উপমহাদেশ-ক্ষমতার অলিন্দে হাস্যরস উধাও by এমজে আকবর

রাজা বীরবলের প্রাচীন দুনিয়া এবং মহাত্মা গান্ধীর নতুন যুগের মাঝখানে ব্রিটিশ রাজত্বের ছায়া। ব্রিটিশ রাজত্বের সময় এক শতাব্দী বা তারও কিছু বেশি সময় হাস্যরসের পালাটা বন্ধ ছিল। অন্য সময়ে শাসক এবং নাগরিকদের মধ্যে সৃজনশীল সেতুবন্ধ হিসেবে বিবেচিত হাস্যকৌতুকের কোনো কমতি ছিল না।


এই সেতুবন্ধটা অসম প্রকৃতির হলেও সেটা বজায় ছিল।
রসিক ব্রাহ্মণ বীরবল একদা সম্রাট আকবরের সঙ্গে খাবার খেতে বসেছিলেন। সম্রাট বেগুনের একটি প্লেট দেখে নাক সিটকালেন। বীরবল বিস্ময়াহত হয়ে বললেন, বেগুন! এ তো জাহান্নাম থেকে এসেছে। এ ধরনের ব্রাত্য সবজি রাজপরিবারের রন্ধনশালায় কীভাবে রান্না হলো এবং পাচকের ঘাড়ে ক'টা মাথা আছে যে, এমনতর খাবার তৈরি করে! তার তো বারোটা বেজে যাওয়ার কথা। আর এক খাবারের সময় আকবরের কাছে বেগুনের রান্নাটা সুস্বাদু মনে হলো। বীরবল খাবারের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে নানাভাবে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতে লাগলেন। তখন আকবর তাকে এ খাবারের ব্যাপারে তার পুরনো অভিমতের কথা স্মরণ করিয়ে দিলেন। এর জবাবে বীরবল বললেন, জাঁহাপনা, 'এই বেগুন আমার সম্রাট নয়, আপনিই ভাগ্যবিধাতা।'
এই কাহিনীর মধ্যে কেউ যদি শুধু মোসাহেবির তরিকা খোঁজেন, তাহলে এর আসল অর্থটাই মাঠে মারা যাবে। এই মৌখিক রসিকতার মধ্য দিয়ে খানিকটা আভিজাত্যে হুল ফোটানোর একটা চেষ্টা আছে। বীরবল ছিলেন তখনকার সময়ে নন্দিত এক জননায়ক। তিনি ছিলেন রাজ্যনির্বিশেষে পূর্বাঞ্চলের অমাত্য ও সাধারণের ঐতিহ্যের প্রতীক। অমিত ক্ষমতাশালীদের প্রকৃষ্ট হাস্যকৌতুকের মাধ্যমে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিলেন তিনি।
তারা ভাঁড়ামির আশ্রয় নিতেন, কিন্তু ভাঁড় ছিলেন না। বীরবল ছিলেন সম্রাট আকবরের সবচেয়ে কুশলী সেনা কমান্ডারদের অন্যতম। ধারণা করা হয়, আফগান যুদ্ধে তিনি নিহত হন। এসব জনপ্রিয় আইকনকে ঘিরে যেসব কাহিনী প্রচলিত রয়েছে, সেগুলোতে মূলত রাজক্ষমতার বাইরে নৈতিক আর এক জগৎ থাকার কথাই প্রতিধ্বনিত হয়। শক্তিমান বাগদাদের আব্বাসী ডাইনেস্টির সুলতান হারুন আল রশিদের দরবারে লোকমান নামে এক প্রসিদ্ধ ব্যক্তি ছিল। সুলতান একদা তাকে জ্বলন্ত কাঠ নিয়ে রুদ্ধশ্বাসে দৌড়ে যেতে দেখলেন। সুলতান এভাবে দৌড়ানোর কারণ জিজ্ঞেস করলেন লোকমানকে। লোকমান সুলতানকে বুঝিয়ে বলল, সে আসলে জাহান্নামে যাচ্ছিল। হারুন বললেন, আগুন নিয়ে জাহান্নামে যাওয়া কেন? সেখানে তো এমনিতেই অনেক আগুন আছে। লোকমান বলল, এটা নিছক ভুল ধারণা। জাহান্নামে যাওয়ার সময় আমাদের প্রত্যেককেই নিজ নিজ আগুন সঙ্গে নিয়ে যেতে হবে।
