সময়ের প্রতিধ্বনি-বিশ্বব্যাংকের প্রত্যাবর্তন এবং যুক্তরাষ্ট্র-জাইকাকে অভিনন্দন by মোস্তফা কামাল

অবশেষে বিশ্বব্যাংক ফিরেছে। এ যেন স্বস্তির ফেরা। পদ্মা সেতুর ললাট থেকে অনিশ্চয়তার মেঘ কেটে গেছে। ১৬ কোটি মানুষের প্রত্যাশার সূর্য উঁকি দিচ্ছে পূর্ব গগনে। আমরা বড় আশাবাদী মানুষ। বড় করে স্বপ্ন দেখি। স্বপ্নের চেয়েও বড় হতে চাই।


কারো ভুলে সেই স্বপ্ন দুঃস্বপ্নে পরিণত হতে পারে না! যদিও কেউ কেউ মনে-প্রাণে চেয়েছিলেন, বিশ্বব্যাংক আর না ফিরুক। তাহলে রাজনীতির মাঠ গরম করা যাবে। আগামী নির্বাচনে সরকারকে তুলাধোনা করার জন্য এটা একটা বড় ইস্যু হবে। কিন্তু হায়! ইস্যুটি যে হাতছাড়া হয়ে গেল! এর চেয়ে বড় ইস্যু কি পাওয়া যাবে? যদিও এ দেশে ইস্যুর কোনো অভাব নেই।
যা হোক, এখন আমরা আশা করতে পারি, দক্ষিণাঞ্চলের স্বপ্নের পদ্মা সেতু বাস্তব রূপ নেবে। বিশ্বব্যাংক বলেছে, সরকারের নেওয়া পদক্ষেপে তারা আশ্বস্ত হয়েছে। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকও (এডিবি) গত সোমবার এক বিবৃতিতে সরকারের দুর্নীতিবিরোধী পদক্ষেপে তাদের সন্তুষ্টির কথা জানিয়েছে। তারা এই প্রকল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকবে বলে বিবৃতিতে উল্লেখ করেছে। বিশ্বব্যাংকের এই প্রত্যাবর্তন এবং এডিবির সম্পৃক্ত থাকার ঘোষণাকে আমরা স্বাগত জানাই। একই সঙ্গে অভিনন্দন জানাতে চাই যুক্তরাষ্ট্র ও জাপান আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা 'জাইকা'কে।
প্রিয় পাঠক, আপনারা হয়তো ভাবতে পারেন, বিশ্বব্যাংকের প্রত্যাবর্তনের জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও জাইকাকে অভিনন্দন জানাতে হবে কেন! এরা আবার কী করল! বিশ্বব্যাংক সরকারকে কিছু শর্ত দিয়েছিল। সেগুলো সরকার পূরণ করেছে বলেই ফিরেছে। সরকার শর্ত পূরণ করেছে এটা ঠিক; কিন্তু ঋণচুক্তি বাতিলের পর আবার তা পুনর্বিবেচনার ঘটনা বিশ্বব্যাংকের ইতিহাসে বিরল। বিশ্বব্যাংক কোনো দেশের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করে আবার ফিরে এসেছে, এর কোনো নজির নেই। তবে এই নজির স্থাপনের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র এবং জাইকা অত্যন্ত ইতিবাচক ও কার্যকর ভূমিকা রেখেছে। কিভাবে রেখেছে তা ব্যাখ্যা করার আগে প্রাসঙ্গিক কিছু বিষয় তুলে ধরছি।
বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের ঋণচুক্তি হয় গত বছরের (২০১১) ২৮ এপ্রিল। পরে ২৮ মে জাইকা এবং ৬ জুন এডিবির সঙ্গে চুক্তি সই হয়। ৯ সেপ্টেম্বর উইকিলিকস প্রকাশিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গোপন নথিতে মার্কিন রাষ্ট্রদূত জেমস এফ মরিয়ার্টি যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের সততা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। এর ঠিক পর পরই ২১ সেপ্টেম্বর বিশ্বব্যাংক মূল সেতু ও তদারকি পরামর্শক নিয়োগ বিষয়ে দুর্নীতির অভিযোগ এনে অর্থমন্ত্রীর কাছে তদন্ত প্রতিবেদন পেশ করে। পরে বিশ্বব্যাংকের একটি প্রতিনিধিদল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গেও সাক্ষাৎ করে এবং এ-সংক্রান্ত তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন করে।
