এই সব কিসের আলামত? by হায়দার আকবর খান রনো

রাজনীতি কতটা নিম্নপর্যায়ে নামতে পারে এবং প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলগুলো, যারা পালাক্রমে নির্বাচিত হচ্ছে, তাদের মধ্যে সুস্থ প্রতিযোগিতার বদলে প্রতিহিংসার রাজনীতি যে কী পর্যায়ে পৌঁছেছে, তা সপ্তাহ খানেক আগের এক ঘটনা দ্বারাই বোঝা যায়।

এই ঘটনাটি আমাকেও ভীষণ বিস্মিত করেছে। বিরোধীদলীয় নেত্রী ও দুই বারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার বাড়িতে আদালতের সমন নিয়ে গিয়েছিল পুলিশ রাত আড়াইটার সময়। সাধারণত মধ্যরাতে পুলিশ যায় গ্রেফতার করতে, যাতে পালানোর সুযোগ না থাকে। মনে আছে, ষাটের দশকে একবার আমি তখন ছাত্র ছিলাম, থাকতাম পিতার সরকারি বাসায়। পুলিশ এসেছিল আমাকে গ্রেফতার করতে। আমি অবশ্য বাসায় ছিলাম না সেই রাতে। আমার বাবা সরকারি চাকরি করলেও, দরজা না খুলেই পুলিশকে জানিয়েছিলেন যে, আমি বাড়িতে নেই। পুলিশ বলেছিল, আমরা সার্চ করব। আমার বাবা দরজা না খুলেই বলেছিলেন, মাঝ রাতে দরজা খুলব না, আপনারা ভোর পর্যন্ত অপেক্ষা করুন এবং এই বলে তিনি ঘটনাটি টেলিফোনে পুলিশের আইজিকে জানিয়েছিলেন। পুলিশের আইজি বলেছিলেন, ‘ঠিক আছে, আপনি ভোরের আগে দরজা খুলবেন না, আমি পুলিশ টিমকে অপেক্ষা করতে বলে দিচ্ছি।’ ঠিকই সারা রাত পুলিশের টিম অপেক্ষা করতে বাধ্য হয়েছিল। মধ্যরাতে বিশেষ কারণ ছাড়া পুলিশও ঘরের ভেতরে ঢুকতে পারে না। এটাই নিয়ম। যদিও এ নিয়ম আমাদের দেশে পুলিশ বা মিলিটারি (যখন তারা ক্ষমতায় থাকে) মানার প্রয়োজন বোধ করে না। ওসব আইনের কথা বইয়ে লেখা থাকে, ব্যবহারে নেই।
যাই হোক, পাকিস্তান আমলেও আয়ুবের সামরিক শাসনামলেও যেটুকু সৌজন্যবোধ ছিল প্রশাসনের, এখন তার বিন্দুমাত্রও নেই। তা না হলে প্রধান বিরোধীদলীয় নেত্রী এবং দুইবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বাড়িতে পুলিশ যেতে পারে মধ্যরাতে? শুনেছি তার ক্যান্টনমেন্টের বাড়িতে নাকি পুলিশ আগেও গিয়েছিল তারেক জিয়া অথবা কোকোকে গ্রেফতার করতে মধ্য রাতেই। তবে সেটা তো জরুরি তত্ত্বাবধায়ক আমলের কথা, যে আমলে বহু অবৈধ কাজ হয়েছিল। কিন্তু সংসদীয় গণতন্ত্রের আমলেও একই রকম ঘটনা ঘটবে? এটা কিসের আলামত?
সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে এই যে খালেদা জিয়ার বাড়িতে রাত আড়াইটার সময় পুলিশ গিয়েছিল গ্রেফতার করতে নয়, সমন পৌঁছে দিতে। অপরাধী পালিয়ে যেতে পারে এ জন্য হয়তো মধ্য রাতে ‘বাড়ি ঘেরাও করে পাকড়াও করে আসামিকে’ এমন একটা যুক্তি থাকতে পারে পুলিশ প্রশাসনের। যদিও এমন যুক্তিও খালেদা জিয়া বা শেখ হাসিনার মতো নেত্রীদের ক্ষেত্রে কোনোক্রমেই বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করবে না। কিন্তু সমন দেয়া তো গ্রেফতার নয়, গ্রেফতারি পরওয়ানাও নয়। সমন মানে কোর্টের একটি নোটিশ। একটি চিঠি মাত্র। কোর্ট বলছে, আপনি অমুক মামলাসংক্রান্ত ব্যাপারে ওমুক তারিখে হাজির থাকুন। কেউ কি কস্মিনকালেও শুনেছে যে সাধারণ সরকারি চিঠি বা নোটিশ মাঝরাতে ঘুম ভাঙিয়ে দেয়া হয়? এটা অভদ্রতা! চরম অভদ্রতা। ভদ্রতা ও সৌজন্যবোধের অভাব বললেও কম বলা হলো। এটা হলো ইচ্ছাকৃত অযৌক্তিকভাবে অকারণে কাউকে নাজেহাল করার অতি নিম্নস্তরের কৌশল। এক ধরনের ফাজলামি ছাড়া আর কিছুই নয়। কে এই অধিকার দিয়েছে পুলিশ কর্তৃপক্ষকে?
আমার দৃঢ় বিশ্বাস, পুলিশ কর্তৃপক্ষ নিজের থেকে এমন কাজ করতে যায়নি। পুলিশকে করতে বলা হয়েছে। এই নির্দেশ এসেছে ঊর্ধ্বতন রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে। এটা একদিকে নিম্ন রুচির পরিচয় বহন করে, অন্যদিকে গণতান্ত্রিক বিকাশের সামান্যতম সম্ভাবনাকেও নস্যাত্ করে দিচ্ছে। গণতন্ত্রের সৌধটি গড়তে হলে তার ভিতটা শক্ত করতে হবে। শক্ত মাটি, পাথর এবং আরও উপাদান দরকার। কিন্তু যে ধরনের উপাদান আমরা দেখছি তাতে গণতন্ত্রের বিপরীতে স্বৈরতান্ত্রিক মানসিকতা এবং উন্নত সংস্কৃতির বদলে বিকৃত রুচি ও সংস্কৃতি দেখে আসছি। বিশেষ করে বিগত নির্বাচনে বিপুলসংখ্যক আসন লাভ করে বর্তমানের আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোট সরকার এই স্বৈরতান্ত্রিক মানসিকতা ও বিকৃত রুচির দিকে বেশি করে ঝুঁকে পড়েছে। তা না হলে বলুন, রাত আড়াইটায় খালেদা জিয়ার বাড়িতে কোর্টের সমন পাঠানোর কি মানে থাকতে পারে? আবার এ কাজকে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ডিফেন্ডও করেছেন। আমরা বুঝি সবই কর্তার ইচ্ছায় কর্ম। মোট কথা, এটি এক চরম বিকৃত মানসিকতার পরিচয়। কথায় কথায় ইতিহাস বিকৃতির কথা শুনি। যারা বলেন, তারা নিজেরাও ইতিহাস বিকৃত করতে সচেষ্ট হন। কিন্তু সব রকম বিকৃতির আগে মানসিকতার পরিবর্তন রোধ এবং এ ধরনের বিকৃতি ও বিকৃত রুচির হাত থেকে দেশবাসীকে রেহাই দেয়া সবচেয়ে বড় কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিকৃত রুচির আরও পরিচয় পাওয়া যাচ্ছে। সাবেক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের