সমকালীন প্রসঙ্গ-মিয়ানমার ও বাংলাদেশে বৌদ্ধ-মুসলমান সাম্প্রদায়িক সংঘাত সৃষ্টির চক্রান্ত by বদরুদ্দীন উমর

মিয়ানমারে ক্ষমতার দোরগোড়ায় দাঁড়ানো বিরোধীদলীয় নেত্রী অং সাং সু চি কয়েকদিন আগে বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তার দেশের পশ্চিম অঞ্চলে রাখাইন রাজ্যে বৌদ্ধ ও রোহিঙ্গা মুসলমানদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ প্রসঙ্গে বলেছেন,


রোহিঙ্গা সমস্যার গোড়ায় কী রয়েছে সেটা দেখার আগে রোহিঙ্গাদের অধিকারকে সমর্থন জানিয়ে তিনি তার নৈতিক নেতৃত্বের অপব্যবহার করতে চান না! তিনি আরও বলেন, এই সংঘর্ষে বৌদ্ধ এবং রোহিঙ্গা মুসলমান দুই পক্ষই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কাজেই তিনি এই বিতর্কে কোনো পক্ষ নিতে চান না!
এ রকম একজন জননেত্রীকে শান্তি পুরস্কার দিয়ে নোবেল কমিটি যে উচিত কাজ করেছে এ জন্য তাদের অভিনন্দন জানানো দরকার! তবে এটা কোনো নতুন বা ব্যতিক্রমী ব্যাপার নয়। নোবেল শান্তি পুরস্কার প্রায় সবসময়ই এভাবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। কখনও কখনও নিজেদের মুখ রক্ষার জন্য তারা তাদের পেয়ারের লোকের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে কোনো কোনো ভালো লোককে এ পুরস্কার দিলেও শান্তি পুরস্কার যাদের দেওয়া হয় তারা সাম্রাজ্যবাদের খেদমতগার ছাড়া অন্য কিছু নয়। শুধু তাই নয়, এই শান্তি পুরস্কারপ্রাপ্তদের মধ্যে হিংস্র যুদ্ধবাজরাও থাকে। কিসিঞ্জার থেকে নিয়ে বারাক ওবামা পর্যন্ত এ ধরনের দৃষ্টান্তের অভাব নেই। মিয়ানমারের বর্তমান পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গা প্রসঙ্গে সু চির উপরোক্ত অবস্থান গুরুত্বপূর্ণ এবং এই অবস্থানকে ঠিকমতো বোঝার জন্য তার রাজনৈতিক অবস্থান ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের চরিত্র বোঝা দরকার। দীর্ঘদিন মিয়ানমারে সামরিক জান্তার শাসন বিরোধিতা করতে গিয়ে তিনি তাদের হাতে আটক থেকেছেন। নির্বাচিত হওয়া সত্ত্বেও তাকে তারা ক্ষমতায় যেতে দেয়নি। এ কাজ করলেও একই সঙ্গে তারা আবার আরও দীর্ঘদিন থেকে মিয়ানমার বা বার্মায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ সাম্রাজ্যবাদীদের কোনো অবস্থান তৈরি করতে দেয়নি। বিশ্বব্যাংক-আইএমএফের মতো সাম্রাজ্যবাদী অর্থ সংস্থাকে দেশ থেকে বিতাড়িত করেছে। মিয়ানমারের সামরিক সরকার একটি ফ্যাসিস্ট সরকার। তাদের ফ্যাসিস্ট শাসন শেষ পর্যন্ত সংকটাপন্ন হওয়ায় তারা সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে আপসের লাইন গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছে। এ কারণেও সু চিকে