বাংলাদেশ ও প্রবাসী বাঙালী by ইকবাল আজিজ

গত ১৮ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের কানেকটিকাট অঙ্গরাজ্যে একজন মুখোশধারী কৃষ্ণাঙ্গের গুলিতে এক বাংলাদেশী নিহত হয়েছেন। মঈন হাসান নামে ২২ বছর বয়স্ক এই বাংলাদেশী ব্রিজপোর্ট সিটির এক মুদির দোকানে কাজ করতেন। এই নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে গত এক মাসেরও কম সময়ে কৃষ্ণাঙ্গ বন্দুকধারীদের গুলিতে তিন বাংলাদেশী নিহত হয়েছেন।


আগের দুই হত্যার সঙ্গে জড়িত সন্দেহভাজন ব্যক্তিরা গ্রেফতার হলেও মঈন হাসানের ঘাতক এখনও গ্রেফতার হয়নি বলে জানা গেছে। গত এক মাসেরও কম সময়ের ব্যবধানে ৩ বাংলাদেশী খুন হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের বাঙালী কমিউনিটিতে এক ধরনের আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। এ খবরটি বাংলাদেশের পত্রপত্রিকায় তেমন গুরুত্ব সহকারে ছাপা হয়নি; কিন্তু ছোট এ খবরটির গুরুত্ব অপরিসীম। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ থেকে বিপুলসংখ্যক বাঙালী জীবিকা ও উন্নত জীবনের প্রত্যাশা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। অবশ্য ব্রিটেন ও সৌদি আরবে সিলেট ও চাটগাঁর মানুষদের অভিবাসন শুরু অনেক আগে; গত শতাব্দীর চল্লিশের দশক থেকে তাঁরা সেখানে বসবাস শুরু করেছেন। তবে বাংলাদেশের স্বাধীনতাই বিপুলসংখ্যক বাঙালীকে দলে দলে পৃথিবীর নানাদেশে বসবাসের সুযোগ করে দিয়েছে। মানুষ সর্বদাই পরিবর্তন ও উন্নত জীবনের প্রত্যাশী। এই উন্নত জীবনের স্বপ্ন বুকে নিয়েই বাঙালী ভিন দেশে বসতি গড়েছে। তাদের জীবনে প্রতিষ্ঠার পক্ষে প্রতিকূলতা প্রথম থেকেই ছিল; ভিন্ন দেশের বিরূপ আবহাওয়া, আলাদা ভাষা, ধর্ম, সংস্কৃতি ও সামাজিক জীবন। এছাড়া আশির দশক পর্যন্ত আমেরিকা ও পশ্চিমা দেশগুলোতে বর্ণবৈষম্যবাদ ছিল খুবই প্রবল। এত প্রতিকূলতার মোকাবিলা করেও ব্রিটেনে স্থায়ীভাবে বসবাসকারী কয়েক লাখ বাঙালীর একটা বড় গোষ্ঠী গড়ে উঠেছে। লন্ডনের মধ্যে বাঙালী অধ্যুষিত কিছু এলাকা গড়ে উঠেছে যেখানে ইংরেজ কিংবা অন্য কোন জাতিগত গোষ্ঠীর তুলনায় বাঙালীদের সংখ্যা বেশি।
ব্রিটেনে বাঙালীদের রেস্তরাঁ ব্যবসা সারা পৃথিবীর মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে এসব রেস্তরাঁর খাবারের স্বাদ নিতে প্রতিদিন বিপুলসংখ্যক বিদেশী এখানে এসে ভিড় করেন। ব্রিটেনে বাঙালীরা নিজেদের ধর্ম ও সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা বজায় রেখেছেন। তাঁদের আছে নিজস্ব বাংলা পত্রিকা। ব্রিটেনের পাশাপাশি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নানা শহরে বাঙালীরা এখন স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। তবে নিউইয়র্কে বাঙালীদের সংখ্যা সংখ্যা বেশি; কেউ বলেন এক লাখ, কারও মতে দেড় লাখ। তবে লক্ষাধিক বাঙালী যে সেখানে আছেন এ বিষয়ে সবাই একমত। এছাড়া আরও প্রায় দেড় লাখ বাঙালী আছেন যুক্তরাষ্ট্রের অন্যান্য শহরে। প্রতিবছর আমেরিকান বাঙালীদের সাংস্কৃতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়; এসব সম্মেলনে পশ্চিমবঙ্গের তুলনায় বাংলাদেশের বাঙালীদের প্রাধান্য বেশি। আসলে বিদেশে বাংলাদেশের বাঙালীরাই এখন বাঙালী সংস্কৃতির অন্যতম ধারক ও বাহক। