জাদুর নাম অজন্তা মেন্ডিস by মোঃ এনামুল হাসান

টি২০ বিশ্বকাপের উদ্বোধীন ম্যাচে জিম্বাবুইয়ের বিরুদ্ধে স্পিন জাদু দেখিয়ে স্বল্পদৈর্ঘ্যরে ক্রিকেটে বোলিংয়ের নতুন রেকর্ড গড়েছেন স্বাগতিক শ্রীলঙ্কান বোলার অজন্তা মেন্ডিস। ক্যারিয়ারের সেরা বোলিংয়ের পথে ৪ ওভারে মাত্র ৮ রান দিয়ে ৬ উইকেট শিকার করেন একই সঙ্গে অফ ও লেগস্পিন করতে পারঙ্গম মেন্ডিস।


এটি কেবল তাঁর ক্যারিয়ার সেরাই নয়, বিশ্বকাপ ও টি২০ ইতিহাসের সেরা বোলিংয়ের নতুন রেকর্ডও। টি২০তে এর আগে অজন্তার ক্যারিয়ার সেরা বোলিং ছিল ১৬ রান দিয়ে ৬ উইকেট শিকার গত বছর যেটি তিনি করেছিলেন অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে। আর বিশ্বকাপে উমর গুলের রেকর্ড ভেঙ্গে এবার তুলে নিলেন ছয় জিম্বাবুইয়ান ব্যাটসম্যানকে। ২০০৯ বিশ্বকাপে নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে পাক পেসার গুলের ৬ রান দিয়ে ৫ উইকেট শিকারই ছিল এতদিন টি২০ বিশ্বকাপে সেরা বোলিংয়ের নজির। জিম্বাবুইয়ের বিরুদ্ধে নব ইতিহাস সৃষ্টির পথে ইনিংসের এগারোতম ওভারে প্রথমবারের মতো বল করতে এসে মাত্র তিন বলের ব্যবধানে ক্রেইগ অরভিন ও ম্যালকম ওয়ালারকে ফিরিয়ে দিয়ে শুরু করেন। অতঃপর দলীয় ষোলোতম ওভারে নিজের দ্বিতীয় স্পেলে প্রসপার উৎসেয়া, কাইল জার্ভিস, এলটন চিগম্বুরা ও গ্রায়েম ক্রেমারকে সাজঘরে পাঠিয়ে বিশ্বকাপে এক ইনিংসে ৬ উইকেট নিয়ে রেকর্ড বইয়ে নিজের নামটি নতুন করে খোদাই করে নেন লঙ্কান স্পিন সেনসেশন অজন্তা। ম্যাচে জিম্বাবুইয়েকে ৮২ রানের বড় ব্যবধানে হারিয়ে টি২০ বিশ্বকাপে শুভ সূচনা করে স্বাগতিক শ্রীলঙ্কা। লঙ্কানদের ১৮২ রানের জবাব দিতে নেমে ১৭ ওভারে ১০০ রানে অলআউট হয় জিম্বাবুইয়ে। টি২০ ইতিহাসের সেরা বোলিংয়ের পথে ৬ উইকেট শিকার করে ম্যাচসেরাও হন ২৭ বছর বয়সী অফ লেগের সংমিশ্রণে অন্য প্রজাতির এক স্পিনার অজন্তা। মূলত তাঁর জাদুকরী বোলিংয়ের কাছেই অসহায় আত্মসমর্পণ করে ব্রেন্ডন টেইলরের দল। আসরের প্রথম ম্যাচেই দারুণ এ জয়ে রেকর্ড উইকেট তুলে নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখায় অজন্তাকে প্রশংসাবাণে ভাসান শ্রীলঙ্কা অধিনায়ক মাহেলাসহ অনেকে। যেটা দেখা যায়, টেস্ট ক্রিকেটে হরহামেশাই ছয় উইকেট তুলে নিয়ে থাকেন বোলাররা। ওয়ানডে ক্রিকেটেও এমন কীর্তির নজির কম নয়। তাই বলে ব্যাটসম্যানদের দাপটে বোলাররা যেখানে সবসময় অসহায় সেই টি২০ ক্রিকেটেও! এ ভার্সনের নামই হচ্ছে মারকাটারি ব্যাটিং। ব্যাটসম্যানদের সুপার হিরো হয়ে ওঠা। বোলারদের জন্য যা নরকপুরী। একজন বোলার সুযোগ পান সর্বোচ্চ চার ওভার বোলিংয়ের, যেখানে ব্যাটসম্যানরা একেকজন থাকেন রুদ্র খুনীর মূর্তিতে। সেখানে বোলারদের কি-ইবা করার থাকে? ইনিংসে পাঁচ বা ততোধিক উইকেট নেয়াও তো আকাশ-কুসুম কল্পনার শামিল। টি২০ ক্রিকেটে তেমন আকাশ-কুসুম ঘটনা ঘটেছে মাত্র আটবার। আটবারের মধ্যে একজনই যদি ঘটনাটি দু’বার ঘটান, তাহলে বিস্ময়ে চোখ বন্ধ হয়ে যাওয়ারই