দীর্ঘদিন আটক রাখার পর তাকে সক্রিয় রাজনীতিতে আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। শুধু তাই নয়, সাম্রাজ্যবাদীদের দ্বারা 'রপড়হ ড়ভ ফবসড়পৎধপু' বা 'গণতন্ত্রের প্রতিমূর্তি' হিসেবে খেতাবপ্রাপ্ত সু চিকে ক্ষমতায় বসাতেও প্রস্তুত হয়েছে। মিয়ানমারের ফ্যাসিস্ট শাসকশ্রেণীর শাসন রক্ষা ও পরিচালনার জন্য শাসন ব্যবস্থার কিছু পরিবর্তন এখন তাদের জন্য জরুরি হয়েছে। এই পরিবর্তনই এখন দেশটিতে হতে যাচ্ছে। কিন্তু এই পরিবর্তনের মাধ্যমে মিয়ানমারে প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে এটা মনে করার কারণ নেই। সাম্রাজ্যবাদীরা গণতন্ত্র বলতে বোঝাতে চায়, ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা গঠিত সরকার। এভাবে গঠিত সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর জনগণের ওপর চরম অর্থনৈতিক শোষণ ও ফ্যাসিস্ট নির্যাতন চালিয়ে গেলেও তাদের এই 'গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার' কোনো ক্ষতি হয় না। সে শাসন গণতান্ত্রিকই থাকে! মিয়ানমারেও কিছু দিনের মধ্যে এটা দেখা যাবে। মিয়ানমারে গণতন্ত্রের প্রতিমূর্তি সু চির শাসনের এই চরিত্র ও ভবিষ্যৎ সেখানে বিদ্যমান রোহিঙ্গা পরিস্থিতি এবং এই মুহূর্তে সেখানে রোহিঙ্গাদের ওপর সামরিক বাহিনীর উস্কানিতে তাদের ওপর হামলা বিষয়ে সু চির বক্তব্য থেকেই স্পষ্টভাবে বোঝা যায়। এতদিন ধরে মিয়ানামারে সামরিক বাহিনী রোহিঙ্গাদের ওপর যে জাতিগত নিপীড়ন চালিয়ে এসেছে, তাদের সব রকম সাংগঠনিক অধিকার থেকে বঞ্চিত রেখেছে তার কোনো পরিবর্তন যে সুচির নেতৃত্বে সম্ভব নয়, এটা তিনি তার উপরোক্ত বক্তব্যের মাধ্যমে বেশ পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিয়েছেন।
সুচি বলেছেন, রোহিঙ্গা সমস্যার গোড়ায় কী রয়েছে সেটা দেখার আগে তিনি রোহিঙ্গাদের অধিকার সমর্থন করতে পারেন না। সেটা করলে নাকি তার 'নৈতিক নেতৃত্বের' অপব্যবহার হবে! কথাটি অদ্ভুত ও বিস্ময়কর দুই-ই বটে। তার 'নৈতিক নেতৃত্ব' বলতে তিনি কী বোঝেন সেটা তিনিই জানেন। তার এই নেতৃত্ব তিনি কীভাবে রক্ষা করবেন সেটা তার নিজস্ব ব্যাপার। কিন্তু রোহিঙ্গা সমস্যার গোড়ায় কী রয়েছে সেটা 'গণতন্ত্রের প্রতিমূর্তি' হিসেবে তিনি জানেন না এটা বিস্ময়কর। মিয়ানমারের একজন গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক নেতা হিসেবে তিনি রোহিঙ্গা সমস্যার গোড়ায় কী আছে সেটা জানেন না এটা কে বিশ্বাস করবে? মিয়ানমার ও তার বাইরে সারা দুনিয়ায় রোহিঙ্গা পরিস্থিতি নিয়ে বিগত তিরিশ বছর ধরে অব্যাহত আলোচনা চলে আসছে। কিন্তু সু চি এ বিষয়ে কিছুই এখনও পর্যন্ত জানেন না! এ বিষয়ে ভবিষ্যতে অবগত হয়েই তিনি রোহিঙ্গাদের বিষয়ে কোন সিদ্ধান্তে আসতে পারেন! তার আগে কিছু করলে তার নৈতিক নেতৃত্বের অপব্যবহার হবে!