এশিয়ার তুর্কি ভূমিতে হোজ্জা ছিল। সম্পদ আর কর্তৃত্ব দেখে সে খালি হাসত। একবার আকসেহির শহরে এক ধনাঢ্য ব্যক্তি তাকে খাওয়ার নেমন্তন্ন করল। এ সময় সে দেখল, সাধারণ পোশাক পরে এসেছে বলে কেউই তার দিকে নজর দিচ্ছে না। তখন সে বাড়ি গিয়ে তার উত্তম পোশাকটি পরে আবার খেতে এলো। এবার তাকে ভালো খাবার পরিবেশন করা হলো। সে তখন তার কোটের বোতাম খুলে এর পকেটে খাবার ঢুকিয়ে এই বলে ক্রন্দন করতে লাগল, 'আমার প্রিয় কোট খাও! এই খাবার তোমার জন্য, আমার নয়।'
মুসলিম শাসকরা প্রায়ই একটি প্রচলিত প্রবাদ উদৃব্দত করে বলতেন, 'কৌতুক খাবারের মধ্যে লবণের মতো।' কৌতুকের শ্রেণী নেই। তবে এটাকে পরিবেশন করতে হয় সম্মানের সঙ্গে। আমুদে সাংবাদিক আবদুুল হালিম তার 'লাস্ট ফেজ অব এন ওরিয়েন্টাল কালচার'-এ লিখেছেন, এক ব্যক্তির হাস্যরস যত প্রসারিত হবে, তিনি তত বেশি করে সাহিত্য ও সামাজিক সার্কেলে সমাদৃত হবেন।' এটা স্বতঃসিদ্ধ যে, কৌতুকের একটা লক্ষ্য থাকে। তবে তাতে বিচারবুদ্ধির ছাপ থাকতে হবে।
ব্রিটিশরা আসার পর চাকরের অর্থ পাল্টে গেল। একই সঙ্গে পাল্টাল মনিবের অর্থও। চাকরির নিয়ে গর্ব করার স্থান নিল রসকষহীন আজ্ঞানুবর্তিতা। নওয়াব আসফ-উদ-দৌলা একদা কেবল মসুরির ডাল রান্নার জন্য মাসে ৫শ' টাকার মোটা বেতনে একজন পাচক রাখলেন। পাচকের চাকরির শর্তের মধ্যে ছিল_ ডাল রান্না হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাকে খাবার পরিবেশন করতে হবে। কয়েক সপ্তাহ পর প্রথম রান্না করা ডাল প্লেট ভর্তি করে নিয়ে এলো এবং নওয়াবের দৃষ্টি আকর্ষণ করল। কিন্তু আলোচনারত নওয়াব দু'বার ডাকার পরও সেদিকে ভ্রূক্ষেপ না করায় বাবুর্চি একটি গাছের ওপর ডাল ঢেলে দিল এবং সেখান থেকে চলে গেল। ওই বাবুর্চিকে আর কখনও সেখানে দেখা যায়নি। এখানে অর্থ যে মর্যাদার সমতুল্য নয়, তাই দেখা গেল।
ব্রিটিশরা অবশ্য হাস্যকৌতুক-বর্জিত নয়। তবে তারা তাদের কৌতুক সব ব্রিটেনের জন্য সংরক্ষণ করত। সেখানকার শ্রেণীপার্থক্য যথেষ্ট আঁটোসাঁটো ছিল। তারা ভয়ডরহীনভাবে সেখানে জীবনযাপন করতে পারত। ভয়ের প্রথম বলি হলো হাস্যকৌতুক। বার্মায় নিযুক্ত ব্রিটিশরাজের এক কর্মকর্তা ওরেল মন্তব্য করেন, একটা পর্যায়ে মজাদার কৌতুক স্মরণযোগ্য করাই যাবে না, ধনী বা শক্তিমানদের