আদালতে ডিজিএফআইয়ের সাবেক প্রধান- ডিজিএফআইয়ের তদন্তে অনীহা দেখান খালেদা জিয়া

২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার পর সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআই তদন্তের অনুমতি চাইলে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া তা দেননি। বাবরের নির্দেশে ঘটনার পর রাতেই হামলার আলামত অবিস্ফোরিত গ্রেনেড ধ্বংস করা হয়।


আর বিদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয় গ্রেনেড সরবরাহকারী তখনকার শিক্ষা উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুর ভাই মাওলানা তাজউদ্দিনকে।
ডিজিএফআইয়ের সাবেক মহাপরিচালক (ডিজি) মেজর জেনারেল (অব.) সাদেক হাসান রুমি আদালতে এই সাক্ষ্য দিয়েছেন। আদালতে তিনি ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলায় তারেক, পিন্টু ও বাবর জড়িত বলে মুফতি হান্নান যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুর সরকারি বাসভবনে মুফতি হান্নান, পিন্টু, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, মাওলানা তাজউদ্দিন, আবু তাহেরসহ আরও কয়েকজন ওই হামলার পরিকল্পনা করেছেন বলে তাঁর অধীনস্থ দুই কর্মকর্তা তাঁকে জানিয়েছেন।
গতকাল সোমবার ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১-এর বিচারক শাহেদ নূর উদ্দিন জেনারেল সাদেক হাসান রুমীর সাক্ষ্য গ্রহণ করেন। আদালত ১১ নভেম্বর আসামিপক্ষের জেরার জন্য দিন ধার্য করেছেন।
সাক্ষ্য দেওয়ার সময় আসামিপক্ষের আইনজীবীরা জেনারেল সাদেক হাসানকে দফায় দফায় বাধা দেন। সরকারি কৌঁসুলিরা অভিযোগ করেন, সাক্ষীকে বিভ্রান্ত করতে বিশেষ করে খালেদা জিয়া, তারেক রহমান, লুৎফুজ্জামান বাবর ও আবদুস সালাম পিন্টুর নাম বলার পরপরই আসামিপক্ষ বিভিন্নভাবে সাক্ষীকে বাধা দিয়েছে।
জেনারেল সাদেক হাসান প্রথমে ২১ আগস্টে সংঘটিত হত্যা মামলায় সাক্ষ্য দেন। একই সাক্ষ্য তিনি ওই ঘটনায় করা বিস্ফোরক মামলায় ব্যবহারের জন্য অনুরোধ করেন। আসামিপক্ষের আইনজীবীরা একাধিক দরখাস্ত দিয়ে এতে আপত্তি তোলেন। তাঁরা আদালতকে বলেন, গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে দেওয়া কোনো সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য হবে না। এ বিষয়ে উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্ত রয়েছে। তা ছাড়া এক মামলার সাক্ষ্য অন্য মামলায় গ্রহণযোগ্য নয়।
রাষ্ট্রপক্ষে এই মামলার প্রধান সরকারি কৌঁসুলি সৈয়দ রেজাউর রহমান আদালতকে বলেন, একই ঘটনায় দুটি মামলা এবং একই সঙ্গে একই আদালতে বিচারকাজ চলছে। তাই এভাবে সাক্ষ্য দেওয়ার ক্ষেত্রে আইনগত কোনো বাধা নেই। তিনি অভিযোগ করেন, মামলার বিচারের প্রক্রিয়া বিলম্ব করতে আসামিপক্ষ কৌশল হিসেবে এই দাবি করছে।
বিচারক বলেন, ‘আপনারা চাইলে আমি এজলাসে বসেই সাক্ষ্য লিপিবদ্ধ করতে পারি। এরপর আপনারা জেরা করেন।’ তখন আসামিপক্ষের আইনজীবীরা জেরার জন্য পরবর্তী তারিখ ধার্য করার আবেদন জানান।
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে স্থাপিত বিশেষ আদালতে এই মামলার বিচারকাজ চলছে। সাক্ষ্য গ্রহণের আগে কারাগারে আটক আসামিদের আদালতে আনা হয়। গতকাল পর্যন্ত এই মামলায় ৬৪ জন সাক্ষ্য দিলেন।