যা হোক, বিশ্বব্যাংকের অভিযোগের অব্যবহিত পর ৯ অক্টোবর প্রকল্প পরিচালক রফিকুল ইসলামকে অপসারণ এবং ১৩ অক্টোবর সেতু বিভাগের সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়াকে বদলি করা হয়। পরে তাঁকে ছুটিতে পাঠানো হয়। কিন্তু এতেও বিশ্বব্যাংক সন্তুষ্ট হয়নি। বিশ্বব্যাংকের অভিযোগ ছিল যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হোসেনের বিরুদ্ধে। কিন্তু সরকার তাঁকে সরাতে গড়িমসি করছিল। একপর্যায়ে আবুল হোসেনকে আইসিটি মন্ত্রণালয়ে বদলি করা হয়। যোগাযোগমন্ত্রী করা হয় ওবায়দুল কাদেরকে। যদিও বিশ্বব্যাংক আবুল হোসেনকে মন্ত্রিসভা থেকে বাদ দেওয়ার কথা বলেছিল। তা ছাড়া পদ্মা সেতু প্রকল্পের ইন্টিগ্রিটি অ্যাডভাইজার ড. মসিউর রহমানকেও ছুটিতে পাঠানোর জন্য পরামর্শ দিয়েছিল বিশ্বব্যাংক। কিন্তু সরকার এসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হেলাফেলা করছিল।
তারপর যা হওয়ার তা-ই হয়েছে। ২৯ জুন বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্পে ১২০ কোটি ডলারের ঋণচুক্তি বাতিল করেছে। এরপর বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে সরকারের আলোচনাই থেমে যায়। এ বিষয়ে নতুন করে আলোচনা করতেও বিশ্বব্যাংক রাজি ছিল না। আমরা নিশ্চয়ই সে কথা ভুলে যাইনি। তারপর অনেক জল ঘোলা হয়েছে। সরকার তথা খোদ প্রধানমন্ত্রী বিশ্বব্যাংকের কর্মকাণ্ডে ভীষণ ক্ষুব্ধ হন। তিনি উল্টো বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধেই দুর্নীতির অভিযোগ করে বলেন, বিশ্বব্যাংক ঋণ না দিলে নিজেদের অর্থেই পদ্মা সেতু করা হবে। তারপর শুরু হলো চাঁদাবাজি। আর সেই চাঁদাবাজির টাকা ভাগবাটোয়ারা করতে গিয়ে একজন ছাত্র প্রাণ দিল। এর ফলে সরকারের পুরো পরিকল্পনাই ভেস্তে গেল।
শেষ পর্যন্ত সরকার আবার বিশ্বব্যাংকের কাছেই ধরনা দিতে শুরু করল। অর্থমন্ত্রী এ এম এ মুহিত, প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা গওহর রিজভী ছাড়াও সরকারের কয়েকজন প্রতিনিধি বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে দেনদরবার করেন। পাশাপাশি সরকার কূটনৈতিক চ্যানেলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে দিয়ে বিশ্বব্যাংকের মন গলানোর চেষ্টা করে। এ কাজে জাইকার শীর্ষ পর্যায়ের প্রতিনিধিকেও যুক্ত করা হয়। একপর্যায়ে যুক্তরাষ্ট্র ও জাইকা যৌথভাবে বাংলাদেশের পক্ষে তদবির করে। ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনা এ দেশের মানুষের আবেগ-অনুভূতির বিষয়টি উপলব্ধি করে সরকারের পক্ষে দূতিয়ালি করেন। মার্কিন দূত বিশ্বব্যাংককে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে তাঁর সরকারকে উদ্যোগ নেওয়ার জন্য বিশেষ বার্তা পাঠান। একই সঙ্গে তিনি বাংলাদেশ সরকার এবং বিশ্বব্যাংকের মধ্যে আলোচনার সূত্রপাত ঘটাতে মধ্যস্থতার ভূমিকা পালন করেন।
মার্কিন দূতের পরামর্শেই সরকার বিশ্বব্যাংকের ব্যাপারে আগ্রাসী মনোভাব পরিহার করে নমনীয় অবস্থান নেয় এবং বিশ্বব্যাংকের শর্তগুলো পূরণ করতে সম্মত হয়। বিশ্বব্যাংকের শর্ত অনুযায়ী গত ২৩ জুলাই আবুল হোসেন পদত্যাগ করেন। সর্বশেষ প্রধানমন্ত্রীর অর্থ উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমানকেও ছুটিতে পাঠানো হয়। আর সেই কাগজ নিয়ে ওয়াশিংটনে ছুটে যান প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী। অবশেষে বিশ্বব্যাংকের ইতিবাচক সাড়া মেলে। এ কথাও বলতে দ্বিধা নেই, অর্থমন্ত্রী এবং প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা প্রতিকূলতা দূরে ঠেলে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে সক্ষম হয়েছেন। এ জন্য তাঁদের প্রতি সাধুবাদ জানাই।
