পারে। সেটা সেকেন্ডারি।
এতগুলি বিশেষজ্ঞ-কথা শুনে মেজছেলের মাথা গুলিয়ে গেল। সে বলল, 'বাঁচব?'
'না।'
'কদ্দিন কষ্ট পাইব?'
'মনে হয় না বেশি দিন।'
'কিছুই যখন করার নাই, কি চিকিৎসা করবেন?'
'পেইনকিলার, সেডেটিভ, জ্বরের জন্যে অ্যান্টিবায়েটিক। শরীরও তো ডাউন খুব, খুবই।'
'খাওয়া ছাইরা দিছিল।'
'কোন ডাক্তার দেখান নি?'
'দেখছিল!'
'বলেন নি?'
'বলছিল!'
'কি বলেছিলেন?'
'ক্যানসার অইতে পারে। আসপাতালে লইতে বলছিল। হ্যায় যাইতে চায় নাই।'
'চাইবে কেন? মরবে যে!'
মেজছেলে বাড়ি ফিরে এসে বলে, 'তখন যে অরুণ ডাক্তার কইল ক্যানসার হইছে তখন লইলেও বাঁচত বুঝি!'
তার মা বলল, 'অতই যদি বুঝিস তবে লইস নাই ক্যান? আমি কি বাধা দিছিলাম?'
মেজছেলে ও তার মনের কোথাও অজানা পাপবোধ ও অনুশোচনা পচা ও আবদ্ধ জলে বুদবুদের মতো জাগছিল ও নিমেষে লয় পাচ্ছিল।
পাপবোধ বলছিল_আমাদের কাছেই আছিল, কুনদিন দেখি নাই উঁকি মাইরা, কবে বা হছিল রোগ, গুরুত্ব দেই নাই। হ্যায় তো আবুইদা মানুষ, আমাদের এত জনরে পালছিল, দেখি নাই অরে। অহন হকলে আসপাতালে গিয়া মরতাছে, পুলা এতগুলা, স্বামী আছে, আমাদের আকড়াইয়া ধরছিল যহন, তহন আমাদেরই_! এইও তাজা শরীর আছিল, দুধ বাইরাইত ঠিকর দিয়া, কুনদিন ভাবি নাই হেয়ার এই রোগ অইব।
পাপবোধের লয় বলছিল_নিয়তি কে খণ্ডাইতে পারে! হেয়ার কপালে আছে ক্যানসারে মরণ_ঠেকাইব ক্যাডা। আমাদের এহানে মরলে দোষ অইত_হেয়ার স্বামীপুত্র কইত কী কইরা মরল। অহন হেই দোষ হইতে বাচছি। কেও কিছু বলতে পারব না।
বড়বাবু ওদের আশ্বস্ত করে বলল, 'অহন অরুণ ডাক্তার কইতাছে ক্যানসার হইলে কেও বাঁচে না। বামুন দিদির যেই ক্যানসার হইছে তা অইলে মাই কাইটা ফালায়, জরায়ু বাদ দেয়, হেয়ার পরও মাইন্ষে ক্যানসারে মরে। দেহ, বাবায় বামুন বইলা বড় ভক্তি দিয়া গিছে_বাবার দয়ায় আমরা বাইচা আছি। ভিটায় বামুনদিদি মরলে প্রায়চ্চিত্ত করতে অইত।'
যশোদার চেয়ে কম আক্রান্ত রোগী কত আগে মরে, যশোদা ডাক্তারদের আশ্চর্য করে প্রায় এক মাস টিকে রইল হাসপাতালে। প্রথম প্রথম কাঙালি, নবীন, ছেলেরা যাতায়াত করেছিল বটে, কিন্তু যশোদা একই রকম আছে। কোমাটিক, জ্বরে ভাজা-ভাজা, আচ্ছন্ন। স্তনের ক্ষতগুলি ক্রমেই বড় বড় হাঁ করছে এবং স্তনটির চেহারা এখন এক নগ্ন ক্ষতসদৃশ। অ্যান্টিসেপটিক লোশন নিষিক্ত পাতলা গজ কাপড়ে সেটি আবৃত, কিন্তু গলিত মাংসের তীব্র গন্ধ ঘরের বাতাসে ধূপের ধোঁয়ার মতো নীরবে ও চক্রাকারে ছড়াচ্ছে সর্বদা। তা দেখে কাঙালিদের উৎসাহে ভাটা পড়ল ও ডাক্তাররাও বললেন, 'সাড়া দিচ্ছে না? না দিলেই তো ভাল। অজ্ঞানেই সওয়া যায় না, সজ্ঞানে কেউ ঐ যমযন্ত্রণা সইতে পারে?'