জেনারেল সাদেক হাসান তাঁর সাক্ষ্যে আদালতকে বলেন, ‘২০০২ সালে আমি ডিজিএফআইয়ের ডিজি (মহাপরিচালক) হিসেবে কাজ শুরু করি। ২০০৪ সালে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল রেজ্জাকুল হায়দার ডিজিএফআইয়ের কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোর (সিআইবি) পরিচালক হিসেবে যোগ দেন। রেজ্জাকুল হায়দার তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর ও তারেক রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। কমান্ড না মানায় তাঁকে বাদ দেওয়ার জন্য আমি প্রস্তাব করেছিলাম। কিন্তু বাবর ও তারেক রহমানের ইচ্ছাতে রেজ্জাকুল হায়দারকে ওই পদে রাখা হয়।’ তিনি বলেন, রেজ্জাকুল হায়দার তারেক রহমান ও লুৎফুজ্জামান বাবরের কথায় বেশি গুরুত্ব দিতেন। এ সময় আসামিপক্ষের আইনজীবীরা জেনারেল সাদেককে বক্তব্য দিতে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেন।
জেনারেল সাদেক বলেন, ‘২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার বিষয়টি তৎকালীন কর্নেল ইমাম আমাকে জানান। ওই সময় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ঢাকার বাইরে থাকায় তাঁর রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরীকে বিষয়টি জানাই। হারিছ চৌধুরী হামলার বিষয় না শুনেই সংযোগ কেটে দেন। এরপর স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বাবরকে জানালে তিনি “শুনেছি” বলে ফোনের সংযোগ কেটে দেন।’
সাদেক হাসান আদালতকে বলেন, ‘ঘটনার পরদিন আমি তখনকার প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করি। ঘটনায় দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করার লক্ষ্যে ডিজিএফআইয়ের নেতৃত্বে একটি অনুসন্ধান দল গঠনের অনুমতি চাই। প্রধানমন্ত্রী তখন বলেন, তদন্তের জন্য একটি কমিটি করে দেওয়া হবে, আপনাদের তদন্তের প্রয়োজন নেই।’
সাদেক হাসান সাক্ষ্যে বলেন, ‘এরপর আমি সিআইবির পরিচালক রেজ্জাকুল হায়দার ও ডিটাচমেন্ট কমান্ডার ইমামকে ঘটনার বিস্তারিত জানতে এবং ভিডিও ফুটেজ সংগ্রহ করতে নির্দেশ দিই। পরদিন রেজ্জাকুল হায়দার আমাকে জানান, লুৎফুজ্জামান বাবর ঘটনার রাতেই উদ্ধার হওয়া অবিস্ফোরিত গ্রেনেড দ্রুত ধ্বংস করার নির্দেশ দিয়েছেন। বাবরের নির্দেশ পেয়ে সেনাবাহিনীর লোক পাঠিয়ে ঘটনাস্থলের নিকটবর্তী ওসমানী উদ্যানে তা ধ্বংস করা হয়েছে।’
জেনারেল সাদেক সাক্ষ্যে আরও জানান, এ ঘটনার বিষয়ে একাধিক সভা করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তাতে ডিজিএফআইয়ের পক্ষে উপস্থিত থাকতেন রেজ্জাকুল হায়দার। সিলেটে ব্রিটিশ হাইকমিশনারের ওপর গ্রেনেড হামলা এবং ২০০৫ সালে সারা দেশে একযোগে গ্রেনেড হামলা হয়।
এরপর সাদেক হাসান বলেন, ‘আফগান-ফেরত হুজি নেতা মাওলানা আবদুস সালাম ও শেখ ফরিদ ডিজিএফআইয়ের সোর্স হিসেবে কাজ করতেন। এ জন্য তাঁদের আর্থিক সুবিধা দেওয়া হতো। আবদুস সালামের তথ্যের ভিত্তিতে সিলেট থেকে বিপুলকে (শাহেদুল আলম) আটক করা হয়। তিনি সব বোমা হামলায় তাঁর ও তাঁর নেতাদের জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেন। তিনি জানান, মুফতি হান্নান এসব গ্রেনেড সরবরাহ করেছেন। বিপুলের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে র্যা ব মুফতি হান্নানকে গ্রেপ্তার করে। তিনি ২০০৬ সালের আগস্ট মাসে বিপুলের দেওয়া সব তথ্য স্বীকার করেন। তিনি জানান, তাঁরা মাওলানা তাজউদ্দিনের কাছ থেকে গ্রেনেড সংগ্রহ করতেন। তাজউদ্দিন শিক্ষা উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুর ছোট ভাই। মুফতি হান্নান আরও স্বীকার করেন, ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা মামলায় পিন্টু, বাবর ও তারেক রহমান জড়িত।’