এখন সরকারের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, দুর্নীতিমুক্তভাবে বৃহত্তর পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়ন করা। বিশ্বব্যাংক স্পষ্টই বলেছে, বাংলাদেশ সরকার ভবিষ্যতে স্বচ্ছতার সঙ্গে প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে সম্মত হওয়ায় নতুন করে যুক্ত হয়েছে। দুর্নীতির ব্যাপারে কোনো ছাড় দেওয়া হবে না। ভবিষ্যতে যাতে কোনো ধরনের অনিয়ম হতে না পারে, তা নিশ্চিত করতে বিশ্বব্যাংক আরো কিছু শর্ত দিয়েছে। এগুলো হচ্ছে প্রকল্পের নতুন ক্রয়ব্যবস্থা ব্যাপক ও নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণের সুযোগ, দুর্নীতির যে অভিযোগ উঠেছে তার সুষ্ঠু, অবাধ ও দ্রুত তদন্ত অব্যাহত রাখা, তদন্ত পর্যালোচনা করে সরকার ও বিশ্বব্যাংকের কাছে তথ্য প্রদানের জন্য আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ব্যক্তিদের নিয়ে একটি কমিটি গঠন।
প্রকল্প কাজের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার জন্য বিশ্বব্যাংকের এই শর্তগুলো অযৌক্তিক নয় বলে মনে করি। আমরা আশা করি, সরকার সম্পূর্ণ আন্তরিকতার সঙ্গে প্রকল্প বাস্তবায়ন কাজ শুরু করবে।
প্রসংগত, দক্ষিণাঞ্চলবাসীর স্বপ্নের পদ্মা সেতু নির্মাণের ব্যাপারে ক্ষমতাসীন মহাজোট সরকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী কাজও শুরু হয়েছিল। ছয় হাজার ১৫০ মিটার দীর্ঘ ও ২১.১০ মিটার প্রস্থ সেতু প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছিল ২.৯ বিলিয়ন (২৯০ কোটি) মার্কিন ডলার। এর মধ্যে ১.২ বিলিয়ন ডলার দেওয়ার কথা বিশ্বব্যাংকের। এ ছাড়া এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক ৬১৫ মিলিয়ন ডলার, জাপান আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা জাইকা ৪১৫ মিলিয়ন ডলার এবং ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক ১৪০ ডলার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। বাকি অর্থ সরকার বিভিন্ন সূত্র থেকে সংগ্রহ করবে বলে উল্লেখ করা হয়। এর নির্মাণকাজ ২০১৩ সালের মধ্যে শেষ করার কথা ছিল। সামগ্রিক প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে ২০১৫ সাল পর্যন্ত সময় লাগবে বলে উল্লেখ করা হয়।
বাস্তবতা হচ্ছে, পদ্মা সেতু প্রকল্পের নির্মাণকাজ ২০১৩ সালের মাঝামাঝি নাগাদ হয়তো শুরু হবে। তার আগে নয়। যদিও অর্থমন্ত্রী বলেছেন, চলতি বছরের অক্টোবরে পদ্মা সেতুর দরপত্র আহ্বান করা হবে এবং আগামী বছরের এপ্রিল-মেতে পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ শুরু হবে। অথচ আগামী বছরের মধ্যে প্রকল্পের নির্মাণকাজ শেষ করার কথা ছিল। দেরিতে শুরু হওয়ার কারণেই আগে যে প্রকল্প ব্যয় ধার্য করা হয়েছিল, তার চেয়ে বেড়ে যাবে। এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে সরকারকে কাজ করতে হবে। প্রকল্পে দুর্নীতিসংক্রান্ত জটিলতা এবং সরকারের একগুঁয়ে মনোভাবের কারণে ১০ মাস পার হয়ে গেছে। তবে সরকার বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করলে উদ্ভূত জটিলতাগুলো নিশ্চয়ই এড়ানো যেত।
বড় ধরনের একটি জটিলতা কাটানোর পর উভয় পক্ষই বেশ সতর্ক থাকবে বলে মনে হচ্ছে। তবে অতি সতর্কতায় প্রকল্প বাস্তবায়নের গতি যেন মন্থর না হয়। এ ক্ষেত্রে আমলাতান্ত্রিক জটিলতাও সৃষ্টি করা হতে পারে, যা প্রকল্পকাজে বিলম্ব ঘটাবে। সে জন্য বিশেষভাবে সতর্ক থাকতে হবে। স্বচ্ছতার সঙ্গে পদ্মা সেতু প্রকল্পের কাজ শুরু করতে পারলে সরকারের ভাবমূর্তির ওপর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। এটা রাজনৈতিক ইস্যু হিসেবেও ক্ষমতাসীন দল কাজে লাগাতে পারবে।

লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
mostofakamalbd@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.