লাশ নিয়ে যেসব মন্তব্য করেছেন আওয়ামী লীগ নেতারা, তা কোনো ভদ্রোচিত আচরণের মধ্যে পড়ে না। প্রথমে শুরু করেছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, জিয়ার মাজারে যে কবরটি আছে সেখানে জিয়াউর রহমানের লাশ নেই। এরপর একেবারে অপ্রাসঙ্গিকভাবে আওয়ামী লীগ নেতা শেখ ফজলুল করিম সেলিম সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের লাশ নিয়ে অবান্তর প্রশ্নের অবতারণা করেছেন এবং এত বছর পর দাবি করছেন যে ওই কবরে যে বাক্স আছে সেখানে নাকি কোনো লাশ নেই, তাই ওটাকে পানিতে ফেলে দেয়া হোক। আমার কাছে অবাক লাগে, এত বছর পর হঠাত্ করে জিয়ার কবর নিয়ে এসব কথাবার্তা কেন? নির্বাচনে আশাতীত ভোট পেয়ে কি তাদের মাথাটা খারাপ হয়ে গেছে? তারা কি ধরাকে সরাজ্ঞান করছেন? কথায় ও আচরণে তাই তো মনে হচ্ছে।
সংসদে শেখ সেলিম ঠিক কী ধরনের শব্দ ব্যবহার করেছেন আমি জানি না। কারণ আমি স্বকর্ণে শুনিনি। খবরের কাগজেও সাধারণত অশ্লীল বা তেমন আপত্তিকর শব্দ উচ্চারিত হলে ছাপা হয় না। অন্যথায় আমাদের দেশের সম্পাদকীয় (৪ ফেব্রুয়ারি ২০১০) কলামে লেখা হবে কেন ‘নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি হিসেবে সংসদ সদস্যদের বাচনভঙ্গি আর লাশ কাটা ঘরের (মর্গ) চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীর মুখে ভাষা যদি একাকার হয়ে যায়, তবে. . .’ ইত্যাদি।
সম্পাদকীয় পড়ে জানলাম তিনি খালেদা জিয়াকে ‘কুটনি বুড়ি’ বলে গাল দিয়েছেন। এগুলো যে রাজনৈতিক সমালোচনা বা গাল নয়, তা সবাই জানেন। এ ধরনের শব্দ প্রয়োগ নিজেকেই ছোট করে, রুচিহীন ও সংস্কৃতিশূন্য ব্যক্তি হিসেবে নিজেকে প্রকাশ করে। আমি জানি না, কী ছিল শেখ সেলিমের ভাষা বা বাচনভঙ্গি। তবে ‘আমার দেশ’-এর সম্পাদকীয়তে যা লেখা হয়েছে তার থেকে একটি লাইন উদ্ধৃত করা যাক। ‘একেবারে অপ্রাসঙ্গিকভাবে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের লাশ নিয়ে তিনি অত্যন্ত আপত্তিকর ভাষা ও ভঙ্গিতে যেসব কথা বলেছেন, সেগুলোর সঙ্গে বস্তির কলতলার কোমর বেঁধে চেঁচামেচির তুলনা করা চলে।’
হয়তো আমার দেশ অতিরঞ্জিত করছে, হয়তো আমাদের দেশের সম্পাদকীয় কিছুটা বাড়িয়ে মন্তব্য করছে। যেহেতু আমি স্বকর্ণে শুনিনি, সেহেতু আমি মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকতে চাই। তবে এটুকু অন্তত বোঝা যায় যে আওয়ামী লীগের এ সংসদ সদস্য রুচিশীল ভাষায় কথা বলেননি। ব্যক্তিগতভাবে আমি শেখ সেলিমকে চিনি। সাধারণত তিনি ভদ্র আচরণ করেন। তাই আমার দেশের সম্পাদকীয়ের মতো আমার মনে প্রশ্ন জাগে ‘একাধিকবার নির্বাচিত সংসদ সদস্য শেখ সেলিম কেন সংসদীয় ভব্যতা বিসর্জন দিয়ে এভাবে লাগামহীন কথাবার্তা বলতে গেলেন। কেন প্রধানমন্ত্রী এবং শেখ সেলিম রাজনৈতিক শিষ্টাচার এভাবে বিসর্জন দিচ্ছেন।’
