বিনিয়োগ ও শিল্পায়নে স্থবিরতা-উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে

কোনো দেশে বিনিয়োগ না বাড়লে যেমন কর্মসংস্থান বাড়ে না, তেমনি বর্ধিত বেকারত্বের কারণে নানা ধরনের সামাজিক অস্থিরতার সৃষ্টি হয়। অন্যদিকে সে দেশে সামষ্টিক অর্থনীতির উন্নয়ন ও জনগণের জীবনযাত্রার মান ক্রমেই পিছিয়ে পড়ে।


বাংলাদেশে কার্যত তা-ই ঘটছে। এ জন্য দায়ী মূলত রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনার অভাব এবং বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্য উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টিতে সরকারের ব্যর্থতা। অতীতের সরকারগুলোর মতো বর্তমান সরকারও এ ক্ষেত্রে একই ধারায় ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে চলেছে।
বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন ভৌত অবকাঠামোর, বিশেষ করে বিদ্যুৎ ও যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়ন। কিন্তু বাংলাদেশে দিন দিনই যেন তার অবনতি হচ্ছে। ভূপ্রকৃতির পাশাপাশি রক্ষণাবেক্ষণে অবহেলার কারণে সড়ক যোগাযোগব্যবস্থা প্রায় পর্যুদস্ত। রেলওয়ে ও নৌপথের অবস্থা আরো করুণ। বিনিয়োগ বৃদ্ধির আরেকটি প্রধান শর্ত হলো বিদ্যুৎ ও জ্বালানির নিশ্চয়তা। দফায় দফায় দাম বাড়ানো ছাড়া এ ক্ষেত্রেও পরিকল্পিত উন্নয়ন নেই বললেই চলে। এখন পর্যন্ত জোড়াতালির নীতিই অনুসরণ করা হচ্ছে। কয়লানীতিই এখন পর্যন্ত চূড়ান্ত করা যায়নি। ব্যয়বহুল রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে উদ্ধার পাওয়ারও কোনো সম্ভাবনা অদূর ভবিষ্যতে দেখা যাচ্ছে না। অপেক্ষাকৃত সুলভ কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণেও তেমন কোনো অগ্রগতি নেই। বন্দরের উন্নয়ন, পরিবহন ব্যবস্থা সহজলভ্য করা, শুল্কায়ন ও অন্যান্য পদ্ধতিগত জটিলতা কমানো, রপ্তানি বাড়াতে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের দুর্বলতাসহ দেশে কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় শিল্পায়ন না হওয়ার পেছনে আরো অনেক কারণই আছে। ব্যাপক দুর্নীতি, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, সিদ্ধান্ত গ্রহণে দীর্ঘসূত্রতা ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিও এ ক্ষেত্রে নেতিবাচক ভূমিকা রাখছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ সামাজিক অবকাঠামো উন্নয়নেও গত সাড়ে তিন বছরে এ সরকারের ব্যর্থতার পাল্লা ভারী।
দেশে কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় শিল্পায়ন না হওয়ার পেছনে আরেকটি বড় কারণ হচ্ছে আর্থিক ও রাজস্ব খাতে বর্তমান সরকারের অনুসৃত ভ্রান্তনীতি। আমদানি-রপ্তানির প্রতি সরকার কিছুটা আনুকূল্য দেখালেও আমদানিবিকল্প কিংবা উৎপাদনমুখী শিল্পের জন্য প্রণোদনা অথবা নীতি-সহায়তা নেই বললেই চলে। বাংলাদেশ ব্যাংক আইএমএফ নির্দেশিত সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি অনুসরণ করার কারণেও দেশে শিল্পায়নের গতি স্তিমিত হয়ে পড়ছে। উচ্চ সুদে ঋণ নিয়ে কোনো শিল্পে লাভজনকভাবে টিকে থাকাই প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। ফলে জিডিপির শতাংশের হিসাবে ঋণ-প্রবৃদ্ধি কমে গেছে। তদুপরি ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে সরকারের অতিমাত্রায় ঋণ গ্রহণের কারণেও ব্যাংকে নগদ অর্থের ঘাটতি দেখা দেয় ও ঋণপ্রবাহ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দেশে নামমাত্র একটি শিল্পনীতি থাকলেও অনেক অর্থনীতিবিদ একে শিল্পনীতি না বলে বাণিজ্যনীতি বলাটাকেই শ্রেয় মনে করেন। অথচ শিল্পায়নের অন্যতম পূর্বশর্ত হচ্ছে দেশে একটি কার্যকর শিল্পনীতি বিদ্যমান থাকা। কোন পণ্যটি দেশে তৈরি হবে এবং কোনটি কী পরিমাণে আমদানি করা হবে- তার যেমন কোনো সমীক্ষা নেই, তেমনি কার্যকর নীতিমালা ও নিয়ন্ত্রণ নেই। দেশীয় শিল্পকে প্রয়োজনীয় প্রটেকশন দেওয়া হয়নি। এ অবস্থায় অনেক শিল্পপতিই এখন শিল্প স্থাপনের চেয়ে ব্যবসা করাটাকেই বেশি নিরাপদ মনে করছেন। এটা কোনো দেশের জন্যই শুভ লক্ষণ নয়। আবার বরাবরই বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার কথা বলা হয়, কিন্তু সে ক্ষেত্রেও উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি নেই। কিছু বিনিয়োগকারী প্রথমে কিছুটা আগ্রহ দেখালেও দেশের সার্বিক পরিস্থিতি দেখে পিছিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছেন।
দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছে, ক্ষমতাসীনদের কথা ও কাজের মধ্যে সংগতি নেই। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ছাড়াও অর্থমন্ত্রী, শিল্পমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্ট অনেকেই শিল্পায়নের পক্ষে এমন অনেক রঙিন প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, যার সঙ্গে বাস্তবের সংগতি খুবই কম। এমনটি কাম্য নয়। দেশে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ চাই। প্রয়োজনীয় নীতি ও পরিকল্পনার ভিত্তিতে দেশের শিল্পায়নকে ত্বরান্বিত করতে ও এগিয়ে নিতে হবে- এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

No comments

Powered by Blogger.