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কিংবা সমরেশ মজুমদারের লেখায় এ বক্তব্যের সত্যতা খুঁজে পাওয়া যাবে। বিদেশে কিছু প্রতিভাবান বাঙালী রয়েছেন। এ প্রসঙ্গে মরহুম এফআর খানের কথা বলা যায়। এ বিশ্ববিখ্যাত স্থপতি যুক্তরাষ্ট্রকেই তাঁর কর্মক্ষেত্র হিসাবে বেছে নিয়েছিলেন। এখন এই একবিংশ শতাব্দীতে অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, বিদেশে বসবাস ও কর্মজীবন যেন বাঙালীর জীবনের অন্যতম লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এতকাল পরে প্রবাসী বাঙালীদের ওপর উল্লেখিত এই হামলা বিদেশে বসবাসকারী বাঙালীদের জন্য আতঙ্কের সৃষ্টি করেছে। শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়; অস্ট্রেলিয়াতেও বিদেশীদের হামলার বেশ কিছু ঘটনা ঘটেছে। এতে আহত হয়েছেন বেশ কয়েকজন বাংলাদেশী ছাত্র। বাংলাদেশ সরকারকে অবশ্যই এসব ঘটনা গুরুত্বসহকারে মূল্যায়ন করতে হবে। কারণ বিদেশে স্থায়ীভাবে বসবাসকারী বাংলাদেশীদের সংখ্যা ভবিষ্যতে আরও অনেক বেশি বৃদ্ধি পাবে। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে এমন একটি পরিকল্পনা, নজরদারি ও বিধিব্যবস্থা থাকা উচিত যাতে বিদেশে বসবাসরকারী বাংলাদেশীদের স্বার্থ নিশ্চিত করা সম্ভব হয়। তাঁদের জীবনের নিরাপত্তা যাতে বিঘিœত না হয় সে লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট বিদেশী সরকারসমূহের সঙ্গে আলাপ আলোচনা অব্যাহত রাখতে হবে। প্রবাসী বাঙালীরা নানাভাবে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করছেন; এ কারণে বিদেশে বাংলাদেশ দূতাবাসসমূহের অন্যতম কাজ হওয়া উচিত প্রতিটি ক্ষেত্রে বাঙালীদের স্বার্থ সংরক্ষণ করা, তাঁদের জীবনের নিরাপত্তা রক্ষায় সচেষ্ট থাকা।
সরকারের উচিত, প্রবাসী বাঙালীদের কল্যাণ ও নিরাপত্তা রক্ষায় সম্ভাব্য সবকিছু করা। এছাড়া বিশ্বে বাঙালীদের অবশ্যই নিজ ভাষা ও জাতীয়তার গৌরব বিস্মৃত হওয়া উচিত নয়।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে আমরা বিজয় লাভ করেছি। এখন শুরু হয়েছে দেশ গড়ার নিরন্তর অভিযাত্রা; এক্ষেত্রে প্রবাসী বাঙালীদের দূরে সরিয়ে রাখলে চলবে না।
বাংলাদেশ ও প্রবাসী বাঙালী

ইকবাল আজিজ
গত ১৮ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের কানেকটিকাট অঙ্গরাজ্যে একজন মুখোশধারী কৃষ্ণাঙ্গের গুলিতে এক বাংলাদেশী নিহত হয়েছেন। মঈন হাসান নামে ২২ বছর বয়স্ক এই বাংলাদেশী ব্রিজপোর্ট সিটির এক মুদির দোকানে কাজ করতেন। এই নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে গত এক মাসেরও কম সময়ে কৃষ্ণাঙ্গ বন্দুকধারীদের গুলিতে তিন বাংলাদেশী নিহত হয়েছেন। আগের দুই হত্যার সঙ্গে জড়িত সন্দেহভাজন ব্যক্তিরা গ্রেফতার হলেও মঈন হাসানের ঘাতক এখনও গ্রেফতার হয়নি বলে জানা গেছে। গত এক মাসেরও কম সময়ের ব্যবধানে ৩ বাংলাদেশী খুন হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের বাঙালী কমিউনিটিতে এক ধরনের আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। এ খবরটি বাংলাদেশের পত্রপত্রিকায় তেমন গুরুত্ব সহকারে ছাপা হয়নি; কিন্তু ছোট এ খবরটির গুরুত্ব অপরিসীম। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ থেকে বিপুলসংখ্যক বাঙালী জীবিকা ও উন্নত জীবনের প্রত্যাশা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। অবশ্য ব্রিটেন ও সৌদি আরবে সিলেট ও চাটগাঁর মানুষদের অভিবাসন শুরু অনেক আগে; গত শতাব্দীর চল্লিশের দশক থেকে তাঁরা সেখানে বসবাস শুরু করেছেন। তবে বাংলাদেশের স্বাধীনতাই বিপুলসংখ্যক বাঙালীকে দলে দলে পৃথিবীর নানাদেশে বসবাসের সুযোগ করে দিয়েছে। মানুষ সর্বদাই পরিবর্তন ও উন্নত জীবনের প্রত্যাশী। এই উন্নত জীবনের স্বপ্ন বুকে নিয়েই বাঙালী ভিন দেশে বসতি গড়েছে। তাদের জীবনে প্রতিষ্ঠার পক্ষে প্রতিকূলতা প্রথম থেকেই ছিল; ভিন্ন দেশের বিরূপ আবহাওয়া, আলাদা ভাষা, ধর্ম, সংস্কৃতি ও সামাজিক জীবন। এছাড়া আশির দশক পর্যন্ত আমেরিকা ও পশ্চিমা দেশগুলোতে বর্ণবৈষম্যবাদ ছিল খুবই প্রবল। এত প্রতিকূলতার মোকাবিলা করেও ব্রিটেনে স্থায়ীভাবে বসবাসকারী কয়েক লাখ বাঙালীর একটা বড় গোষ্ঠী গড়ে উঠেছে। লন্ডনের মধ্যে বাঙালী অধ্যুষিত কিছু এলাকা গড়ে উঠেছে যেখানে ইংরেজ কিংবা অন্য কোন জাতিগত গোষ্ঠীর তুলনায় বাঙালীদের সংখ্যা বেশি।