এর পেছনে কি কোনো রাজনৈতিক কৌশল আছে? নাকি এটাই আমাদের প্রতিষ্ঠিত রাজনীতিবিদ ও অধিকাংশ সংসদ সদস্যের স্বাভাবিক সাংস্কৃতিক মান? নাকি আশাতিরিক্ত ভোট ও আসন লাভের পর সত্যিই কিছুটা মাথা গোলমাল হয়ে গেছে, তারা উদ্ধত হয়ে উঠেছেন। যেটাই হোক, কোনোটাই গণতন্ত্রের জন্য শুভ নয়। বরং বড় বিপদের সংকেত দেখতে পাই।
আমাদের দেশের প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল, নেতা-নেত্রীর মধ্যে গণতান্ত্রিক চর্চা ও শিষ্টাচারের বেশ অভাব আছে। রাজনৈতিক শিক্ষারও অভাব আছে। রুচি জ্ঞান ও সাংস্কৃতিক মানের যে নিচু স্তর রয়েছে, তার প্রমাণ আরেকবার পাওয়া গিয়েছিল নব্বইয়ের দশকে (সেবারও শেখ হাসিনার প্রধানমন্ত্রিত্বের আমলে)। তখন শেখ হাসিনাও খালেদা জিয়াকে কেন্দ্র করে নারী হিসেবে বিবেচনা করে যে ধরনের মিথ্যা কথা উঠেছিল জাতীয় সংসদে তা এত জঘন্য যে এর জন্য জাতি হিসেবে লজ্জা পাওয়ার কথা। সংসদীয় তর্ক-বিতর্কের সময় যেসব ভাষা ব্যবহার করেছিলেন উভয় পক্ষের সম্মানিত সংসদ সদস্যরা তা ছাপার অক্ষরে লেখা যায় না, কোনো ভদ্র পরিবেশে উচ্চারণও করা যায় না। তখন কোনো কোনো পত্রিকা মন্তব্য করেছিল ‘সংসদ যেন অশ্লীলতার চর্চা কেন্দ্র’। সামরিক কর্তারা মাঝে মাঝে যে অবৈধভাবে ছড়ি ঘোরায়, এক-এগারোর মতো ঘটনা যে ঘটে তার পেছনে কি এ ধরনের রাজনীতিবিদদের কোনো ভূমিকা নেই? রাজনীতিবিদদের দুর্নীতি, রুচিজ্ঞানহীনতা, প্রতিহিংসার রাজনীতি এবং গণতান্ত্রিক চর্চার অভাব সুযোগ করে দেয় দুর্বৃত্তদের।
এখনও খুব খারাপ আলামত দেখা যাচ্ছে। একদিকে আইনের শাসনের অভাব, আদালতকে নির্বীর্য করে প্রশাসনের আজ্ঞাবহ করে তোলা, রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন, বন্দি অবস্থায় মৃত্যু (হত্যা বলাই সঠিক), অপরদিকে নিজেদের সরকারি দল ও জোটের মধ্যে মারামারি, খুনাখুনি, টেন্ডারবাজি, গুণ্ডামি, অর্থনৈতিক স্থবিরতা। তার সঙ্গে যদি যুক্ত হয় এ ধরনের নিম্নমানের রুচিহীন আচরণ, তা হলে তো ষোলকলা পূর্ণ হলো। গণতন্ত্রবিরোধী শক্তির জন্য উর্বর ক্ষেত্র রাজনীতিবিদরা, বিশেষত সরকারি দল আবার নতুন করে তৈরি করে দিচ্ছে।
দুর্ভাগ্য এই যে প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল, তাদের নেতা-নেত্রীরা জরুরি আমলের দুই বছরে এত মারধর খেয়েও শিক্ষা লাভ করলেন না। আমরা ফিরে যাচ্ছি সেই পুরনো আমলে, যেখানে গণতন্ত্রের চর্চা ছিল না, ছিল শক্তির দাপট। তার সঙ্গে যদি এতটাই নিম্ন সংস্কৃতির আচরণ যুক্ত হয়, তবে আসলেই শঙ্কিত হওয়ার কারণ রয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.