'কিছু জানছে, আমরা আসি যাই বলে?'
'বলা কঠিন।'
'খাচ্চে কিছু?'
'নল দিয়ে।'
'তাতে মানুষ বাঁচে?'
'এখন যে খুব_'
ডাক্তার বুঝলেন, যশোদার এ অবস্থার জন্য তাঁর মনে অহেতুক রাগ হচ্ছে। যশোদার ওপর কাঙালির ওপর, যে সব মেয়েরা ব্রেস্ট-ক্যানসারের লক্ষণকে যথেষ্ট সিরিয়াসলি নেয় না এবং আখেরে বীভৎস নরক যন্ত্রণায় মরে, তাদের ওপর। ক্যানসার, রোগী ও ডাক্তারকে নিয়ত পরাজিত করে। একটি রোগীর ক্যানসার মানে রোগীর মৃত্যু এবং বিজ্ঞানের পরাজয়, ডাক্তারের তো বটেই। সেকেন্ডারি সিম্প্টমের ওষুধ দেওয়া যায়, খাওয়া বন্ধ হলে ড্রিপ দিয়ে শরীরকে গ্লুকোজ খাওয়ান চলে, শ্বাস নিতে ফুসফুস অপারগ হলে অঙ্েিজন_কিন্তু ক্যানসারের অগ্রগমন, প্রসারণ, ব্যাপ্তি, হত্যা, অব্যাহত থাকে। ক্যানসার শব্দটি এক সাধারণ সংজ্ঞা, এ সংজ্ঞা দ্বারা শরীরের বিভিন্ন অংশে বিভিন্ন ম্যালিগ্নান্ট গ্রোথ বোঝায়। 'দি গ্রোথ ইজ পার্পাসলেস, প্যারাসাইটিক, অ্যান্ড ফ্লারিশেস অ্যাট দি এক্সপেন্স অব দি হিউম্যান হোস্ট।' এর চারিত্র্যবৈশিষ্ট্য হল, সংক্রমিত শরীরাংশকে ধ্বংসকরণ, মেটাস্টাশিয়া দ্বারা ব্যাপ্তি, রিমুভালের পর প্রত্যাবর্তন, টক্সিমিয়া সংঘটন।
কাঙালি তার প্রশ্নের সদুত্তর না পেয়ে বেরিয়ে এল। মন্দিরে এসে সে নবীন ও ছেলেদের বলল, 'আর যেয়ে লাভ নেই। চিনতে পারে না, চোখ খোলে না, জানতে পারে না! ডাক্তার যা পারে কত্তেছে।'
নবীন বলল, 'যদি মরে যায়?'
'বড়বাবুর টেলিফোন নম্বর আচে, বলবে।'
'ধর যদি তোমারে দেকতে চায়। সতীলক্ষ্মী বউ তোমার ক্যাঙালি! কে বলবে এতগুনোর মা! শরীর দেকলে_তা কোন দিকে হেলেনি, চায়নি।'
বলতে বলতে নবীন গুম্ মেরে গেল। বস্তুত, অচৈতন যশোদার ক্ষতাক্রান্ত স্তন দেখার পর তার গাঁজা-চরস-মদজনিত ঘোলাটে মাথায় বহু দার্শনিক চিন্তা ও দেহতত্ত্বের কথা মিথুনমত্ত ঢোঁড়া সাপের মতো মন্থর খেলা করে। যেমন,_ওর জন্যেই এত আকুলি-ব্যাকুলি ছিল?_সেই মনমাতান বুকের এই পরিণাম? হোঃ! মানবদেহ কিস্সু নয়। তার তরে পাগল হয় যে সেও পাগল।
কাঙালির এত কথা ভাল লাগল না। যশোদার প্রতি তার মন থেকেই রিজেকশান এসে গিয়েছিল। সেদিন হালদার-বাড়ি যশোদাকে দেখে মন সত্যিই কাতর হয় ও হাসপাতালে নেবার পরও ব্যাকুলতা থাকে। কিন্তু সে অনুভূতি ঠাণ্ডা মেরে আসছে এখন। ডাক্তার যখন বলেছে যশোদা বাঁচবে না, সে মন থেকে যশোদাকে প্রায় অকষ্টে বাদ দিয়েছে। তার ছেলেরাও তারই ছেলে। তা ছাড়া মা তাদের কাছে অনেকদিনই দূরের মানুষ হয়ে গেছে। মা মানে চুড়ো করে বাঁধা চুল ধপধপে কাপড়, প্রবল ব্যক্তিত্ব। হাসপাতালে যে শুয়ে আছে, সে অন্য কেউ, মা নয়।
স্তনের ক্যানসারে ব্রেন কোমাটোজ হয় যশোদার বেলা সেটি মুশকিল-আসান হল।