জেনারেল সাদেক বলেন, ‘মুফতি হান্নান গ্রেনেড হামলার কথা স্বীকার করে বলেন, সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুর ভাই মাওলানা তাজউদ্দিন গ্রেনেড সরবরাহ করেছেন। মুফতি হান্নান আরও জানান যে আবদুস সালাম পিন্টুর সরকারি বাসভবনে তিনি পিন্টু, বাবর, মাওলানা তাজউদ্দিন, আবু তাহেরসহ আরও কয়েকজন গ্রেনেড হামলার পরিকল্পনা করেন। তাতে আবদুস সালাম পিন্টু ও লুৎফুজ্জামান বাবর গ্রেনেড হামলার সব ধরনের প্রশাসনিক সহায়তা প্রদানের নিশ্চয়তা দেন। এসব তথ্য ডিজিএফআইয়ের তখনকার কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার আমিন ও লে. কর্নেল সাইফুল ইসলাম জোয়ারদার তাঁকে জানান।
এই বক্তব্যের সময় আবার আসামিপক্ষের আইনজীবীরা আপত্তি তোলেন।
জেনারেল সাদেক সাক্ষ্যে বলেন, ‘র্যা বের তখনকার অতিরিক্ত আইজিপি আবদুল আজিজ সরকার জঙ্গি নেতা মাওলানা তাজউদ্দিনকে গ্রেপ্তার করার জন্য ডিজিএফআইয়ের সহায়তা চান। কিন্তু সাইফুল ইসলাম জোয়ারদার এ বিষয়ে আমাকে বলেন, এতে সরকার বিব্রতকর অবস্থায় পড়বে। ব্রিগেডিয়ার আমিন ও সাইফুল ইসলাম আমাকে জানান, মাওলানা তাজউদ্দিন ও মুফতি হান্নানের দেওয়া তথ্য এক। আরও জানান, বিষয়টি তাঁরা তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীকে জানানোর জন্য লুৎফুজ্জামান বাবর ও প্রধানমন্ত্রীর এপিএস সাইফুল ইসলাম ডিউককে জানিয়েছেন।’
সাক্ষ্যে জেনারেল সাদেক বলেন, ‘তাজউদ্দিনের বিষয়ে কী ব্যবস্থা নেওয়া যায়, প্রধানমন্ত্রীর বরাত দিয়ে সাইফুল ইসলাম ডিউক ও লুৎফুজ্জামান বাবর তা জানতে চান। কিন্তু ব্রিগেডিয়ার আমিন ও সাইফুল ইসলাম জোয়ারদার আমাকে বলেন, তাজউদ্দিনকে বিদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হতে পারে। তাঁরা তাঁকে বিদেশে পাঠানোর ব্যবস্থাও করেছেন। আরও জানান, তাজউদ্দিন পাকিস্তানে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। তখন আমি বলি, তোমরা যখন সব ব্যবস্থা করেই ফেলেছ, তখন আমাকে না জানালেই পারতে।’
জেনারেল সাদেক বলেন, ‘সাইফুল ইসলাম ডিউক তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার বোনের ছেলে ও সাইফুল ইসলাম জোয়ারদারের ভায়রা ভাই। ব্রিগেডিয়ার আমিনের সঙ্গে এঁদের সম্পৃক্ততার কারণে ডিজিএফআইয়ের অনেক তথ্য আমার কাছে গোপন রাখা হতো। একপর্যায়ে এ টি এম আমিনকে বদলির জন্য বলা হলেও তা করা হয়নি।’
আদালতে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী সৈয়দ রেজাউর রহমানকে সহায়তা করেন আবু আবদুল্লাহ ভূঁইয়া ও আকরাম উদ্দিন। আসামিপক্ষে ছিলেন: আবদুস সোহান তরফদার, মাহবুব উদ্দিন, সানাউল্লাহ মিয়া, মোহাম্মদ আলী প্রমুখ আইনজীবী।
গতকাল সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ভাগনে সাইফুল ইসলাম ডিউক, জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদসহ আসামিদের ২৬ জনকে কারাগার থেকে আদালতে হাজির করা হয়। জামিনে থাকা সাত আসামিও হাজির ছিলেন আদালতে। এই মামলায় তারেক রহমান, হারিছ চৌধুরী, ব্রিগেডিয়ার আমিন, সাইফুল ইসলাম জোয়ারদারসহ ১৯ জন পলাতক আছেন।

No comments

Powered by Blogger.