এসব থেকেই বোঝা যায় যে, বর্তমানে মিয়ানমার থেকে নিয়ে বাংলাদেশ পর্যন্ত যেসব ঘটনা রোহিঙ্গা মুসলমানদের নিয়ে ঘটছে তাকে সরলভাবে দেখার কোনো সুযোগ নেই। এ অঞ্চলে যে এক নতুন সাম্রাজ্যবাদী খেলা শুরু হচ্ছে সেই খেলার শর্ত তৈরির ক্ষেত্রে মিয়ানমারে বৌদ্ধ ও রোহিঙ্গা মুসলমানদের মধ্যে সংঘর্ষ পরিস্থিতি বড় রকম ভূমিকা পালন করবে। বৌদ্ধ ও মুসলমানদের মধ্যে সম্পূর্ণ নতুনভাবে বাংলাদেশে যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত সৃষ্টি করা হচ্ছে সেটাও এরই সঙ্গে সম্পর্কিত। গত সেপ্টেম্বর মাসে কক্সবাজার অঞ্চলে সৃষ্ট বৌদ্ধ-মুসলমান পরিস্থিতিকে এদিক দিয়ে কোনো বিচ্ছিন্ন ও নিতান্ত স্থানীয় ব্যাপার মনে করার কারণ নেই। ইতিমধ্যেই এই ঘটনার যেসব তথ্য পাওয়া গেছে তার থেকেই স্পষ্ট যে, এই পরিস্থিতি কক্সবাজারের সাধারণ মুসলমানদের দ্বারা সৃষ্ট নয়। এই হামলা তাদের দ্বারা পরিচালিত নয়। এটা পরিচালিত হয়েছে একটি চক্রান্তমূলক পরিকল্পনার অংশ হিসেবে। এতে রাজনৈতিক দলগুলো কেন্দ্রীয়ভাবে সম্পর্কিত না থাকলেও প্রত্যেক দলের লোক এবং স্থানীয় প্রশাসন জড়িত ছিল। বাইরের শক্তি দ্বারা সংগঠিত হয়ে তারা এই বিধ্বংসী হামলায় অংশগ্রহণ করেছে। বাংলাদেশের কোনো কোনো রাজনৈতিক দলের নেতা এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এই ঘটনার জন্য রোহিঙ্গাদের দায়ী করলেও তার ভুয়া চরিত্র এতই স্পষ্ট যে, এই বক্তব্য সকলেই প্রত্যাখ্যান করেছে। যে রোহিঙ্গা শরণার্থীরা বাংলাদেশের আশ্রয় শিবিরগুলোতে অমানবিক জীবনযাপন করছে তারা হঠাৎ করে বৌদ্ধদের ওপর এই ব্যাপক আক্রমণ পরিচালনার জন্য হাজার হাজার ভাড়া করা লোককে ট্রাকে চড়িয়ে ঘটনাস্থলে হাজির করেছে একথা বলার চেয়ে বড় মিথ্যা ও মতলববাজি আর কী হতে পারে?
এ ধরনের মতলববাজির মাধ্যমে বাংলাদেশে বৌদ্ধ-মুসলমান সম্পর্ক তিক্ত করা ও সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের ক্ষেত্র তৈরি রাখার চেষ্টা কিছু দেশীয় এজেন্টদের মাধ্যমে বাইরের শক্তি করলেও এখানকার জনগণ এর বিরুদ্ধে যেভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছে এটা একটা বড় ইতিবাচক ব্যাপার। মিয়ানমারের পরিস্থিতিকে বাংলাদেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরির উদ্দেশ্যে ব্যবহারের চেষ্টা প্রতিহত করার জন্য জনগণের প্রতিরোধ থেকে কার্যকর কিছু নেই। এর কোনো বিকল্প নেই।
৫.১১.২০১২

বদরুদ্দীন উমর :সভাপতি
জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল

No comments

Powered by Blogger.