সে যে হাসপাতালে এসেছে, হাসপাতালে আছে, তা বুঝল যশোদা এবং এও বুঝল, এই যে বিবশকারী ঘুম, এ ওষুধের ঘুম। তাতে খুব স্বস্তি হল তার এবং দুর্বল ও আক্রান্ত, আচ্ছন্ন মস্তিষ্কে মনে হল, হালদার-বাড়ির কোন ছেলেটা কি ডাক্তার হয়েছে? নিশ্চয় তার দুধ খেয়েছে বলে এখন দুধের ঋণ শুধছে? কিন্তু ওবাড়ির ছেলেরা তো স্কুল না পেরোতে কারবারে ঢোকে! যেই হোক, যারা এত করছে তারা বুকের দুর্গন্ধময় উপস্থিতিটা থেকে তাকে মুক্তি দেয় না কেন? কি দুর্গন্ধ, কি বেইমানি? এই স্তনকে সে ভাতের যোগানদার জেনে নিয়ত গর্ভ ধরে দুধে ভরে রাখত। স্তনের কাজই দুধ ধরা। কত গন্ধসাবানে স্তন মেজে পরিষ্কার রাখত, বড্ড ভারি ছিল বলে জামা পরেনি যৌবনেও।
সেডেশান কমে এলেই যশোদা চেঁচিয়ে ওঠে, 'আঃ! আঃ! আঃ!'_এবং ব্যাকুল ঘোলাটে চোখে নার্স ও ডাক্তারকে চায়। ডাক্তার এলে সাভিমানে বিড়বিড় করে বলে, 'দুধ খেয়ে এত বড়টা হলে এখন এমন কষ্ট দিচ্চ?'
ডাক্তার বলে, 'বিশ্বসংসারে দুধ-ছেলে দেখছে!'
আবার ইঞ্জেকশন ও আবার নিদ্রাচ্ছন্ন আড়ষ্টতা। যন্ত্রণা, ভীষণ যন্ত্রণা, অ্যাট দি এক্স্পেন্স অব দি হিউম্যান হোস্ট ক্যানসার সংক্রমিত হচ্ছে। ক্রমে যশোদার বাম স্তন ফেটে আগ্নেয়গিরির ক্রেটার-সদৃশ হল। পূতিগন্ধে কাছে যেতে কষ্ট হয়।
শেষে এক রাতে, যশোদা বুঝল তার পা ও হাত ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। চোখ খুলতে পারল না যশোদা, কিন্তু বুঝল, কেউ কেউ তার হাত দেখছে। সূচ বিঁধল বাহুতে। ভেতরে শ্বাসের কষ্ট। হতেই হবে। কারা দেখছে? তারা কি তার আপন কেউ? যাদের পেটে ধরেছিল বলে দুধ দেয়, ভাতের জন্য যাদের দুধ দেয়, যশোদার মনে হল সে তো বিশ্বসংসারকে দুধ দিয়েছে, তবে সে কি একা-একা মরতে পারে? যে ডাক্তার দেখছে সে, যে ওর মুখে চাদর টেনে দেবে সে, যে ওকে ট্রলিতে তুলবে সে, যে ওকে শ্মশানে নামাবে সে, যে ওকে চুলি্লতে দেবে সে ডোম, সবাই তার দুধ-ছেলে। বিশ্বসংসারকে দুধে পাললে যশোদা হতে হয়। নির্বান্ধবে একলা মরতে হয়, মুখে জল দিতে কেউ থাকে না। অথচ শেষ সময়টা কারো থাকার কথা ছিল। সে কে? কে সে? সে কে?
যশোদা মারা গেল রাত এগারটায়।
বড়বাবুর বাড়ি ফোন গেল। রাতে ওঁদের ফোন ডিস্কানেকট করা থাকে।
হাসপাতালের মর্গে যথাবিধি পড়ে থেকে যশোদা দেবী, হিন্দু ফিমেল। যথাসময়ে গাড়িতে শ্মশানে গেল ও দাহ হল। ডোমই তাকে দাহ করল। যশোদা যা-যা ভেবেছিল ঠিক তাই-তাই হল! যশোদা ঈশ্বর-স্বরূপিণী। সে যা ভাবে অন্যেরা ঠিক তাই করে, তাই করল। যশোদার মৃত্যুও ঈশ্বরের মৃত্যু। এ সংসারে মানুষ ঈশ্বর সেজে বসলে তাকে সকলে ত্যাগ করে এবং তাকে সতত একলা মরতে হয়।

No comments

Powered by Blogger.