ব্যাংকিং খাত ॥ অস্থিরতা সৃষ্টির চেষ্টা উদ্দেশ্য- পদ্মা সেতু বাস্তবায়নে বাধা সৃষ্টি ॥ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বাধাগ্রস্ত করা ॥ নির্বাচন সামনে রেখে সরকারকে বিব্রত করা by শাহ আলম খান

দেশীয় ব্যাংকিং খাতে পরিকল্পিতভাবে অস্থিরতা তৈরির অপচেষ্টা চলছে। সরকারী ব্যাংকগুলোকেই প্রধানত এ ক্ষেত্রে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করা হচ্ছে। ভিন্নমতের ও পথের দেশী-বিদেশী শক্তি ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং উচ্চমার্গের ব্যক্তিরা এই অপচেষ্টার সঙ্গে লিপ্ত বলে জানা গেছে।


দেশের ভেতর ও বাইরে সমানভাবে ওই মহলবিশেষের অপতৎপরতা চলছে। এদের লক্ষ্যই হচ্ছে অনুসারীদের দিয়ে পরিকল্পিতভাবে দেশের আর্থিক খাতে একটি বড় ধরনের বিশৃক্স্খলা তৈরি করা।
এ ব্যাপারে রাষ্ট্রায়ত্ত সংশ্লিষ্ট ব্যাংকাররা দাবি করছেন, একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে সংঘটিত অনিয়মকে কেন্দ্র করে অপর চারটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংককে জড়িয়ে ফেলা, অথচ একই ঘটনায় আরও আঠারোটি বেসরকারী ব্যাংকের সম্পৃক্ততা থাকা সত্ত্বেও শুধু সরকারী ব্যাংকগুলোকেই লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করা সেই অপচেষ্টারই শামিল। সংশ্লিষ্টদের মতে, দীর্ঘসূত্রতার মধ্যদিয়ে হলেও পোড় খাওয়া পুঁজিবাজার যখন আবারও জনমনে আশার আলো দেখাচ্ছে। ঠিক তখনই আর্থিক খাতের অন্যতম স্তম্ভ ব্যাংকিং খাতে পরিকল্পিতভাবে অস্থিরতা সৃষ্টির মাধ্যমে ধ্বংসের পাঁয়তারা করা হচ্ছে। এর অন্যতম বড় কারণ বর্তমান সরকার পদ্মা সেতুর মতো বৃহৎ প্রকল্পে অর্থায়ন করতে গেলে প্রাথমিক যে অর্থায়নের প্রসঙ্গটি আসবে সে ক্ষেত্রে সরকারী ব্যাংকগুলোর বড় ধরনের অংশগ্রহণ থাকতে পারে। দেশের ব্যাংকিং লেনদেন পরিচালনাকারীদের মধ্যে ৮০ শতাংশই রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর আমানতকারী। আবার বিদেশ থেকে প্রেরিত রেমিটেন্সও এখন সরকারের নানামুখী উদ্যোগের কারণে বৈধভাবে ব্যাংকিং চ্যানেলে আসতে শুরু করেছে। আর্থিক খাতে বিদ্যমান এই শৃঙ্খলা মহল বিশেষের স্বার্থের পরিপন্থী হয়ে উঠেছে। কারণ তারা আর ইচ্ছে মতো টাকা পাচারের সুযোগ পাচ্ছে না। আবার রমরমা হুন্ডি ব্যবসাও করতে পারছে না। এসব কারণেই ঢালাওভাবে সরকারী ব্যাংকগুলোকে টার্গেট করা হচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা আরও জানিয়েছেন, সামনে অপেক্ষা করছে জাতীয় নির্বাচন। শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারিক কাজও শেষের পথে। মূলত এ দুইয়ের সুবিধাভোগীরাই ব্যাংকিং কর্মকা-ের একটি অনাকাক্সিক্ষত ইস্যুকে কেন্দ্র করে দেশের সমগ্র ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে। দেশে-বিদেশে নানাভাবে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। সরকারকে বিব্রত করা, বহুল প্রত্যাশিত পদ্মা সেতু প্রকল্পের বাস্তবায়ন কাজ বাধাগ্রস্ত করা, বিগত চার বছরের অর্জন ম্লান ও নানা ইস্যুকেন্দ্রিক সরকারের জনসমর্থন হ্রাসের মাধ্যমে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল ও কথিত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারিক প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করাই এর মূল উদ্দেশ্য।
সূত্র জানায়, বিষয়টি ইতোমধ্যে সরকারের গোয়েন্দা নজরদারিতে এসেছে। সরকারের কর্তাব্যক্তিরাও এতে সজাগ হতে শুরু করেছে।
ইতোমধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ ধরনের অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতি ঠেকাতে কঠোর নজরদারির পাশাপাশি দায়ীদের চিহ্নিত করার উদ্যোগ নিয়েছে। ব্যাংকিং খাতে সৃষ্ট এ ধরনের ঘটনা কাম্য নয় উল্লেখ করে এ বিষয়ে গবর্নর ড. আতিউর রহমান বলেছেন, সোনালী ব্যাংকের ঋণ জালিয়াতির ঘটনাটি সাময়িক বিরূপ ছায়া ফেললেও ওই ব্যাংকের বা সামগ্রিক ব্যাংকিং খাতের স্বাভাবিক দৈনন্দিন কার্যক্রম বিঘিœত হয়নি। জনমনেও সরকারী মালিকানাধীন এই ব্যাংক-কোম্পানির প্রতি আস্থায় চিড় ধরেনি। বরং সার্বিকভাবে ব্যাংকিং খাতে টাকা ও বৈদেশিক মুদ্রায় স্থানীয় বাজারে তারল্য, সুদহার ও বিনিময় হার সম্পূর্ণ স্থিতিশীল ও স¦াভাবিক অবস্থায় রয়েছে। এ ব্যাপারে তিনি গ্রাহকদের আতঙ্কিত না হওয়ারও পরামর্শ দিয়ে বলেন, সোনালী ব্যাংকের স্বাভাবিক কার্যক্রম এতে বিপন্ন হওয়ার কিংবা গ্রাহকের আতঙ্কিত হওয়ার মতো কিছু নেই।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গবর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, হলমার্ক ইস্যুতে পাবলিক সেন্টিমেন্টের একটা কালোছায়া তো লেগেছেই। তবে এটি দূর করার দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ, পরিচালনা পর্ষদ ও সরকারের। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে যথাযথ ব্যবস্থা না নেয়া হলে এবং এ ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রতা ও গড়িমসিভাব দেখালে এর একটা নেতিবাচক প্রভাব আগামীতে আমানত সংগ্রহের ক্ষেত্রে পড়তে পারে, যা ব্যাংকিং খাতকে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি দাঁড় করাতে পারে।
ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ আরও বলেন, শুধু সোনালী ব্যাংকই নয়, অন্যান্য রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক কিংবা বেসরকারী ব্যাংকগুলোতে কি ঘটছে সেটিও বাংলাদেশ ব্যাংকের নজরে রাখা উচিত। এ ক্ষেত্রে নিরীক্ষায় কোন অনিয়ম ধরা পড়লে তা যদি শক্ত হাতে দমন করা হয়, তবে ভবিষ্যতে এ জাতীয় ঘটনার হার অনেকাংশে কমে আসবে। অনিয়ম ও দুর্নীতি প্রতিরোধে তিনি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পাশাপাশি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোরও দ্রুত কমপ্লায়েন্স সুবিধা বাড়ানোর পরামর্শ দেন।
এদিকে সোনালী ব্যাংকের ঋণ বিতরণে অনিয়ম প্রসঙ্গ টেনে রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. খন্দকার বজলুল হক বলেন, ক্ষমতাসীন সরকারের অংশ হিসেবে এ ক্ষেত্রে কেউ যদি কোন প্রভাব খাটিয়েই থাকে তা দেখার জন্য সরকারের বিভিন্ন সংস্থা রয়েছে। ইতোমধ্যে সরকারের সব সংস্থাই এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিচ্ছে।
অথচ সম্প্রতি একটি গ্রুপের সরকারী ও বেসরকারী ব্যাংক থেকে বিশাল অঙ্কের অর্থায়নকে কেন্দ্র করে পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি হচ্ছে। শুধু তাই নয়, বিষয়টি এখন ইলেকট্রনিক মিডিয়ার বদৌলতে আন্তর্জাতিক পর্যায়েও ছড়িয়ে পড়েছে। রাজনৈতিক মাঠ গরম করার জন্য বিরোধী শিবির অন্যতম ইস্যু হিসেবে এই ঘটনাকে পুঁজি করছে।
তাঁর মতে, দেশের বিভিন্ন এমএলএম কোম্পানি যে পরিমাণ অর্থ সাধারণ মানুষের কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছে সেদিক বিবেচনা করলে আর্থিক এই বিষয়টি অত্যন্ত নগণ্য। অথচ ইন্ধনদাতারা সেই বিষয়গুলোকে আড়ালে রেখে শুধু সরকারী ব্যাংকগুলোকে লক্ষ্যবস্তু করে অপপ্রচার করছে। এর ফলে এই ব্যাংকগুলোর আমানতকারীদের মধ্যে অনিশ্চয়তার সৃষ্টি করতে পারে, যা সবার নজর এড়িয়ে যাচ্ছে।