প্রসঙ্গ উল্লেখ না করে। ব্রিটিশরাজের রক্ষকরা ঠিকই বুঝেছিলেন যে, বন্দুকের পরিবর্তে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ দিয়েই ঘায়েল করা অনেক সহজ। ভারতীয়রা ব্রিটিশরাজের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে শুরু করার পর বিংশ শতাব্দীর প্রথমদিকে ভারতীয় রাজনীতির ডায়লেক্টিসে কৌতুকের পুনরুজ্জীবন ঘটে। ভারতীয় কবিরা তাদের কবিতার ছত্রে ছত্রে বিদেশ শাসনের বিরুদ্ধে সেন্টিমেন্টকে প্রস্ফুুটিত করেন। বঙ্কিমচন্দ্র চ্যাটার্জি টমি ফ্লু ছড়াচ্ছে মর্মে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে স্যাটায়ার রচনা করেন। তবে তার এই রচনাটি বিবেচিত হয় অনর্ঘাত হিসেবে এবং সেটি সেন্সরশিপের খড়্গের তলায় ছিল। এই সেন্সরশিপ বিষয়টি ছিল বিরোধী মতকে রুদ্ধ করার জন্য ব্রিটিশরাজের উত্তম হাতিয়ার। অক্সব্রিজ ফেরত খিলাফত আন্দোলনের নেতা মওলানা মুহাম্মদ আলী অনুচ্চ কণ্ঠে বলেছিলেন, ভারতীয়দের অধীনতাপাশেই যদি আবদ্ধ রাখা হবে, তাহলে তাদের কেন শিক্ষিত করা হচ্ছে? আর অমনিতেই তিনি সেন্সরের কোপের মধ্যে পড়ে গেলেন। মার্ক টোয়েন যেমন বলেছেন, হাস্যকৌতুককে আটকাতে পারে পৃথিবীতে এমন কোনো শক্তি নেই। রাজনৈতিক বিতর্কে অসংস্কৃত কার্টুনের জন্মদাতা আঠারো শতকে ব্রিটিশরাই। কুরুচিপূর্ণতা যদি ইস্যু হয়ে থাকে, তবে ব্রিটিশ রাজতন্ত্রকে নিয়ে এত ক্যারিকেচার কেন? ভারতের শাসকশ্রেণীই-বা কার্টুন ও ক্যারিকেচার নিয়ে পার্টি লাইনে এতটা প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে কেন? এটা কেবল আসন্ন নির্বাচনে পরাজয়ের আশঙ্কায় আত্মবিশ্বাসের ঘাটতির কারণে ঘটেছে_ তা নয়। এটার সম্ভাব্য কারণ হতে পারে আমরা ব্রিটিশ ওয়েস্টমিনস্টার মডেলকে গ্রহণ করেছি এবং আমাদের শাসকরা উত্তরাধিকারসূত্রেই কলকাতা ও দিলি্লর ব্রিটিশদের কাছ থেকে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি পেয়েছে। তারা ভারতীয় মুঘল বা মারাঠা বা রাজপুত দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেননি।
আমাদের পূর্বপুরুষরা ব্যঙ্গ-কৌতুককে সহজভাবে গ্রহণ করতে পারতেন। কারণ তারা জনগণকে সেবার ব্রত নিয়ে এসেছিলেন। তাদের উত্তরসূরিরা ক্ষমতায় যাওয়ার জন্যই রাজনীতি করে থাকেন। তাই তারা হাস্যকৌতুকের মানসিকতা হারিয়ে ফেলেছেন।

এমজে আকবর :ইন্ডিয়া টুডে ম্যাগাজিনের সম্পাদকীয় পরিচালক ইন্ডিয়া টুডে থেকে সংক্ষেপিত
ভাষান্তর সুভাষ সাহা

No comments

Powered by Blogger.