ব্রিটেনে বাঙালীদের রেস্তরাঁ ব্যবসা সারা পৃথিবীর মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে এসব রেস্তরাঁর খাবারের স্বাদ নিতে প্রতিদিন বিপুলসংখ্যক বিদেশী এখানে এসে ভিড় করেন। ব্রিটেনে বাঙালীরা নিজেদের ধর্ম ও সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা বজায় রেখেছেন। তাঁদের আছে নিজস্ব বাংলা পত্রিকা। ব্রিটেনের পাশাপাশি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নানা শহরে বাঙালীরা এখন স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। তবে নিউইয়র্কে বাঙালীদের সংখ্যা সংখ্যা বেশি; কেউ বলেন এক লাখ, কারও মতে দেড় লাখ। তবে লক্ষাধিক বাঙালী যে সেখানে আছেন এ বিষয়ে সবাই একমত। এছাড়া আরও প্রায় দেড় লাখ বাঙালী আছেন যুক্তরাষ্ট্রের অন্যান্য শহরে। প্রতিবছর আমেরিকান বাঙালীদের সাংস্কৃতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়; এসব সম্মেলনে পশ্চিমবঙ্গের তুলনায় বাংলাদেশের বাঙালীদের প্রাধান্য বেশি। আসলে বিদেশে বাংলাদেশের বাঙালীরাই এখন বাঙালী সংস্কৃতির অন্যতম ধারক ও বাহক। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কিংবা সমরেশ মজুমদারের লেখায় এ বক্তব্যের সত্যতা খুঁজে পাওয়া যাবে। বিদেশে কিছু প্রতিভাবান বাঙালী রয়েছেন। এ প্রসঙ্গে মরহুম এফআর খানের কথা বলা যায়। এ বিশ্ববিখ্যাত স্থপতি যুক্তরাষ্ট্রকেই তাঁর কর্মক্ষেত্র হিসাবে বেছে নিয়েছিলেন। এখন এই একবিংশ শতাব্দীতে অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, বিদেশে বসবাস ও কর্মজীবন যেন বাঙালীর জীবনের অন্যতম লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এতকাল পরে প্রবাসী বাঙালীদের ওপর উল্লেখিত এই হামলা বিদেশে বসবাসকারী বাঙালীদের জন্য আতঙ্কের সৃষ্টি করেছে। শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়; অস্ট্রেলিয়াতেও বিদেশীদের হামলার বেশ কিছু ঘটনা ঘটেছে। এতে আহত হয়েছেন বেশ কয়েকজন বাংলাদেশী ছাত্র। বাংলাদেশ সরকারকে অবশ্যই এসব ঘটনা গুরুত্বসহকারে মূল্যায়ন করতে হবে। কারণ বিদেশে স্থায়ীভাবে বসবাসকারী বাংলাদেশীদের সংখ্যা ভবিষ্যতে আরও অনেক বেশি বৃদ্ধি পাবে। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে এমন একটি পরিকল্পনা, নজরদারি ও বিধিব্যবস্থা থাকা উচিত যাতে বিদেশে বসবাসরকারী বাংলাদেশীদের স্বার্থ নিশ্চিত করা সম্ভব হয়। তাঁদের জীবনের নিরাপত্তা যাতে বিঘ্নিত না হয় সে লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট বিদেশী সরকারসমূহের সঙ্গে আলাপ আলোচনা অব্যাহত রাখতে হবে। প্রবাসী বাঙালীরা নানাভাবে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করছেন; এ কারণে বিদেশে বাংলাদেশ দূতাবাসসমূহের অন্যতম কাজ হওয়া উচিত প্রতিটি ক্ষেত্রে বাঙালীদের স্বার্থ সংরক্ষণ করা, তাঁদের জীবনের নিরাপত্তা রক্ষায় সচেষ্ট থাকা।
সরকারের উচিত, প্রবাসী বাঙালীদের কল্যাণ ও নিরাপত্তা রক্ষায় সম্ভাব্য সবকিছু করা। এছাড়া বিশ্বে বাঙালীদের অবশ্যই নিজ ভাষা ও জাতীয়তার গৌরব বিস্মৃত হওয়া উচিত নয়।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে আমরা বিজয় লাভ করেছি। এখন শুরু হয়েছে দেশ গড়ার নিরন্তর অভিযাত্রা; এক্ষেত্রে প্রবাসী বাঙালীদের দূরে সরিয়ে রাখলে চলবে না।
রয়নধষধুরু.ঢ়ড়বঃ@মসধরষ.পড়স
iqbalaziz.poet@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.