কথা। আর সেই বিস্ময়কর ঘটনাই ঘটিয়ছেন ‘এক ক্যারম স্পিনার’ লঙ্কান ঘূর্ণিবলের নতুন জাদুকর অজন্তা মেন্ডিস! বিস্ময়ের এখানেই শেষ নয়। ইনিংসে পাঁচটি করে নয়, ছয়টি করে উইকেট নিলেন দু’বার। প্রথমে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ঘরের মাটিতে ১৬ রান দিয়ে। আর দ্বিতীয়বার ঘটালেন জিম্বাবুইয়ের বিরুদ্ধে এবারে বিশ্বাকপের প্রথম ম্যাচেই। এবারের ঘটনায় হৈচৈ পড়ে যায়। তা সঙ্গত কারণেই। ছয় উইকেট দখলের জন্য খরচ করেন মাত্র ৮ রান। সঙ্গে দুই মেডেন ওভার! এটিকে ক্রিকেট দুনিয়ায় অজন্তা মেন্ডিসের দ্বিতীয় জীবনই বলতে হবে। অভিষেকেই সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন। সাফল্যের পদচারণা ছিল টেস্ট, ওয়ানডে ও টি২০ তিন ঘারনার ক্রিকেটেই। আবার এই যে ছয় উইকেট নিয়ে রেকর্ড গড়লেন সেই ‘ছয়’ সংখ্যাটি অজন্তার খেলোয়াড়ি জীবনে যেন আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে আছে! টেস্ট ক্রিকেটে দু’বার তিনি নিয়েছেন ছয়টি করে উইকেট। একদিনের ম্যাচেও আছে একবার। টেস্ট সিরিজের অভিষেকেই ভারতের মতো শক্তিশালী ব্যাটিং লাইন গুঁড়িয়ে দিয়ে তিন টেস্টে ২৬ উইকেট নিয়েছিলেন। ১২ টেস্টে ৫০ উইকেটের মাইলফলক স্পর্শ করেন। টেস্টে মাইলফলক গড়তে গিয়ে তিনি কাউকে পেছনে ফেলতে না পারলেও একদিনের ম্যাচে তিনি সাবাইকে পেছনে ফেলে দেন ১৯ ম্যাচে ৫০ উইকেট নিয়ে। এবার টি২০ ক্রিকেটেও তিনি একই কীর্তি অর্জনের দ্বারপ্রান্তে। মাত্র ২২ ম্যাচেই তাঁর উইকেট ৪৬টি! তার ওপরে থাকা তিন বোলার সাঈদ আজমল ৪২ ম্যাচ ৬০টি, উমর গুল ৪৩ ম্যাচে ৫৯ এবং গ্রায়েম সোয়ান ৫০ ম্যাচে ৫৮টি উইকেট।
টি২০ ক্রিকেটেও তিনি এতদিন এ রেকর্ড গড়ে নিজেকে অন্যদের ধরাছোঁয়ার বাইরে নিয়ে যেতে পারতেন। কিন্তু মন্দ কপাল। এ রকম কীর্তিগাথা নৈপুণ্যের পরও তিনি নিজেকে ধারাবাহিক রাখতে পারেননি। বাদ পড়তে হয়েছিল তিন ধরনের ক্রিকেট থেকেই। টি২০ ক্রিকেটে এবার ফিরেছেন ১৫ মাস পর। একদিনের ক্রিকেটে ফিরতে তার অবশ্য খুব বেশি সময় লাগেনি। শ্রীলঙ্কা পাঁচটি ম্যাচ খেলার পরই তিনি ফিরে আসেন দলে। অবশ্য টেস্টে এখনও ফিরতে পারেননি। ইতোমধ্যে ১৬টি টেস্ট খেলেছে তাঁর দেশ শ্রীলঙ্কা। এদিকে টি২০ ম্যাচে ফিরেই তিনি বাজিমাত করেন অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ছয় উইকেট নিয়ে। মাঝে একটি ম্যাচে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে এক উইকেট নেয়ার পর আবার জিম্বাবুইয়ের বিরুদ্ধে ছয় উইকেট। খুদে ক্রিকেটের সেরা আয়োজনে ছয় উইকেট নিয়ে অজন্তা মেন্ডিস আবারও আলোচনার পাদপ্রদীপের আলোয় উঠে এসেছেন। উপমহাদেশের সেরা তিন দলের একটি শ্রীলঙ্কা। তিন দলই একদিনের ম্যাচে শিরোপা জিতেছে। আবার টি২০ ক্রিকেটে ভারত ও পাকিস্তান শিরোপা জিতলেও শ্রীলঙ্কার কাছে সেটি অধরাই রয়ে গেছে। সেখানে তারা এবার ‘বাতি’ জ্বালাতে চায়। সে বাতিঘরের ম্যাচের কাঠি হয়ে উঠতে পারেন অজন্তা।

No comments

Powered by Blogger.