এ ব্যাপারে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন অপর একটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জানান, ব্যাংকের কাজ হচ্ছে-আমানতকারীদের অর্থ নিরাপদ হেফাজতে রাখা এবং তা চাওয়া মাত্র গ্রাহককে ফেরত দেয়া। সরকারী ব্যাংকগুলোর আর্থিক সক্ষমতা সে বিবেচনায় সকল বেসরকারী ব্যাংক থেকে অনেক বেশি। সরকারী ব্যাংকগুলো দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক কর্মকা-ে সর্ববৃহৎ ভূমিকা রেখে থাকে। যে কোন সরকারের আর্থিক কর্মকা-ে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো অগ্রণী ভূমিকা পালন করে থাকে। দেশের শিল্পায়ন, যোগাযোগ, অবকাঠামো বিনির্মাণ, জ্বালানি তেলের আমদানি, বিদ্যুত কেন্দ্রের নির্মাণসহ দেশের আমদানি-রফতানি বাণিজ্যে সর্বাধিক অর্থায়ন করে থাকে এই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো। অথচ গণহারে নেতিবাচক প্রচারের ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোর এসব ইতিবাচক বিষয়গুলোকে বিবেচনায় আনা হচ্ছে না। এটি দুঃখজনক ও সম্পূর্ণ অবিবেচনাপ্রসূত কাজ। বিষয়টিকে তিনি সাবোটাজ হিসেবেই দেখতে চান।
তিনি হলমার্ক ইস্যুটি উল্লেখ করে আরও বলেন, বেসরকারী ব্যাংকগুলো যে সকল অর্থায়ন করেছে তার সবই কি ঝুঁকিমুক্ত? অথচ এ ঘটনাটি থেকে উদোরপি-ি বুধোর ঘাড়ে চাপানোর মতো অপচেষ্টা চলছে।
প্রসঙ্গত: কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য মতে, বিশ্ব মন্দাউত্তর টানাপোড়েনের পরিস্থিতিতেও দেশের ব্যাংকিং খাত বেশ ভাল অবস্থানেই রয়েছে। ব্যাংকগুলোর সামগ্রিক ১১ দশমিক ৩১ শতাংশ মূলধন পর্যাপ্ততা ব্যাসেল-২ ভিত্তিক অন্যূন ১০ শতাংশের আবশ্যকতার চেয়ে বেশি। ব্যাংকিং খাতে শ্রেণীকৃত ঋণের মাত্রাও বর্তমানে ৭ দশমিক ১৭ শতাংশে (সহনীয়) রয়েছে। আমানত ও ঋণ প্রবৃদ্ধির মধ্যে গত বছর পরিদৃষ্ট অসামঞ্জস্য দূর হয়েছে। সূত্র মতে, সর্বশেষ হিসাব মোতাবেক ব্যাংকিং খাতে আমানত ও ঋণের প্রবৃদ্ধির হার যথাক্রমে ২০ দশমিক ০৭ শতাংশ ও ১৯ দশমিক ৭২ শতাংশ। অন্যদিকে অগ্রিম-আমানত অনুপাত (এডিআর) এখন ৭৯.৮৩ শতাংশ। সাম্প্রতিকতম স্ট্রেস টেস্টিংয়ে ব্যাংকগুলোর অবস্থান পাওয়া গেছে স্বস্তি পর্যায়ে। বেসরকারী খাতে সামগ্রিক ঋণ যোগানে ১৯ দশমিক ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি সরকারী খাতে ঋণ যোগাণের ১৮.৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধির চেয়ে উচ্চতর মাত্রায় বজায় থেকেছে। মূল্যস্ফীতিও এখন নিম্নগামী। ইতোমধ্যে পয়েন্ট টু পয়েন্ট মূল্যস্ফীতি এক অঙ্কের মাত্রায় নেমে এসেছে। এটি বাজার সুদহার স্থিতিশীল ও সহনীয় মাত্রায় আনা দ্রুততর করেছে। অন্যদিকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ স্থিতি আকু দায় শোধের পরও এগারো বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি রয়েছে। টাকার মূল্যমানও স্থিতিশীল ও উর্ধমুখী। অতি সম্প্রতি আন্তর্জাতিক রেটিং সংস্থা মুডি’স বাংলাদেশের ক্রেডিট রেটিং স্থিতিশীল আউটলুকসহ বিএ৩ এ অপরিবর্তিত রেখেছে। এই রেটিংধারী অন্যান্য দেশগুলোর গড় মাথাপিছু আয় বাংলাদেশের পাঁচগুণের বেশি হওয়া সত্ত্বেও এই রেটিংমান ধরে রাখা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার উজ্জ্বল সাফল্যের পরিচায়ক।
ড. আতিউর রহমান বলেন, আর্থিক খাতে প্রতারণামূলক কর্মকান্ড খুবই অনভিপ্রেত। কিন্তু সম্পূর্ণভাবে তা প্রতিরোধযোগ্যও নয়। উন্নত বিশ্বেও এ ধরনের ঘটনার দৃষ্টান্ত বিরল নয়। তবে তিনি মনে করেন, এ ধরনের ঘটনা প্রতিরোধে সুসমনি¦তভাবে একযোগে দৃঢ়তা ও তৎপরতার সঙ্গে এগোতে হবে। এ ধরনের ঘটনা ঘটিয়ে কেউ যাতে পার পেতে না পারে সেদিকে প্রতিটি ব্যাংক ও কেন্দ্রীয় ব্যাংককে সুতীক্ষè নজর রাখতে হবে। দুদক ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকেও সহযোগিতার নেটওয়ার্কে যুক্ত রাখতে হবে। সরকারকেও সহায়তার হাত সর্বদা প্রসারিত রাখতে হবে।

No comments

Powered by Blogger.